৩য় পর্ব
আবু জাহেলের নতুন রূপঃ
ঘরে ঘরে নতুন রূপে দেখা দিল আবু জাহেল। ইসলামের বিরোধীতায় এরা যেমন প্রাচীন আবু জেহেলের চেয়ে অনেক বেশী অগ্রসর তেমনি নারীদের উপর অত্যাচারের ক্ষেত্রেও এদের জুড়ি মেলা ভার। হেন প্রকারের অত্যাচার নেই যে তারা নারীদের উপর করে না।
নারী যখন মা তখন ‘তুমি কি বোঝ?’ বলে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে মোটেও কুন্ঠিত হয় না। যখন বোন তখন তাকে অবহেলা আর লাঞ্ছনায় একপাশে ঠেলে দিল। যখন স্ত্রী তখন তো আর কথাই নেই-প্রথমেই তার কাছ থেকে বিপুল পরিমান যৌতুক আদায়ের জন্য মানষিক তারপর দৈহিক নির্যাতন শুরু করে। কেউ কেউ আবার নিজেকে ভদ্র এবং মুসলমান বলে দাবী করে তারা প্রত্যক্ষভাবে যৌতুকের কথা না বলে পরোক্ষভাবে বলে। তথা কথিত নারী হিতৈষীরা তখন উপদেশ দেয় ‘নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে হবে তাহলেই শান্তির পায়রা ঘরে ঢুকবে। কিন্তু কই? তারপরও তো শান্তির দেখা মেলে না। ফাহিমা বেগম প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। তার স্বামী আজহার সাহেবও শিক্ষক। নিজের বেতনের টাকা ফাহিমা বেগম কোনোদিন নিজে তুলে আনেন না, আজহার সাহেবই আনেন এবং তার কাছেই রাখেন। ফাহিমা বেগম স্কুলে যাওয়ার আগে কিছু রান্না করে যান আবার বিরতি টাইমে এসে বাকি রান্না করেন। একদিন বললাম ‘রান্নাটা কাজের বুয়াকে দিয়ে করালে হয় না? ফাহিমা বেগম বললেন “না উনি আবার কাজের বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারেন না।”
এর নাম কি ভালোবাসা না অত্যাচার? শুধু এই না আরো আছে ফাহিমা বেগমকে ঘর সংসার গুছিয়ে রাখতে হয়। ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার দায় দায়িত্ব নিতে হয়। আজহার সাহেবের কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে পা টিপেও দিতে হয়। এই সব কাজ ঠিক মতো না হলে মাঝে মাঝে ‘সংসার করার অযোগ্য মহিলা’ বলে ভৎর্সনাও শুনতে হয়।
অথচ দৈনিক আট ঘন্টা চাকুরী করার পর ফাহিমা বেগমদের উপর এই সব কাজের বোঝা চাপানো কি মস্তবড় জুলুম না?
স্ত্রী যখন ইনকাম না করে তখনকার অত্যাচার আবার অন্য রকম। তখন প্রায়ই শুনতে হয় ‘রোজগার করতে হয় না তো তাই বোঝ না কত ধানে কতো চাল! বললেই সব পাওয়া যায়- ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক ধরনের কটু কথা। না আমি সবার কথা বলছি না কিছু ব্যতিক্রম পরিবার আছে। কিন্তু তাকে আমি ব্যতিক্রমই বলব। কারণ আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবারের চিত্রই উপরে উল্লেখিত চিত্রের মতো। এর একমাত্র কারণ ইসলাম থেকে আল কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া।
সদ্য বিবাহিত যুবক আহমাদ। খুব গর্বের সাথে বললো “আমি আমার বড় ভাইয়ের মতো বউ’র কাজ করে দেবনা। এক ইংরেজ দম্পতির নাকি মশারি টানানো নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিয়ে ভেঙ্গে যায়। দরকার হলে তাই যাবে তবু মশারি টাঙ্গাতে যাব না।”
তার মানে ঘর সংসারের কাজে সে কোন দিন স্ত্রীকে সহোযোগিতা করবে না। বললাম “ঘরসংসারের কাজে স্ত্রী কে সহোযোগিতা করা তো সুন্নত।”
সর্বশান্ত হলো নারীঃ-
আঠারো বছর এক সাথে থাকার পর ভেঙ্গে যায় নুর জাহান আর দুলালের সংসারটি। তিনটি সন্তানের উপস্থিতি ও ধরে রাখতে পারে না, ফেরাতে পারেনা অনিবার্য ভাঙ্গনের হাত থেকে সংসারটিকে। তিনটি সন্তান নিয়েই চলে আসে নুরজাহান ভাইয়ের আশ্রয়ে এবং তা ভাই এর পরামর্শেই। এই সংসারের হাড়ি পাতিল প্লেট বাটি-চেয়ার টেবিল খাট আলমারী সোকেচ থেকে টয়লেটের প্যান পর্যন্ত নুরজাহানের পছন্দে কেনা। স্বল্প আয়ের দুলালের উপার্জন থেকেই তিল তিল করে জমা করে, নিজে মাঝে মাঝে দর্জিকাজ করে টাকা পয়সা জমিয়ে এই সব ক্রয় করেছে নুরজাহান। এই বাড়ির প্রতিটি জিনিষের সাথে ওর হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। এই মেহগনি গাছ গুলো নিজে লাগিয়েছে। গাছে পানি দিয়েছে। এই আম গাছ-আরও কি কি যেনো অনেক গাছ। কারো গরু ছাগলে নষ্ট করলে তাদের সাথে ঝগড়া করেছে। আঠারোটি বছর সে এই সংসারের সব জিনিষকে আমার আমার বলেছে। যদিও প্রথম থেকেই দুলালের সাথে খুব একটা বনিবনা ছিল না। নূর জাহান এই সব কিছুকেই নিজেরই মনে করত। রোদ বৃষ্টি ঝড় ঝাপটার মতো শান্তি অশান্তির মধ্য দিয়েই তিনটি সন্তানের মা বাবা হয়েছে ওরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কি কারণ সঠিক বলতে পারব না। উভয় উভয়কে দোষারোপ করে। সে যাই হোক ডিভোর্স দিয়েছে দুলাল বাড়ি এবং বাড়ির প্রতিটি জিনিষ ছেড়ে চলে এসেছে নূর জাহান। এতোদিনে নূর জাহান বুঝল এ বাড়ি এই সংসার এই বাগান-গাছপালা কিছুই তার না, তাহলে এই আঠারো বছর সে এই সংসারের কি ছিল? কেয়ার টেকার? এই সংসারের উপর কি নূর জাহানের কোনো মালিকানা ছিল না? দুলাল সেই সাজানো সংসারে আর এক নারীকে নিয়ে এসেছে। সন্তান তিনটি স্তব্ধ বিমূঢ়। তারা যদিও মায়ের কাছেই আছে কিন্তু দুজনের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। ভাই-এর পরামর্শে নূর জাহান মামলা করেছে দুলালের নামে ওর প্রাপ্য মোহরানা আর বাচ্চাদের খোরপোষের দাবীতে। দুলালও রাজী তা দিতে। যদিও বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও এই পর্যন্ত দুলাল কিছুই দেয়নি। ব্যাস মামলা শেষ। সম্পর্ক শেষ। আঠারো বছরের সংসার শেষ। সমাজে এই হল নারীদের অবস্থান। এর জন্য দায়ী কে? নূর জাহান তবু সন্তানদের বুকে নিয়ে আছে।
রোকেয়ার ব্যাপারটাতো আরো অন্যরকম। রোকেয়ার স্বামী বিয়ে করার কারণে রোকেয়া ই ডিভোর্স দেয় স্বামী ইমরান কে। এবং বাড়ী থেকে চলে যায় রাগ করে। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। রোকেয়া আবার বিয়েও করেছে কিন্তু সন্তানদের কথা মনে হলে কলিজাটা ছিড়ে যেতে চায়। ছুটে চলে আসতে ইচ্ছে করে কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সমাজে খুঁজে দেখুন এমনি হাজার হাজার নূর জাহান আর রোকেয়া পাবেন। সংসারটা মেয়েরা নিজেদের মনে করলেও আসলে সংসারে তাদের কোনো অধিকার নেই। এটাই বাস্তব। স্বামীর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হলে তাকে সবকিছু ফেলে নিঃস্ব হয়ে ফিরে যেতে হয় ভাই এর সংসারে। অথচ কুরআনের নির্দেশ ‘স্বামী যদি তাকে পাহাড় সমান দ্রব্য সামগ্রীও দিয়ে থাকে বিবাহ বন্ধন ভেঙ্গে গেলে তা থেকে সে কিছুই ফেরত নিতে পারবে না।” (সূরা নিসা: ২০) নারীদের পক্ষে বহু আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই কোথাও।
১.মনের সন্তুষ্টি সহকারে ফরজ মনে করে স্ত্রীদের মোহরানা পরিশোধ করো। (সুরা- নিসা: ২৪)
২.স্ত্রীকে যদি পাহাড় সমান সম্পদ ও দেওয়া হয় (তালাকের পর) স্বামী তা থেকে কিছুই ফেরত নিতে পারবে না। (সূরা নিসা: ২০)
৩.ইদ্দত চলাকালীন অবস্থায় তার ভরনপোষন দেবে।
৪.সন্তান মায়ের কাছে থাকলে তার খরচ পিতাকেই দিতে হবে।
অথচ আমাদের পুরুষ সমাজ এর একটাও মানতে রাজি নয়। তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী তার তথাকথিত সংসারের সবকিছু ছেড়ে একেবারে শুন্য হাতে ফিরে আসে বাবা কিংবা ভাইয়ের সংসারে। কোনো কোনো জায়গায় তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নির্দয় পুরুষ শিশু সন্তানকেও আটকে রাখে মা’কে দেয় না। আর মা যদি কোনো রকমে সন্তান নিয়ে আসে তাহলে তার খরচ অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ তা দেয় না। তখন এই সব নূর জাহান-রোকেয়াদের বাধ্য হতে হয় আবার নতুন করে কোনো পুরুষের বাসর ঘরে প্রবেশ করতে। আবার ঠিকানা বদল হয় নারীর।
কিন্তু এরা তো আধুনিক জাহেলিয়াতের নির্যাসে লালিত পুরুষ। রাসূল (সাঃ) এর সংস্পর্শে যে পুরুষ-মানুষ হয়েছিল তারা বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা নারীদের বিয়ে করলে তাদের শিশু সন্তানদেরও সন্তানের মতো আদর যত্ন করত। অথচ বর্তমান সমাজের পুরুষেরা এই সব সন্তানদের শত্রুই মনে করে।
দুইটি সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েছে আলিয়া। একটির বয়স পাঁচ বছর অন্যটি তিন বছর। স্বামী মারা যাওয়ার চার মাস দশদিন পার হতে না হতেই স্বামীর বড় ভাই এবং ছোট ভাই এর তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। অবাক আর দিশেহারা হয়ে পড়ে আলিয়া। ভাসুর কে অনুনয় করে বলে,“বিয়ে করতে হবে কেন? আমি তো এ বাড়িরই বউ। এই সন্তানরা তো আপনারই ভাইয়ের ছেলে। আমি কোনো দিন বিয়ে করব না আমি আপনাদের মৃত ভাই এর বিধবা স্ত্রী হয়েই এই সংসারে থাকতে চাই। কিন্তু এসব অনুনয় বিনয়ে কাজ হয় না। বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে বাড়ি ছাড়া করার প্রচেষ্টা চালায় মৃতের বড় ভাই। তখন এক সহৃদয় পুরুষ এগিয়ে আসে অসহায় আলিয়ার সাহায্যে। বিভিন্ন প্রকার সাহায্যের আশ্বাস আর প্রলোভনে ভুলে যায় আলিয়া। এই পুরুষটি যখন আলিয়ার সন্তান দুটির লালন পালন শিক্ষা দিক্ষার দায়ভার নিতে চায় তখন আলিয়া যেনো অকুলে কুল দেখতে পায়।
বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসে আলিয়া বিয়ে করে পুরুষটিকে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই বাচ্চাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে পুরুষটি। কারণে অকারণে মারপিট করে। উপায়ন্তর না দেখে আলিয়া আবার ফিরে আসে পূর্ব স্বামীর বাড়িতে। বাচ্চাদের রেখে আলিয়াকে তাড়িয়ে দেয় আলিয়ার ভাসুর। অনেক কান্নাকাটি করেও সেখানে ঠাই পায় না আলিয়া। অশ্লিল গালাগালি শুনে বাচ্চাদের রেখে চলে যেতে বাধ্য হয়। ভাইদের সংসারেও ঠাঁই হয় না। বাবা নেই- মা ছেলেদের সংসারের বোঝা-মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার সাধ্য তার নেই। তাই সেই দুর্ব্যবহারকারী স্বামীর কাছেই ফিরে যেতে বাধ্য হয় আলিয়া বেগম। চলবে.............
প্রথম পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



