‘কলম’ ফেব্র“য়ারি-অক্টোবর ২০০৫ সংখ্যাটি হাতে পেয়েই একনাগাড়ে পড়ে ফেলেছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে এ সংখ্যার কবিতাগুলো। সংখ্যাটির অন্যান্য লেখাও যে ভালো লাগেনি তা নয়, তবুও কিসের যেনো অভাব বোধ করেছি মনে মনে। কিসের অভাব; তাৎণিক বুঝতে না পাড়লেও, পরে তা পরিষ্কার হয়েছে।
মনে পড়ে এয়াকুব আলী চৌধুরীকে কাজী আবদুল ওদুদের লেখা একটি পত্রের কথা। পত্রটি পহেলা ফেব্র“য়ারি ১৯২৭ ঢাকায় বসে লেখা। জানুয়ারি ১৯২৭ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির মুখপত্র হিসেবে মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০) ও কবি গোলাম মোস্তফা’র (১৮৯৭-১৯৬৪) যৌথ-সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাহিত্যক’ সম্পর্কে ঐ পত্রটিতে কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেনÑ “নানা দিক ভেবে মনে হয় সাহিত্যিক বার করাটা ভুল হয়েছে, কেননা মুসলমান সমাজে লেখক মুষ্টিমেয় তার উপর সাহিত্যিকের যে কোনো নতুন বাণী আছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। যদি কোন নতুন বাণী না থাকে তবে মামলি মুসলমানী বরণে ‘সওগাত’ই ত চলছে।”
কাজী আবদুল ওদুদ পত্রটি লেখার সময় খেয়াল করেননি যে, ‘সাহিত্যক’ প্রকাশের ব্যাপারে যে দুটি সংকটের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তার প্রথমটির দিকে নজর দিতে গেলে ‘সাহিত্যিক’-এর মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ জরুরী হয়ে পড়ে। কারণ যে সমাজে লেখক মুষ্টিমেয়, সে সমাজে লেখক তৈরি করা কিংবা লেখক খুঁজে বের করার দায়িত্বটি এসে পড়ে আর এ দায়িত্ব পালনে পত্রিকা প্রকাশের বিকল্প কী? কিন্তু তিনি যে দ্বিতীয় সংকটের কথা বললেন, সেটি নিয়ে ভাববার আছে আজ এত যুগ পরেও।
বর্তমানে মুসলমান সমাজে, একটি মুসলিম বাংলাদেশে লেখকের সংখ্যা যথেষ্ট। এত লেখক, এত বুদ্ধিজীবি, এত সংস্কৃতিসেবী, এত পত্র-পত্রিকা, কল্পনাই করা যায় না। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশেটিতে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার জগতে বলতে গেলে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। অন্য দিক থেকে দেখলে এটি অর্থনৈতিক উর্ধ্বগতিরই প্রমাণ। প্রতিদিন অনেকগুলো দৈনিকের ঝকঝকে তকতকে চেহারা দেখে, টিভি চ্যানেলগুলোর মুখচ্ছবি দেখে অভিভূত হয়ে যাই। সত্যি তো, শুধু জনসংখ্যার উর্ধ্বগতি নয়, অর্থ (মনে রাখা চাই, টাকা পয়সা এখন কালো পথেই ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে বেশি) ও মিডিয়ারও তো উর্ধ্বগতি চাই। আর হয়েছেও তাই। কথা যেদিকে এগুচ্ছে, সেদিকে এগুতে দিলে এটি একটি থিসিস হয়ে উঠবে বরং আমরা ফিরে আসতে চাই কাজী আবদুল ওদুদের কাছে। কাজী আবদুল ওদুদ যে অভাব প্রবলভাবে বোধ করেছেন, যে অতৃপ্তিতে ভুগেছেন, সে অভাব ও অতৃপ্তি আজকের দিনে বোধ করার কথা নয়। তাঁর মধ্যে যে নতুন বাণীর অন্বেষা ছিল, আজ তার অভাব থাকার কথা নয়। অথচ প্রত্যয় ও প্রতিশ্র“তিহীন সৃজনশীলতা আর হলুদ সংবাদের মোহে আচ্ছন্ন মিডিয়ার দিকে তাকালে সেই সূক্ষ্ম অভাববোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
কলমের কাছে কোন আবদার নয় বরং সুস্পষ্ট দাবিÑ ‘কলম’ সেই লেখাটিকে অবশ্যই এড়িয়ে যাবে, যে লেখাটির মধ্যে কোন তেজস্ক্রিয়তা নেই। ‘কলম’ নিজ উদ্যোগে খুঁজে বের করবে সেই লেখককে, সেই লেখাটিকে; যে লেখক কিংবা যে লেখার মধ্যে আছে সমকালের নাড়ী-নত্র ও শিরা-উপশিরায় প্রবহমান বাণী। কলমের কাছে এ রকম দাবি জানানোর নিশ্চয় একটা ভিত্তি আছে। আশা করি এ দাবি পূরণে ‘কলম’ আরো বেশি সচেষ্ট হবে।