somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্রিকেট ফিকেট, সমর্থন টমর্থন

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৮.১০.১৬
[অনলাইনে খেলোয়াড়দের ভিলেন বানিয়ে আবেগি কিছু লেখা পড়ার পর ক্ষিপ্ত কফিগ্রস্ত অনুভূতি]

দেশের অধিকাংশ পাব্লিকের মতন, আমিও খেলা আশ্চর্যরকম কম বুঝি। বিশেষ করে ক্রিকেট। শুধু জানি বেসিক জিনিসগুলা- বল হবে, পিটানি হবে। উইড়া গেলে ছয়, গড়ায়া চার, ক্যাচ মিসে মুখ চোখা করে গালি, বোল্ড করলে সিট থাপড়ায়া তালি ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইরকম শিশুতোষ জ্ঞানের সহিত বসবাস করা সত্ত্বেও, একপ্রকার দানবীয় উৎসাহে আমি খেলা দেখি। ফ্ল্যাট বাসায় থাকি, খেলা চলার সময় কোন কারণে নিচে নামতে হলে খেলার আপডেট আশেপাশের বাসা থেকে ভেসে আসে। দলবদ্ধ হুঙ্কার কিংবা উন্মুক্ত গালিবর্ষণ ইঙ্গিত দেয় - খেলা হচ্ছে সসমারোহে। এমনকি আমার বাসার সামনে নেড়ি কুত্তাটাও পাভলোভিয়ান রেসপন্সে প্রশিক্ষিত হয়ে গেছে; ধারাবিবরণীর শব্দ পেলেই সে ভদ্র বালকটির মতন থাবায় মুখ গুঁজে বসে থাকে চায়ের দোকানের সামনে। কান খাড়া। (আসলে তাঁর কান খাড়া চোখ সতর্ক থাকে এই আশায় যে কখন দোকানদার উচ্ছিষ্ট কিছু ফেলবে আর সে দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে তা খাবে; কিন্তু ন্যারেটিভের প্রয়োজনে ধরে নেন যে এইখানে পেটের ক্ষুধার কোন সম্পর্ক নাই, এবং কুত্তাটা ক্রিকেটপ্রেমি)

এখানে ক্রিকেট সমীকরণের কিংবা ফ্যাক্টসের কোন জায়গা নেই।

জায়গা আছে কেবল অনুভূতির। আমরা আবেগি। সেই আবেগ আমরা ছড়িয়ে দিয়েছি খেলায়। এগার জন প্লেয়ারের মাঝে আমরা নিজেদের দেখি; ভাবি- এরা তো আমাদের পাড়ার পোলাপান। নিজেদের লোক। বড় ভাই, ছোট ভাই। খেল ভাই, তোরা খেল। আমরা আছি বারোতম খেলোয়াড় হিসেবে।

কিন্তু, আবেগের কিছু ভালো মন্দ আছে। অন্ধ আবেগ যেমন, অন্ধ তার প্রকাশ। টিম সাপোর্ট করি, টিম হারলো, আমার মেজাজ খারাপ। আমি দোষ দিলাম এক খেলোয়াড়কে। শালায় কিছু পারে না। ভোন্দা।

জিনিসটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে কোন কথাই ছিল না। রাগ দুই একদিন থাকে থাকুক। স্বাভাবিক ব্যাপার। নেক্সট ম্যাচ আবার নতুন দৃষ্টিতে শুরু হোক। প্লেয়ার তো আমাদেরই লোক রে ভাই, ক্ষোভ থাকতে পারে, ঘৃণা নিশ্চয়ই থাকবে না?

কিন্তু আমরা সেখানে থামি না। আমরা ঠেলতে ঠেলতে চলে যাই আরও দূরে। ব্যক্তিগত ব্যাপারে। আমরা বলি, হালায় বুইড়া। আমরা গবেষণা করি তাঁর জাতিগোষ্ঠীর উৎপত্তি এবং রাজনৈতিক সমর্থনের ওপরে। আমরা আবিয়াইত্যা মাইয়ার অযাচিত পাড়াতো অভিভাবকের মতো দেখি সে কোথায় গেল, কি করল, প্রেমজীবন তার কতটা সমৃদ্ধ এবং সেগুলি নিয়ে উৎসাহী চোখে জাবর কাটি। আমরা অভিযোগ করে বলি - হালায় ঘুষ খাইছে নি? দৌড়ায় না ক্যান? আর দুই একটা ভুল করে ফেললে তখন সবজান্তার সুরে বলি - দ্যাখছ, কি মিস করে! কইছিলাম না, নিশ্চিত ঘুষ খাইছে!

আমরা তার মেয়ের নাম নিয়ে হাসি, বোনের ছবিতে লোলুপ মন্তব্য করি, পরিবারের অবস্থান নিয়ে খিকখিকিয়ে দাঁত কেলাই। পরিশ্রমকে উড়িয়ে দেই ভাগ্য বলে, আর ভাগ্যকে ভুল করি ট্যালেন্ট ভেবে। আমাদের চোখ জহুরির না, মুহুরির; কাঁচের মাঝে হিরে খুঁজতে গিয়ে আমরা দুটোর পার্থক্য পাই না। তখন খেপে গিয়ে মামলা করে দিই।

আবেগি হবার এই জ্বালা। কোথায় থামতে হয় সেটা জানি না আমরা। কিন্তু যাকে নিয়ে এত প্রশ্ন তুললাম, গলায় আঙুল দিয়ে এত ট্রল উদ্গীরণ করলাম, সেই লোকটাই পরের ম্যাচে ভালো করলে আমরা গিয়ার পাল্টে ফেলি। উগড়ে ফেলা ট্রল তখন গিলে ফেলি আবার। মনোযোগের সাথে চিবাই। তখন তাঁর টিমের প্রতি আত্মনিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, প্রফেশনালিজম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না।

সমস্যাটা এখানেই।

বাকি দুনিয়ায় প্লেয়ারদের নিয়ে হাসিতামাশা কম হয় না। একটা লিমিট থাকে। যান, লিমিটের কথা বাদ দেন। ভাই, আমরা তো বাকি দুনিয়া না। এই পোলাগুলা তো আমাদের। নিজস্ব গর্ব। আমরা সেই সমর্থক, যারা শেষ বল পর্যন্ত সাপোর্ট দেয় টিমকে। আমরা সেই সমর্থক, যারা জীবনের সিংহভাগ দোয়াদরুদ পড়ে টিভির সামনে আর স্টেডিয়ামে। আমরা উল্লাস করি টিমকে কেন্দ্র করে, আর টিম হতাশা দূর করে আমাদের সাপোর্টকে কেন্দ্র করে। পারস্পরিক সম্পর্ক। আমরা কেন এত নিচে নামব? মনে রাখেন -

প্রত্যেকটা খেলোয়াড় যথেষ্ট পরিশ্রম করে এই পর্যায়ে এসেছে।
প্রত্যেকটা খেলোয়াড় দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়।
সবার পারফরমেন্সের পেছনেই একটা না একটা গল্প থাকে।
এবং, আমাদের মতই, তারাও কিন্তু দিনশেষে, এক একজন আবেগি মানুষ। আপনার প্রত্যেকটি বিষবাণ তাকে সংশয়ী করে, প্রত্যেকটি উৎসাহ-বাণী তার খেলায় পজিটিভ ইফেক্ট রাখে।

আপনি সমালোচনা করতেই পারেন তার খেলা নিয়ে, তার স্কিল নিয়ে। আপনার রাগ থাকতেই পারে ম্যাচে তার অবদান নিয়ে। সমর্থক হিসেবে এটা আমাদের একপ্রকার অধিকার। আমরাই মারব, আমরাই বুকে টেনে নেব।

কিন্তু আপনি যেটা পারেন না - সেটা হলো তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। তার আবেগের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। ওটা সমালোচনা নয়, ওটা অপমান। এবং ভয়ানক অপমান। আপনি সমালোচনা করুন খেলোয়াড়ের, ব্যক্তির নয়।

ঠাট্টা এক জিনিস, আর অভিযোগ আরেক। ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা দুইজন। স্লেজিং করবে প্রতিপক্ষ, এইটা ধরেই আমাদের প্লেয়াররা মাঠে নামে। তারা ভাবে না- গ্যালারি থেকে তারই সমর্থক চ্যাঁচ্যাঁয়ে তাঁর পরিবারের গুষ্টিউদ্ধার করবে, বলবে, 'কিরে অমুক, কত ট্যাকা খাইছস?' মনে রাখেন- জার্সির ভেতরে একজন মানুষ আছে, যার নিজের পরিবার আছে, প্রিয়জন আছে, নিজস্ব একটা জগত আছে- এবং ওই জগতে আপনার নাক গলাবার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই।

ঠাট্টা ভাল, ঠাট্টা স্বাভাবিক, কিন্তু যখন আপনি আর প্লেয়ারটাকে দেখেন না, দেখেন ঠাট্টাটাকে- তখন সেটা কি আর ঠাট্টা থাকে? নাকি হয়ে ওঠে আরও সিরিয়াস কিছু?

এগুলি সাধারণ ভদ্রতা। ক্রিকেটের সমর্থক আপনি, ক্রিকেটের এটিকেট মেনে চলবেন না?

তাহলে আমার বাসার সামনের নেড়িকুত্তার সাথে আপনার কি কোন পার্থক্য থাকছে? সে খাবারের লোভে দোকানের সামনে বসে থাকে, আমি ন্যারেটিভের প্রয়োজনে বলি - ব্যাটা ক্রিকেটপ্রেমী, খেলা দেখছে। আপনি প্লেয়ারকে কতভাবে পচানো যায়, এই আইডিয়ার রসদের জন্যে টিভির সামনে বসেন, আর নিজের পরিচয় দেন- আমি সাপোর্টার, খেলা দেখছি।

পার্থক্য নেই কিন্তু।

খুব একটা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ২:৪৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×