বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে হচ্ছে কী? গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে এ দেশের প্রেসিডেন্ট ২০ জন ফাঁসির আসামিকে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে কারামুক্ত করার আদেশ দিয়েছেন! প্রেসিডেন্ট যে সরকারের অনুগত লোক ও শিখণ্ডী হিসেবেই এই কাজ করেছেন এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ এ দেশে যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকার প্রশ্নাতীতভাবে তার নিজের আজ্ঞাবহ লোক ছাড়া কাউকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করে না। কাজেই এই অপকর্মের জন্য প্রেসিডেন্টকে সরাসরি দায়ী করার কিছু নেই। এর মূল দায়িত্ব তাদেরই, যাদের নির্দেশে প্রেসিডেন্ট এ কাজ করেছেন।
আইন মন্ত্রণালয় উপরোক্ত ২০ জন ফাঁসির আসামির জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুপারিশ করে পাঠিয়েছিল। সেই সুপারিশের পর প্রেসিডেন্ট তা শিরোধার্য করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার এই কর্মসম্পাদন করেছেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যে ফাঁসির আসামিদের এইভাবে ক্ষমা করে দিয়ে জেলমুক্ত করা হয়েছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী। এই আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয়ই এদের ক্ষমাপ্রাপ্তি ও জেল মুক্তির কারণ। এরা আওয়ামী লীগের লোক। এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় যখন দেখা যায় প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এভাবে এতজন ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দেওয়ার কোনো কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে ব্যাখ্যা করা হয়নি। শুধু তাই নয়, সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব এ ব্যাপারে খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ক্ষমা ঘোষণার কারণ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই। কেন নেই? দেশে আইন-আদালত আছে। সেই আদালতের রায় যেমন কতগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভর করে, তেমনি প্রেসিডেন্ট যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন তখন সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা কেন করা হলো, তার কারণও প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এবং তাঁর কাছে সুপারিশ দেনেওয়ালা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে। এই ব্যাখ্যা পাওয়া জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজা-রাজড়ারা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ইচ্ছেমত লোকজনের গলা কাটত এবং সব রকম অন্যায় করে জবাবদিহিতা ও শাস্তির ঊর্ধ্বে থাকত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নামে পরিচয়দানকারী কোনো রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোনো স্বৈরাচারী শাসক নন। তাকে স্বেচ্ছাচার করার জন্য প্রেসিডেন্টের গদিতে বসানো হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলেছেন, এ ক্ষেত্রে কারণ ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নেই (ডেইলি স্টার, ৮-৯-২০১০)। এই ঔদ্ধত্যের জন্য স্বরাষ্ট্রসচিবের আচরণের বিচার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ প্রেসিডেন্টকে ক্ষমা ঘোষণার অধিকার সংবিধান অনুযায়ী দেওয়ার অর্থ আগেকার দিনে রাজা রাজড়াদের মতো স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষমতা দেওয়া নয়। কাজেই স্বেচ্ছাচারী হিসেবে নয়, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে, তাঁর প্রত্যেক কাজের জবাবদিহিতা ও ব্যাখ্যা জনগণের সামনে অবশ্যই উপস্থিত করতে হবে। তিনি যদি এ ব্যাপারে ক্ষেত্র বিশেষে নিজের দায়িত্ব অবহেলা করে গুরুতর কোনো অপরাধ করেন তার জন্য তার অভিশংসন বা ইমপিচমেন্টের ব্যবস্থাও সংবিধানে আছে। এটা আছে এ কারণে যে, প্রেসিডেন্টসহ কেউই একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানে আইনের ঊর্ধ্বে নন। আসলে রাষ্ট্র যেভাবেই পরিচালিত হোক, গণতান্ত্রিক চেহারা বজায় রাখার জন্য এ ব্যবস্থা সংবিধানে রাখা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানেও আছে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে এই আলোচনার কারণ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির থাকলেও তিনি স্বেচ্ছাচারীর মতো এ কাজ করতে পারেন না। কোনো স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বা প্রকৃতপক্ষে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলে দেশের প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী তাকে জনগণের কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। ২০ জন আওয়ামী লীগ দলীয় খুনের আসামিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রপতি এখন জনগণের কাঠগড়াতেই নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন।
মুক্তি পাওয়া ফাঁসির আসামি নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফিরোজ বলেছেন, ‘মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন পলাতক থেকে আমরা আদালতে আত্মসমর্পণ করি। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অফিস হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদনগুলো পৌঁছালে তিনি আমাদের সাধারণ ক্ষমা করেন’ (কালের কণ্ঠ ৮-৯-২০১০)। এর থেকে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে, আইনের হাতের বাইরে লুকিয়ে থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই এই ফাঁসির আসামিরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর সরকার প্রদত্ত আশ্বাসের ভিত্তিতে আসামিরা প্রেসিডেন্টের কাছে সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করে। এই প্রক্রিয়াতে ২০ জন ফাঁসির আসামি এক অদৃষ্টপূর্ব প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করে। পুরো প্রক্রিয়াটিই যে রাজনৈতিক মতলববাজির ব্যাপার, এতে সন্দেহ নেই। এই মতলববাজির খেলায় প্রধানমন্ত্রী, সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবাই জড়িত। এটা যে এক রাজনৈতিক ব্যাপার, এর সঙ্গে যে আইনি প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, এটা বোঝা যায় সাজাপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামিদের মুক্তি লাভের পর আওয়ামী লীগ কর্তৃক তাদের সংবর্ধনার মাধ্যমে। কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মুক্তিপ্রাপ্তদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী’ এই শিরোনামে এক সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে সাজাপ্রাপ্ত ক্রিমিনালদের মুক্তির পর শুধু যে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছে তাই নয়; তাদের এক সমাবেশে গণসংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে, যার অনুষ্ঠান হবে আজ ৮ সেপ্টেম্বর।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে,
এভাবে ফাঁসির আসামিদের ক্ষমা লাভ করে মুক্তি বাংলাদেশে এখন ক্রিমিনালদের জয়জয়কার এবং তাদের রাজত্ব এ দেশে কায়েম হওয়ার কথাই ঘোষণা করছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আওয়ামী লীগের সাজাপ্রাপ্ত আসামি থেকে নিয়ে যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘোরতর দুর্নীতির মামলা ছিল সবাই সরকারি ক্ষমতার জোরে নিজেদের কলঙ্ক মোচনের ব্যবস্থা করছে। যেভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা পাইকারি হারে আদালতকে দিয়ে খারিজ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগে কোনো দুর্নীতিবাজ, চোর, ঘুষখোর, কমিশনখোর নেই। তারা সবাই সাধুসন্ত, তাদের সবারই চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’! প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা যেভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাতে এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই। কাজেই আগে যেসব ক্রিমিনাল আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীরা গলায় মামলা ঝুলিয়ে ও জেলের ভাত খেয়ে জীবন অতিবাহিত করছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিচার’ পেয়ে এখন মামলার পরিবর্তে তাদের গলায় ফুলমালা শোভা পাচ্ছে! এ পরিস্থিতিতে ২০ জন ফাঁসির আসামি প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে মুক্তি লাভের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য হলো, ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’!
সত্য বলতে এই আওয়ামী লীগ নেতারা যাই ভেবে থাকুন, এই সত্য আসলে হচ্ছে এই যে, বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতির ক্রিমিনালাইজেশন বা অপরাধিকীকরণ প্রক্রিয়া এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, শিক্ষা—এমনকি সাংস্কৃতিক তত্পরতা পর্যন্ত প্রতি ক্ষেত্রে নিজের জয়জয়কার ঘোষণা করছে। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ২০ জন সাজাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে ক্রিমিনালদের এই জয়ধ্বনিই শোনা যাচ্ছে।