somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বর্ণচোখ

১২ ই এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(ষড়ঋপু সিরিজের তৃতীয় কাহিনি — লোভ)

⸻ সতর্কীকরণ: ছায়া পড়লে আলোও কাঁপে ⸻

এই কাহিনি কেবল একটি গল্প নয়। এটি এক মানসিক প্রতিচ্ছবি, যেখানে লুকিয়ে আছে মানব আত্মার সেই কোণ, যেখানে লোভ—নীরব অথচ আগ্রাসী—আলোর ছায়া হয়ে নেমে আসে।

“স্বর্ণচোখ”, ষড়ঋপু ধারাবাহিকের তৃতীয় অধ্যায়, আপনাকে নিয়ে যাবে রাজশাহীর প্রাচীন অলিগলির মাঝে, এক তরুণের হৃদয়ের গোপন সংকল্পে, এবং এক অপার্থিব কৌতূহলের পথে।

এখানে প্রেম আছে, কিন্তু তা পূর্ণ নয়। সত্য আছে, কিন্তু ছদ্মবেশে। এবং যা আছে সবচেয়ে বেশি—তা হলো লোভ, যা প্রথমে চোখ জাগায়, তারপর চোখ কেড়ে নেয়।

এই গল্প আপনার আত্মার দরজায় কড়া নাড়বে—আপনি যদি প্রস্তুত থাকেন, তবে প্রবেশ করুন। আর যদি না থাকেন… তাহলে সাবধান… স্বর্ণচোখ কেবল দেখে না, আপনাকে নিজের মতো করে গড়েও তোলে।

স্বর্ণচোখ (ষড়ঋপু সিরিজের তৃতীয় কাহিনি — লোভ)

রাজশাহীর মালোপাড়া যেন এক টুকরো অলস দুপুরের স্মৃতি, যেখানে পুরনো ইটের গন্ধে মিশে আছে সময়ের ধুলো। সেই অলসতাতেই হেঁটে বেড়াত ছেলেটি—আরিয়ান। সদ্য রাজশাহী কলেজে ভর্তি হওয়া এক তরুণ, বয়স মাত্র আঠারো পেরিয়ে উনিশে। শরীরচর্চায় গড়া সুঠাম দেহ, চোখে তীক্ষ্ণতা, চেহারায় এমন এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যা একবার দেখলে কেউ সহজে ভুলতে পারে না। সে কথা কম বলত, কিন্তু যা বলত, তা যেন ব্যস্ত শহরের কোলাহলে ছুঁড়ে দেওয়া নৈঃশব্দ্যের গুলি।

আরিয়ান মেয়ে পাগল নয়, কিন্তু একজনকে সে মন থেকে ভালোবাসত—সায়মা।সায়মা তার কলেজ লাইফের প্রথম প্রেম, যাকে নিয়ে সে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত, প্রতিদিন পদ্মার পাড়ে হেঁটে বেড়ানো, রাতের ফোনে দীর্ঘ চুপচাপ ভালোবাসা, আর সেই বিশেষ চোখের দৃষ্টি, যেটি বলে দিত—"তুইই আমার সব।"

কিন্তু আরিয়ান ভেতরে ছিল জেদী। সে যা চায়, তা যেন পৃথিবীর সব নিয়ম ভেঙে ছিনিয়ে আনতে চায়। তার মধ্যকার এক ভয়ানক আত্মকেন্দ্রিকতা আর দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা—একপ্রকার লোভ—আস্তে আস্তে গ্রাস করছিল তাকে।

স্বর্ণচোখের আবিষ্কার

রাজশাহীর এক পুরনো অলিগলিতে, মালোপাড়ারই এক পরিত্যক্ত বাড়িতে, সে একদিন খুঁজে পেল এক অদ্ভুত বস্তু—একজোড়া চোখের কাচ, স্বর্ণাভ গ্লাসের মতো। প্রথমে মনে হয়েছিল ওটা কোন পুরনো ভাঙ্গা চশমা। কিন্তু যখন সে গ্লাসজোড়া চোখে দেয়, মুহূর্তেই বদলে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গি।

প্রতিটি মানুষকে সে যেন দেখতে পারল তাদের আসল চেহারায়—কে কি চায়, কার ভেতরে কী আছে, কার ভালোবাসা আসল, কারটা ভণ্ডামি।

প্রথমে সে অবাক হয়, তারপর মুগ্ধ, তারপর আসক্ত।

এই চোখ দিয়ে সে সব বুঝতে পারে।সায়মার চোখে সে দেখে ভালোবাসা, সন্দেহ, নিরাপত্তাহীনতা।শিক্ষকের চোখে দেখে হিংসা আর ক্ষমতার লোভ।বন্ধুদের চোখে দেখে প্রতিযোগিতা আর ছলনা।

ক্ষমতা ও পতনের শুরু

ধীরে ধীরে স্বর্ণচোখের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। শুধু দেখাই নয়—সে চোখ দিয়ে মানুষকে প্রভাবিতও করতে পারে। একধরনের মানসিক প্রক্ষেপণ। চাইলেই সে কাউকে বাধ্য করতে পারে তাকে মেনে চলতে। যেন এক অদৃশ্য বশীকরণ।

সে পরীক্ষায় প্রথম হয়, মেয়েরা তাকে ঘিরে থাকে, শিক্ষকরা তার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে।

কিন্তু এই সাফল্যের তৃষ্ণা তার ভেতরের লোভকে আরো বাড়িয়ে তোলে। সে আর সন্তুষ্ট নয় কলেজ ক্যাম্পাসের শ্রেষ্ঠত্বে, সে চায় রাজশাহী শহরকে কাঁপাতে।

এক রাতে, পদ্মার পাড়ে হেঁটে হেঁটে সে ফিসফিস করে বলে, "তুই রাজা হবি... আরিয়ান... তুই রাজা হবি।"

সায়মা এই পরিবর্তন বুঝতে পারে। সে বোঝে আরিয়ান বদলে যাচ্ছে। তার চাহনি বদলে গেছে, তার শব্দে আগের কোমলতা নেই, শুধুই আত্মম্ভরিতা।

অতীতের ছায়া

একদিন, এক প্রবীণ বৃদ্ধ তাকে পথরোধ করে বলে, “তুই ওটা পেয়েছিস... স্বর্ণচোখ। আমি এক সময় পেয়েছিলাম এটা। এটা তোকে দেবেও, আবার কেড়ে নেবে সব কিছু।”

আরিয়ান হেসে চলে যায়। কিন্তু মনের গভীরে এক অজানা অস্থিরতা ঢুকে পড়ে।

সে বোঝাতে চায়, “তুই বদলে যাচ্ছিস, এই স্বর্ণচোখ তোর জীবন নয়, এগুলো মায়া। লোভের ফাঁদ।”

কিন্তু আরিয়ান এখন আর ভালোবাসা চায় না, সে প্রভাব চায়। সে ক্ষমতা চায়। তার চোখে স্বর্ণাভ আলো ছড়ায়, যেন তার ভিতরে কেউ কথা বলছে—“আরো চাও... আরো দখল করো।”

মানসিক নিরীক্ষা ও মৃত্যুর হাতছানি

এক রাতে, রাজশাহী কলেজের এক বটগাছতলায় সে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকজন সহপাঠীকে সে এক ধরনের মানসিক পরীক্ষার মধ্যে ফেলে। নিজের ক্ষমতা যাচাই করতে গিয়ে সে একজনকে আত্মঘাতী হতে বাধ্য করে।

এরপর সে নিজেই বুঝতে পারে, তার মধ্যে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই যা মানবিক। সে একদম বদলে গেছে। স্বর্ণচোখ ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না। রাতে ঘুমালেও চোখদুটি যেন খুলে থাকে।

সায়মার অন্তর্ধান ও আরিয়ানের একাকীত্ব

সায়মা হারিয়ে যায়। হয়ত আত্মহত্যা করে, হয়ত শহর ছেড়ে চলে যায়। আরিয়ান খোঁজে, কিন্তু খুঁজে পায় না।

সে বুঝতে পারে, এই চোখ কখনোই উপহার ছিল না। এটা ছিল এক ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা। সে যে লোভের পিছনে ছুটেছিল, সেটা আসলে ছিল এক মৃত্যু ডেকে আনার পথ।

অন্তিম পরিণতি

এক রাতে, সে ছুটে যায় পদ্মার পাড়ে। বাতাস ভারী, আকাশে মেঘ, যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রস্তুত। তার গায়ে এখন ছেঁড়া জামা, চোখদুটো লাল—কিন্তু তবু সেই স্বর্ণচোখ খুলতে পারে না। চশমাটা যেন গেঁথে গেছে তার হাড়ের গভীরে।

সে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে, “এটা আমার ছিল না... এটা আমি চাইনি...”কিন্তু ভেতর থেকে ভেসে আসে এক কর্কশ শব্দ—“তুই চেয়েছিলিস। লোভ করেছিলি। তোর আত্মা দিয়েছিস। এখন তুই শুধুই চোখ।”

সে নদীতে ঝাঁপ দিতে চায়। কিন্তু নদী তার শরীর নেয় না।সে পাথরে মাথা ঠুকে রক্তাক্ত হয়। কিন্তু মৃত্যু আসে না।সে চায়, কেউ তাকে চিনুক, কেউ তাকে ডাকুক নাম ধরে। কিন্তু চারপাশে কেবল অন্ধকার, কেবল নীরবতা।

তার ভেতরকার আরিয়ান—যে ভালোবাসত, যে স্বপ্ন দেখত—সে এক এক করে স্মৃতিহীন হয়ে যায়।শেষে, তার মনে থাকে কেবল একটিই অনুভূতি—ক্ষুধা।কোনো মানুষের জন্য না, ভালোবাসার জন্য না—ক্ষমতার, নিয়ন্ত্রণের, চোখ দিয়ে দেখার ক্ষমতার ক্ষুধা।

পদ্মার জলে সে প্রতিচ্ছবি দেখে—তাকে আর চেনা যায় না। চোখদুটো নেই, সেখানে দুটো পোড়া গর্ত, আর সেই গর্তের ভেতরে—একজোড়া জ্বলন্ত স্বর্ণচোখ বসে আছে।

তখন সে প্রথমবার চিৎকার করে কাঁদে,“ফিরিয়ে দে! ফিরিয়ে দে আমার মানুষটা, ফিরিয়ে দে আমার ভালোবাসা!”কিন্তু গর্জন করে ওঠে আকাশ, নদী, শহর—“মানুষ হতে হলে ত্যাগ করতে হয়। তুই তো বেছে নিয়েছিলিস—লোভ।”

শেষ দৃশ্য—রাজশাহীর এক ঝড়ের রাতে, পদ্মার ধারে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত যুবক হাঁটু মুড়ে বসে আছে। তার শরীর জড়ানো বাতাসে, তার চোখে এখনো সেই চশমা, কিন্তু সে কিছুই আর দেখতে পায় না।দূরে কোনো ছায়া বলে ওঠে,“এখনো সব শেষ হয়নি... এটা তো শুধু শুরু।”

শেষ নয়… এটি লোভের মূল্য মাত্র। সামনে আছে আরো ছায়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:১৮
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মজনু নামাজ পড়ার পর মোনাজাত ধরল তো ধরলই, আর ছাড়তে চাইল না | পাক আর্মির বর্বরতা!!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭



১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি পুরো বাঙালী জাতির উপর যে নৃশংস হত্যাংজ্ঞ, বর্বরতা চালিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব দোষ শেখ হাসিনার !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৬


অনেকদিন পর zahid takes এর ডা. জাহেদুর রহমানের এনালাইসিস ভিডিও দেখলাম। জুলাই আন্দোলনের পূর্বে বিশেষত যখন র‍্যাব স্যাংশন খায় তখন থেকেই উনার ভিডিও দেখা আরম্ভ করি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুলকে ১৩ বছর পুর্তি উপলক্ষে অভিনন্দন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৭



সামুর সুসময়ের আদর্শ ব্লগারদের মাঝে মাঈনউদ্দিন মইনুল হচ্ছেন একজন খুবই আধুনিক মনের ব্লগার; তিনি এখনো ব্লগে আছেন, পড়েন, কমেন্ট করেন, কম লেখেন। গত সপ্তাহে উনার ব্লগিং;এর ১৩ বছর পুর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়তির খেলায়: ইউনুস ও এনসিপিনামা

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৪



২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান চলচ্চিত্র 'আনব্রোকেন' একটি সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, আমেরিকান বোমারু বিমানের কিছু ক্রু একটি মিশন পরিচালনা করার সময় জাপানিজ যুদ্ধ বিমানের আঘাতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×