কয়েক দিন আগে খবরের কাগজে একটা ছবি বের হয়েছিল, খোলা বাজারে সরকারি উদ্যোগে চাল বিক্রি হচ্ছে, চালের কেজি ১৮ টাকা। যে মানুষটির চাল বিক্রি করার কথা সে উদাস মুখে বসে আছে, তার দোকানে কোনো ক্রেতা নেই! বাজারে চালের দাম এতই কমে গেছে যে ১৮ টাকা কেজিতে সরকারি চাল কিনতে কারও আগ্রহ নেই! কয়েক দিন পর দেখলাম চালের দাম কেজিপ্রতি আরও দুই টাকা কমানো হয়েছে! আমি যেখানে বসে লেখালেখি করি সেখানে প্রতিদিন হরেক রকম পাখি আসত, আমি প্রতিদিন তাদের জন্য এক মুঠি করে চাল দিতাম। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন চালের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেল, (জরুরি অবস্থা বলে কথা বলা বারণ ছিল, তারপরও অনেকেই বলছিল, দেশে একটা নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে) আমি তখন পাখিদের চাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। যে দেশে মানুষ খাওয়ার জন্য চাল পায় না, সেখানে আমি কেমন করে পাখিদের চাল খেতে দিই? আমি দেখতাম প্রতিদিন পাখিগুলো আসত, ইতিউতি করে চাল খুঁজত—আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাত, তারপর হতাশ হয়ে উড়ে চলে যেত। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে যে আমি আবার সেই অবোধ পাখিগুলোর জন্য এক মুঠো চাল দিয়ে তাদের কিচিমিচি ডাক শুনতে পারব! আমার তার থেকেও বেশি আনন্দ হচ্ছে একটা তথ্যে—তথ্যটি হচ্ছে সরকার ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারে!
চালের দাম কমে যাওয়ায় জ্ঞানীগুণী মানুষেরা কৃষকদের জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করছিলেন, যারা চালের দাম কমাতে পারে, তারা নিশ্চয়ই চালের দাম বেঁধে দিয়ে কৃষকদের রক্ষাও করতে পারে। আমি তাই দুশ্চিন্তাটা তাদেরকেই করতে দিতে চাই। যাঁরা শুধু খবরের কাগজ পড়ে ধান-চালের খবর নেন, তাঁরা অবশ্য একটি আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন। আমাকে প্রায়ই সিলেট থেকে ঢাকা আসতে হয়, আমি তখন দেখতে পাই রাস্তার দুই পাশে যত দূর চোখ যায় সোনালি ধানের শীষ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে, সেটি যে কী অপূর্ব একটা দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না!
চালের দাম কমায় ভালো খবরের পাশাপাশি ভয়ানক খবরও আছে। বিডিআরের অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে ২০৯টি গ্রেনেড খোয়া গেছে। শুধু গ্রেনেড নয়, ১১৯টি অস্ত্র, ৪০ হাজারের চেয়ে বেশি গুলিও পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো কার হাতে পড়েছে, কীভাবে ব্যবহার হবে আমরা কেউ জানি না, কল্পনা করতেও আতঙ্ক অনুভব করি। সাম্প্রতিককালের কিংবা বলা যেতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সবচেয়ে ভয়াবহ এবং হূদয়বিদারক ঘটনা ছিল বিডিআর হত্যাযজ্ঞ। সেই অমানুষিক ঘটনাটি আমাদের এমনভাবে বিচলিত করেছিল যে আমরা আবার কবে সুস্থ মানুষের মতো চিন্তা করতে পারব নিজেরাই জানি না। আমি মাঝেমধ্যে পত্রপাত্রিকায় লিখি, কোনো কিছু নিজেকে বিচলিত করলে সেটা লিখে দশজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করলে এক ধরনের স্বস্তি পাওয়া যায়। বিডিআরের সেই ঘটনার পরও আমি একটা লেখা লিখেছিলাম কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত কোথাও পাঠাইনি। পুরো ব্যাপারটি এত অবিশ্বাস্য, মনুষত্বের এত বড় অবমাননা যে আমার মনে হয়েছে এটাকে ধারণ করে পরিপূর্ণ কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। এই ভয়াবহ নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পেছনের অংশটি কী, আগে এবং পরে কী ঘটেছে, মানবিক বিপর্যয় কতটুকু সেটুকু না জেনে আমি যেটাই লিখি সেটা হবে অসম্পূর্ণ! আমি নিজে যেটা বুঝি না সেটা অন্যদের আমি কেমন করে বোঝাব?
বিডিআরের ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে, যখন তদন্ত রিপোর্ট বের হবে তখন হয়তো অনেক কিছু নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো বিভ্রান্তি নেই সেটি হচ্ছে সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়টুকুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কসুলভ ভূমিকা। সেনাকুঞ্জে সামরিক অফিসারদের সঙ্গে তাঁর বাগিবতণ্ডার সেই সিডিটি কারা কীভাবে বের করেছে সেটা একটা রহস্য। যারা সেটা শুনেছে তাদের মনে অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়েছে কিন্তু একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন করে আস্থা ফিরে পেয়েছে।
সরকার ক্ষমতায় এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কিছুদিনকে বলা হয় মধুচন্দ্রিমার সময়। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিশাল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তারা কিন্তু মধুচন্দ্রিমার সময়টুকুও পায়নি। (ভাগ্যিস ঘূর্ণিঝড় বিজলি, সিডর হয়ে ওঠেনি, যদি হয়ে উঠত তাহলে সেটা হতো আরেকটা বিপর্যয়।) তারপরও তাদের যে দুটি কাজ নতুন প্রজন্মকে আলাদাভাবে উত্সাহিত করেছে সেগুলো হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। অন্যসব ব্যাপারের মধ্যে এই দুটি কেন আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেটাও সবাই জানে। যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব হচ্ছে আমাদের শরীরে লেগে থাকা ক্লেদের মতো। তাদের বিচার করে ইতিহাসে একটা নতুন পাতা জুড়ে দিয়ে আমরা প্রথমবার ক্লেদমুক্ত হয়ে পূতপবিত্র হব। মাঝেমধ্যেই পরিচিত মানুষজন আমার কাছে দুশ্চিন্তিত মুখে জানতে চান, ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার সত্যি হবে তো?’
সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারও সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, আমি কোনো ভেতরের খবর জানি না, তারপরও আমি অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলি, ‘নিশ্চয়ই হবে।’
তার কারণ আমি জানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করলে এই সরকার আর কোনো দিন এই দেশের মানুষের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। নতুন প্রজন্মকে ক্লেদমুক্ত জীবন উপহার দেওয়ার একটা ঐতিহাসিক সুযোগ পেয়েছে এই সরকার—সেই সুযোগটি তারা কেন গ্রহণ করবে না?
নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার আরেকটি সুযোগ এসেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দিয়ে। আমার আনন্দ অন্য কারণে, কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে বুঝে হোক না বুঝে হোক এই সরকার আসলে অনেকগুলো বড় বড় অঙ্গীকার করে বসে আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আসলে কী বোঝানো হয় সেটা নিয়ে আলাদাভাবে বলা যায়—কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমেই দরকার একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। যার অর্থ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টা ঠিক করতে না পারলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটা আসলে শুধু স্লোগানই হয়ে থাকবে। কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার আসলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটার পুরোপুরি খোলনলচে পাল্টে একটা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা করার অঙ্গীকার। আমার ব্যক্তিগত আনন্দ আর উচ্ছ্বাস আসলে এখানেই বেশি। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ করার জন্য যখন অবকাঠামো দাঁড় করানো শুরু হবে তখন সবার আগে যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সেটা হচ্ছে বিদ্যুতের সরবরাহ। বিদ্যুত্ ছাড়া আসলে ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘ডি’ টুকুও করা যাবে না—কাজেই একইসঙ্গে এটা দেশের বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার। বিদ্যুত্ হচ্ছে একটা শক্তি, শক্তি তো আর এমনি এমনি আসে না, সেটা পাওয়ার জন্য দরকার জ্বালানি। কাজেই জ্বালানি হিসেবে কি কয়লা নাকি গ্যাস ব্যবহার করা হবে সেই বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে হবে, তাই সরকারকে জ্বালানি নীতিটাও ঠিক করে নিতে হবে। (আমি পারমাণবিক জ্বালানি নিয়ে এক ধরনের আতঙ্কের কথাবার্তা শুনছি—আশা করছি দেশের বিজ্ঞজন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। সবাইকে জানতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে থ্রি মাইল আইল্যান্ডে আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশে চেরনোবিলে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। যদি আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ রকম কিছু ঘটে তাহলে কী হবে সেটা চিন্তাও করা সম্ভব নয়!)
যাই হোক যেহেতু এই মুহূর্তে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেটাই শেষ করা যাক। ডিজিটাল বাংলাদেশ যে শুধু লেখাপড়া, বিদ্যুত্ আর জ্বালানি—এই তিনটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিশ্চিত করবে তা নয়, এটি এই দেশে সম্পূর্ণ নতুন একটি ঘটনা ঘটাবে। আমরা যদি কোনোভাবে এই দেশের কোনো কোনো ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও ডিজিটাল (বা কম্পিউটারায়ন) করে ফেলতে পারি তাহলে আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করব সেখান থেকে ভোজবাজির মতো দুর্নীতি উধাও হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি করতে হয় ঘোলা পানিতে, আবছা আবছা অন্ধকারে কোনো রকম সাক্ষীপ্রমাণ না রেখে। ডিজিটাল দেশে যখন প্রতিটি পদক্ষেপ স্বচ্ছ হয়ে যায়, তখন সেখানে দুর্নীতি করার জায়গা থাকে না। সাহস করে কেউ যদি করে ফেলে, তাহলে সেটা খুঁজে বের করতে কী বোর্ডে একবার টোকা দিতে হয়, মাউসে একবার ক্লিক করতে হয়। (চট্টগ্রাম কাস্টমসে এর একটা বড় উদাহরণ তৈরি হয়েছে, দুর্নীতি করতে না পেরে বড় বড় রাঘব বোয়াল এখন হাত কামড়াচ্ছে কীভাবে সেটা বন্ধ করা যায়, সে জন্য পরিকল্পনা করছে! দেশের অন্য কোথাও যেন এ রকম কিছু না ঘটে সে জন্যও তলায় তলায় ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে) কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশ হলে আমরা যে শুধু আধুনিক একটা বাংলাদেশ পাব তা নয়, আমরা দুর্নীতিও বন্ধ করতে পারব, নতুন ‘আলু-ফালু-কালু’ কিংবা নতুন হাওয়া ভবনের জন্ম নেওয়াও বন্ধ করতে পারব।
এটুকু ছিল ভূমিকা, এবারে আসল কথায় আসা যাক।
২.
নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে চালের দাম কমিয়েছে। বিডিআর হত্যাযজ্ঞের বিপর্যয় সামলেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে—এ ছাড়া কিছু ভালো ভালো উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। দেশের মানুষজন যখন নিজেদের ভেতরে কথা বলবে, তখন তাদের কথাবার্তায় এসব বিষয়গুলো উঠে আসার কথা। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের মানুষেরা কি জানেন, দেশের সাধারণ মানুষেরা এখন কী নিয়ে কথা বলে? আতঙ্কিত ছাত্রীরা এখন কেন আমাদের কাছে ছুটে আসে? ছাত্ররা কোন ব্যাপারটিকে ভয় পায়? আমার ধারণা, সরকার ভালোভাবেই জানে, যদি না জানে তাহলে আমি তাদের জানিয়ে দিতে পারি, দেশের মানুষ এখন যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলে সেটি হচ্ছে ছাত্রলীগের তাণ্ডব।
দেশের সাধারণ মানুষ টেলিভিশন আর খবরের কাগজ থেকে খবরাখবর পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমরা এর বাইরেও অনেক কিছু স্বচক্ষে দেখি। আমার কাছে ছেলেমেয়েরা চিঠি লেখে, আমি তাদের কাছ থেকেও আলাদাভাবে অনেক খবর পাই, যেগুলো খবরের কাগজের খবর হিসেবে ছাপা হয় না। কিন্তু দেশের সত্যিকার অবস্থাটা সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সারা দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হতে শুরু করেছে, খবরের কাগজে সেটা হয়তো কয়েক লাইনের খবর, কিন্তু হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী তাদের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজনের জন্য সেটা যে কত বড় একটা হতাশার ব্যাপার, সেটা কি সবাই জানে?
মাঝখানে একটা সময় গিয়েছে যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরবেলা মারপিট, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের কিছু শিক্ষক এ রকম সময়ে ছুটে গিয়ে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দলগুলোকে শান্ত না করলে অনেক আগেই খুনোখুনি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যেত। সেদিন আমার অফিসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি, দেখতে পেলাম পুলিশ ছুটে গিয়ে একজনকে ধরেছে। কেন ধরেছে সেটা নিয়ে কৌতূহল ছিল, কিছুক্ষণেই সে কৌতূহল নিবৃত্ত হলো, আমি দেখতে পেলাম তার কাছ থেকে বিশাল একটা কিরিচ বের হয়েছে, এত বড় কিরিচ তৈরি হয় জানতাম না, সেটা শরীরে লুকিয়ে হাঁটাহাঁটি করা যায় সেটাও জানতাম না। বিকেলবেলা খবর পেলাম, পুলিশ সব মিলিয়ে তিনজনকে ধরে নিয়ে গেছে, তিনজনই ছাত্রলীগের কর্মী। একজন আমার সরাসরি ছাত্র, ক্লাস নেওয়ার সময় আমি প্রায়ই তার খোঁজ নিতাম, সবাই ক্লাস করছে, সে কেন ক্লাস করে না প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পেতাম না। সে কবে ছাড়া পাবে আমি জানি না। যখন ছাড়া পাবে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমি তার কাছে কিংবা তার মতো অন্যদের কাছে শুধু একটা জিনিসই জানতে চাই, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এত বিশাল একটা বিজয়, সারা দেশের মানুষের তাদের কাছে এত বড় একটা প্রত্যাশা, কিন্তু তারা কেন আওয়ামী লীগের এত বড় একটা অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য এত বদ্ধপরিকর? যেভাবে চলছে যদি সেভাবেই চলে তাহলে কত দ্রুত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ক্ষমতাটুকু পুরোপুরি উবে যাবে তারা কি সেটা জানে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে তখন আমরা আজকাল নিজের অজান্তেই বলে ফেলি, নিশ্চয়ই এটা ছাত্রলীগের কাজ এবং দেখা যায় আসলেই এটা সত্যি। আওয়ামী লীগের নেতারা কি সেটা জানেন?
আমাদের পত্রপত্রিকা মোটামুটিভাবে স্বাধীন, কাজেই আমার ধারণা তারা ভালোভাবেই জানেন। তারা হয়তো সমস্যাটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না কিংবা ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে—কোনটা সত্যি আমাদের জানা নেই।
৩.
আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে স্বাধীনতার পর আমরা প্রথমবার দেশটাকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম। যাঁরা দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির কোনো কিছু ছিল না, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল, দুঃসময় ছিল, দুর্ভোগ ছিল, নিজেদের মধ্যে বিভাজন ছিল। সেই সুযোগ নিয়ে ’৭৫ সালে দেশের শত্রুরা দেশটাকে দখল করে নিয়েছিল। যারা বাংলাদেশকে অর্জন করে এনেছিল, যারা দেশটাকে ভালোবাসত, তাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দেশটাকে শাসন করেছে অন্যরা। তারা দেশের ইতিহাসকে পাল্টেছে, দেশের আদর্শকে তছনছ করেছে, ঠেলে ঠেলে দেশটাকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার রাস্তায় তুলে দিয়েছে। ১৯৯০ সালে যখন আবার দেশটা গণতন্ত্রের রাস্তায় ফিরে এসেছে, আমরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। আমরা অবশ্যই খুব দ্রুতই আবিষ্কার করেছি গণতন্ত্রের পথটা এত সহজ নয়, গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ভোটের একটা রাজনীতি হয় আর সেই ভোটের রাজনীতির অন্ধকার সরু গলি দিয়ে দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীরাও ক্ষমতার অংশ পেয়ে যায়। দেশটাকে অবলীলায় মধ্যযুগে ঠেলে দেয়। তাই ভোটে একটা দল জিতে এলেই আমরা আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না, আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখতে হয় কারা ক্ষমতায় আসছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন কি না জানি না, গত নির্বাচনের বিজয়টি এই দেশের সব প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা তাদের নিজেদের বিজয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। একাত্তরে যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছে, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, তারা এখন প্রবীণ। একাত্তরে যারা ছিল টগবগে তরুণ, তারা এখন ধীরস্থির, কর্মক্ষম এবং আত্মবিশ্বাসী। অনেক দিন পর তারা আবার দেশকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে চাইছে। তারা জানে এটা তাদের শেষ সুযোগ, এই সুযোগটি তাদের হাত ছাড়া হলে আবার যখন সুযোগ আসবে তখন হয়তো তারা আর থাকবে না। যদি বা থাকে বার্ধক্য আর জরা এসে এমনভাবে তাদের গ্রাস করবে যে তারা তখন শুধু দূর থেকে ঝাপসা চোখে দেখবে। জোট সরকারের আমলটি ছিল একটা বিভীষিকার সময়। শুধু যে দুর্নীতি আর লুটপাট ছিল তা নয়, সেটি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে ভেতর থেকে দেশকে খুবলে খুবলে খাওয়ার সময়, দেশটির অঙ্গহানি করার সময়। অনেক দিন পর সুযোগ এসেছে দেশের ক্ষতগুলোকে নিরাময় করে সুস্থ সুন্দর একটা দেশ গড়ে তোলার। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই প্রজন্ম এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলছে যে এবার আর ব্যর্থ হওয়া চলবে না। যেভাবেই হোক তারা শেষ বারের মতো দেশটাকে সাহায্য করতে চায়। তাদের সেই সুযোগ করে দিতে হবে।
ছাত্রলীগ করার নামে কিছু অবিবেচক ছেলেদের সেই সুযোগটি নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না।
৪.
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটি দুঃসহ দাবদাহ বয়ে গিয়েছে, সারা দেশ যেন আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল কংক্রিট আর ইট পাথরের ঢাকা শহর। সেই দুঃসহ তাপমাত্রার খবরের পাশাপাশি আরেকটা খবর পড়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমিও শিউরে উঠেছিলাম। সাভারের অধরচন্দ্র মডেল হাইস্কুলের দেড় হাজার ছাত্রছাত্রীকে তাদের পরীক্ষা বাতিল করে আড়াই ঘণ্টা গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হলো। এই অমানুষিক নির্যাতনটি তাদের কোনো শাস্তি হিসেবে দেওয়া হয়নি, এটি করা হয়েছে ঢাকা ১৯ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ এবং তাঁর আরও কয়েকজন সহযোগীর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
আমি যদি একজন সাংসদ হতাম এবং আমাকে যদি কোনো স্কুলের ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনা জানাতে চাইত এবং আমি সেই স্কুলে গিয়ে যদি আবিষ্কার করতাম যে স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা বাতিল করে আড়াই ঘণ্টা থেকে তীব্র গনগনে রোদে দাঁড়া করিয়ে রাখা হয়েছে তাহলে নিশ্চয়ই আমি শিশুদের নির্যাতন করার দায়ে হেড মাস্টারের বিরুদ্ধে মামলা করে দিতাম। ঢাকা-১৯ আসনের সাংসদ হেড মাস্টারের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেননি, তিনি শিক্ষার্থীদের দেওয়া ফুলের মালা গলায় দিয়ে তাকে দেওয়া সংবর্ধনাটি উপভোগ করে এসেছেন, খবরের কাগজে সেই ছবি ছাপা হয়েছে। সেই ছবি দেখে দেশের মানুষ আতঙ্কে শিউরে উঠেছেন।
এ রকম খবর মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে আসে। আমরা মাঝেমধ্যেই দেখি স্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের রোদ বা বৃষ্টির মধ্যে পতাকা হাতে পথের দুই ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে কোনো একজনকে সংবর্ধনা জানাতে। সেই কোনো একজনের যদি বিন্দুমাত্র কমনসেন্স থাকত তাহলে তারা জানতে পারত যে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের হাতের পতাকা নাড়িয়ে আসলে তাদের অভিশাপ দিচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের অভিশাপ থেকে কঠিন কোনো অভিশাপ এ পৃথিবীতে নেই। এই ছোট বাচ্চাদের বুক আগলে রক্ষা করার কথা তাদের শিক্ষকদের, আমাদের দুর্ভাগ্য তাদের শিক্ষকেরা ছোট বাচ্চাদের পাশে এসে দাঁড়ান না। চাটুকারীতায় চরম পর্যায়ে পৌঁছে তারা শুধু যে নিজেদের উত্সর্গ করে দেন তা নয়, তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেন। এই স্কুলের হেড মাস্টার বা অন্য কর্মকর্তাদের আসলে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই, সভ্য দেশ হলে নিশ্চিতভাবে দেশের আইনে শিশু নির্যাতনের অপরাধে তাঁর বিচার হতো।
অনেক বড় বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে। একদিকে অসহিষ্ণু দায়িত্বজ্ঞানহীন ছাত্রলীগ, অন্যদিকে তৌহিদ জং মুরাদের মতো সাংসদেরা। কত দ্রুত তাঁরা সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে দিতে পারেন সেটা কি আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন?
এই সরকার ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগের নেতারা পরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মদের জন্য আর কোনো সুযোগ নেই—তাদের যেন কোনোভাবে হতাশ করা না হয়।
এই দেশের ওপর অধিকার সবচেয়ে বেশি কিন্তু তাদের।
প্রথম আলো থেকে