যখন দশ টাকায় পাইজাম চাল কিনতাম, তখন বাজারের টাকা মেরে, বিশেষ করে মাছের দামটা নিয়ে চাপাবাজি করে দু'তিন সপ্তায় একটা করে সেবা'র বই কেনার টাকা উঠিয়ে ফেলতাম। এখন হিসেব করেন তো দেখি, তখন সেবার বইয়ের দাম কত ছিলো? নাহ, তিন সপ্তায় একুশ দিনের প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে মেরে দিয়ে একশো পাঁচ টাকায় সেবার বই কখনো কিনতে হয়নি। দু'তিন সপ্তায় হয়তো বাজারে যাওয়ার সৌভাগ্য হতো পাঁচদিনের মতো, বহুত দরদাম করে মাছের বাজারে দু'টাকা কমে বিশটা কই আটত্রিশ টাকায় কিনে, বা দুই ভাগ চাপিলা মাছ আঠারো টাকায় কিনে বাসায় এসে বিশ দুগুণা চল্লিশ বা দশ দুগুণা বিশ বলে চালিয়ে দিয়ে, পাঁচ দুগুণা দশ টাকা জমিয়ে সেবার তিন গোয়েন্দা বা অনুবাদ কেনা যেত; পেপারব্যাকে দু'শো পৃষ্ঠার (আড়াইশো/তিনশোও ছিলো মনে হয়!) বই, মাত্র দশ টাকায়!!
তখন শক্ত বাঁধাইয়ের "ঝকঝকে তকতকে" অফসেটে এক-দেড়শো পৃষ্ঠার হুমায়ূন আহমেদীয় বই বা কোলকাতার অনুবাদগুলোকে অনেক উঁচু শেলফের পাঠ্য মনে হতো, বিষয়বস্তুর কারণে যতটা তার চেয়ে বেশী দামের কারণে, ওগুলোর দাম থাকতো কমসেকম ত্রিশ টাকা! কাজেই দশ টাকা সেরের চাল খেয়ে দশ টাকা দামের বই পড়েই সুখে থাকতে হতো।
এসব সুদূর কৈশোরের কথা, সেই ছিয়াশি/সাতাশি/আটাশি'র সময়ের কথা। এরপর অনেক জল গড়িয়েছে অনেক নদীতে, অনেক পাহাড়েরও বরফ গলেছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে, চালের দাম, কৈ মাছের দাম, মায়ের বাজারের বাজেট, মেরে দেয়া টাকার পরিমাণের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বইয়ের দামও। আজ পাইজামের দাম চল্লিশ টাকা (নাকি আরো বেড়ে গেছে!!), সে হিসেবে সেবার দু'শো পৃষ্ঠার পেপারব্যাক বইয়ের দামও হওয়া উচিত চল্লিশ টাকাই। জানিনা দাম কতো এখন। আবার, হার্ড কাভারের ঝকঝকে অফসেটের দেড়শো পৃষ্ঠার বইয়ের দামও হওয়া উচিত একশো বিশ টাকার কাছাকাছিই। যদিও নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা যে বই প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বিশ বাইশ বছরে চালের দামের মতোই চারগুণ বেড়েছে কিনা। হিসেব করে দেখা যায় অবশ্য, কারণ এটুকু বলতে পারি যে, তখন সাদা কাগজের দিস্তা ছিলো বারো টাকা, নিউজপ্রিন্টের দিস্তা ছিলো তিন টাকা। এখন এসবের দিস্তা কত করে?
আরেকটা তথ্য, তখন খবরের কাগজগুলো এখনকার মতো ত্রিশ পৃষ্ঠাসমৃদ্ধ স্ফীত কলেবরে বের হতোনা, বড়জোর ষোল পৃষ্ঠা, দাম দু'টাকা।
ইন্টারপোলেশনের সুবিধার জন্য আরো কিছু উপাত্ত মনে করার চেষ্টা করি। সাতাশি/আটাশি থেকে একলাফে দুঝাজার দশে চলে আসলে গাণিতিক হিসেবে ব্যাড়াছ্যাড়া লাগতে পারে, তাই পঁচানব্বই ছিয়ানব্বইয়ের দিকের দামগুলোও মনে করার চেষ্টা করি। তখন পাইজাম চালের কেজি ছিলো পনেরো-ষোল টাকা (সাত আট বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছিলো), সাদা কাগজের দিস্তা ছিলো বিশ টাকা, নিউজপ্রিন্ট চার/পাঁচ, আর ইকোনো কলমের দাম অপরিবর্তিত -- তিন টাকা (কলমের কালির দাম বাড়েনি মনে হয় অনেকদিন, ছাপার কালির দাম?). খবরের কাগজের বপুও স্ফীত হওয়া শুরু করে, দামও ছিলো চার বা পাঁচ টাকা মনে হয়।
কিন্তু ব্লগে বিচরণ করে বইমেলার নানান খবরের ভীড়ে যেটা খচ্ করে লাগছে আজকাল, তা হলো, কোনভাবেই সাদা কাগজে হার্ড কাভারের দেড়শো পৃষ্ঠার উপন্যাস (এখন কেউ এত বড় উপন্যাস লেখে কিনা সেটাও প্রশ্ন) মনে হয় একশো বিশ টাকায় পড়া যাবেনা, মনে তো হচ্ছে আড়াইশোতে যেতে হবে।
বোঝা যাচ্ছে যে এখানে স্ফীতির হারটা অনেক বেশী, অন্য জিনিসের দাম যেখানে চারগুণের মতো বেড়েছে, সেখানে এসব বইয়ের দাম সাত-আটগুণ বেড়েছে।
প্রশ্নটা জাগে কেন? কাগজের দাম বেশী? নাকি হার্ড কাভারের? নাকি প্রিন্টিং কস্ট? নিশ্চয়ই বই প্রকাশে প্রয়োজন এমন কোন একটা উপাদানের খরচ অনেক বেড়ে গেছে!
আলোচনা চলুক, হয়তো একটা গ্রহনযোগ্য হিসেব কেউ তুলে ধরতে পারবেন।
(মানুষের আয় কেমন বেড়েছে? ৮৭/৮৮ এর দিকে বিসিএস অফিসাররা ঢুকতো ৩৫০০ এর কাছাকাছি স্কেলে মনে হয়, এখন কি ১৪ হাজারে গেছে?)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:১৫