প্রথমেই বলে নেই যে আমি মূলত বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে ভালবাসি কিন্তু আজকের লেখাটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানের বাইরে। কিছুদিন ধরেই আমি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্য যুগের কবিতা গুলো পড়তে শুরু করেছি। এই পড়ার মাঝেই মহাকবি আলাওলের 'পদ্মাবতী'তে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। আজ সেই পদ্মাবতীর কিছু লাইন নিয়ে আলোচনাই করার জন্য আমার এই লেখা।
মধ্যযুগের কবিতার একটি রীতি ছিলো নায়িকার রূপের পরিপূর্ণ বর্ণনা দেয়া। আজকাল তেমন হয় না। আজকাল লেখকেরা নায়ক-নায়িকার সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে চান ইঙ্গিতে। মধ্যযুগ ছিল অন্যরকম। তখন কবিরা নায়িকার আপাদমস্তক বর্ণনা করতেন। বলতেন তার চুল কেমন, চোখ কেমন, ঠোঁট কেমন ইত্যাদি। শরীরের কোনো অংশ বাদ দেয়া হতো না। রূপ বর্ণনায় কবিরা ব্যবহার করতেন একটির একটি উপমা। এর ফলে নায়িকার বিশেষ বিশেষ অঙ্গের রূপ সত্যিই ফুটে উঠতো। আলাওলের 'পদ্মাবতী' কাব্যের নায়িকার বর্ণনা শোনা যাক আলাওলের ভাষায়ঃ
পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ।
তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ ৷৷
আপানলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ ।
মহাঅন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব ৷৷
তার মধ্যে সীমান্ত খড়্গের ধার জিনি ।
বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী ৷৷
স্বর্গ হন্তে আসিতে যাইতে মনোরথ ।
সৃজিল অরন্যমাঝে মহাসূক্ষ্ম পথ ৷৷
ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মনে গেল রসাতল ৷৷
কাননে কুরঙ্গ জলে সফরী লুকিত।
খঞ্জন-গঞ্জন নেত্র অঞ্জন রঞ্জিত ৷৷
পদ্মাবতীর রূপ অপূর্ব, তবে কবির ভাষা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। কবি কি বলেছেন এখানে?
মহারাজ পদ্মাবতীর রূপের কথা আমি কী বলবো! তার সাথে তুলনা দিতে পারি এমন জিনিশ তো ত্রিভুবনে নেই। তার মাথার কেশরাশি পা পর্যন্ত লম্বা, তার তাতে ভরপুর সর্বদা মৃগনাভির সৌরভ। সে-কেশরাশি এতো কালো যে চোখের দৃষ্টি সেখানে পরাজিত হয়, তা রাত্রির মতো। কবি এরপরে সিঁথির কথা বলেছেন। পদ্মাবতীর সিঁথি কেমন? তা খুব সরু, সুন্দর, তীক্ষ্ণ, এমনকি তরবারির তীক্ষ্ণতার চেয়েও অধিকতর তীক্ষ্ণ পদ্মাবতীর সিঁথি। তারপর কবি একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে-সিঁথির সৌন্দর্য। বলেছেন, ওই সিঁথির রেখাকে মনে যেনো কালো মেঘের মধ্যে স্থির হয়ে আছে বিদ্যুৎরেখা। এতেও কবির মন ভরে নি। তাই তিনি দেন আরো একটি উপমা। বলেছেন স্বর্গ থেকে আসা-যাওয়ার জন্যে সৌন্দর্যের দেবতা অরন্যের মধ্যে এক সূক্ষ্ম পথ নির্মাণ করেছিলেন, পদ্মাবতীর সিঁথি তেমন সুন্দর, নয়নাভিরাম। কবি পদ্মাবতীর ভুরূ এর বর্ণনা দিয়েছেন ভ্রূভঙ্গি দেখে মৌমাছির দল গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কাজল রাঙা সেই চোখ খঞ্জন পাখির চোখকেও হার মানায় যা দেখে হরিণেরা বনে আর পুঁটিমাছগুলো জলে লুকিয়ে গেল।
এর পর একে একে চোখ, ঠোঁট থেকে একে একে সারা শরীরের, এমনকি পায়ের পাতা পর্যন্ত নয়নাভিরাম বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সেগুলো আর ভদ্র সমাজের সামনে বর্ণনা করার মত না, তাই ভুরূতেই আমকে থামতে হল। আলাওল কিন্তু খুব সহজ কবি নন। তিনি কথা বলেন উপমায়, অলঙ্কারে এবং অনেক সময় বেশ শক্ত শব্দে। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ার মতো কবি।
তথ্য সাহায্যঃ 'লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী'
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৫০