somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

গালিব আফসারৗ
পড়ছি দর্শনশাস্ত্র নিয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখির চেষ্টা করি, তা ফল হিসেবে কাব্যগ্রন্থ "ভালোবাসা এবং অন্যান্য অশ্লীলতা" বইমেলা '১৭ তে প্রকাশিত হয়েছে। একা থাকতে ভালোবাসি।

গল্পঃ ব্রাইট অন্ধকার এবং কষ্টেরা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছেলেটা একটা ওয়ার্কশপে কাজ করতো। দোকানটা জেলা পরিষদের সামনে, একটা বটগাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। বৃষ্টি হয়, বটগাছ আড়াল করে রাখে; রোদ হয়, গাছের নিচে ছায়া হয়ে থাকে। রাস্তা দিয়ে রিক্সা যায়, টুংটুং, গাড়ি যায়। মানুষও যায়; অমানুষ গুলো থাকে।

ছেলেটার বয়স মাত্র ১২ বছর। প্রতিদিন যখন গ্যারেজের সামনে দিয়ে ছোটছোট বাচ্চারা সুন্দর পোশাক পড়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ইস্কুলে যায়, আবার বিকেলে আসে; ও দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারও যেতে ইচ্ছে করে, এমন করে। এই রাস্তা দিয়ে ভালো জুতো-পোশাক আর কাঁধেচাপা ব্যাগ নিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে, পকেটে হাত, পকেটে মায়ের দেয়া ১০ টি টাকা; টিফিনের জন্য।
ছেলেটার স্বপ্ন দেখতে খুব ভালো লাগে।

-ওই তানবীর‍্যা, হা কইরা কি দেখোস হারামজাদা। কাম কর। নবাবী ছুটাইমু তোর, কাম কর তাড়াতাড়ি।

মালিকে তাগাদা দেয়।

তানভীর কাজে হাত চালায়, দ্রুত। এই বয়সেই ও ভালো কাজ শিখে ফেলেছে। গ্রিলদেয়া জানালা বানাতে পারে একাই, স্টিলের খাট, আলমারি আর দরোজা বানাতে পারে, কেউ সাথে থাকলে। কেউ একটু যত্ন নিয়ে দেখিয়ে দিলেই অনেক কাজ করতে পারে।
রহিম চাচা বলেন, তানবীর, তুই বড় হইয়া অনেক বড় মিস্তিরি হইবিরে, তর হাত ভালা। শুনে তানভীর খুব খুশি হয়। মাকে একদিন এই কথা বলে ও; মা বলে, মন দিয়ে কাজ কর। ট্যাকা যোগাড় কর। তুই আরেকটু বড় হইলে কিস্তির উপর ট্যাকা নিয়া তরে আমি দোকান দিয়া দিমু, নিজের দোকান। যা কামাইবি তাই নিজের, মালিকরে দেওন লাগবো না।

তানভীর স্বপ্ন দেখে, সুখ স্বপ্ন।

এই যে ও কাজ করছে, এ করে প্রতিদিন ১০০ টাকা পায়। ওর মা পঙ্গু, হাটতে পারেনা, অসুস্থ। মায়ের ওষুধ কিনতে হয়। একটা বোন আছে, টুলটুলি, ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর জন্য টাকা লাগে। বাড়ির পাশে একটুকরো জমি আছে, ওখান থেকে কিছু ফসল আসে, তাই দিয়ে খুব কষ্টে কাটে ওদের দিন। বাবা সেই কবেই রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে, সেই থেকে তানভীর ওয়ার্কশপে কাজ করে।

কাজ করতে তানভীরের কোন অলসতা নাই। আনন্দ নিয়েই ও কাজ করতে পারে। কিন্তু দোকানের মালিকটা ভালোনা, খুব খারাপ। একটু এদিক ওদিক হলেই, অকারণেই মারধোর করে। খুব নিষ্ঠুর মানুষটা।

এই তো কালকেই, জানালায় লোহা বসাতে গিয়ে হাত থেকে হাতুড়ি পড়ে গেছে ওর, কিছুই হয়নি। কিন্তু মালিক কষে দুটো থাপ্পড় মেরে দিলো। এখনো ডান গালটায় ব্যথা করতেছে। প্রায়ই এরকম মারধোর করে, খুব কষ্ট হয় তানভীরের। কিন্তু উপায় তো নেই, তার ওখানেই কাজ করতে হবে; তানভীরের বাবা মালিকের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিলো। একই দোকানে কাজ করতো, মালিকের ভালো বন্ধুও ছিলো ওর বাবা। তারপর টাকা শোধ না করার আগেই একদিন এই সামনের রাস্তাটায় উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাক এসে চাপা দিয়ে গেলো.....

রহিম চাচা সামনের দোকানে চা বিক্রি করেন। যখন তানভীরকে মারধোর করে ওর মালিক তখন একমাত্র চাচাই একটু এগিয়ে আসেন। মালিকের হাত থেকে আগলে নিয়ে একটু আদর করে দেন, চা স্টলটার সামনের বেঞ্চটাতে বসিয়ে বনরুটি দিয়ে এক কাপ গরম চা খেতে দেন। এই যত্নে তানভীর মারের কষ্ট ভুলে যায়।

কালকের মারের পর খুব খারাপ লাগছিলো তানভীরের। প্রতিদিন আর এই মার সহ্য করা যায় না। ছোট্ট শিশু মন, অভিমানে ভরা। কাজ শেষ করে বাড়িতে গিয়ে মাকে বললো, আমি আর ঐ কাইল্যার দোহানে কাম করুম না মা, পত্যেকদিন হ্যায় আমারে মারে, আজ মাইরা আমার একটা দাত ফালায়া দিছে।
কানতে কানতে বলে তানভীর।
মায়ের চোখজুড়ে অশ্রু বয়ে যায়। তবুও অনেক বুঝায় ওকে, কাজে যেতে হবে; না গেলে খাবে কি ওরা। না খেয়ে যে মরতে হবে। অনেক বুঝিয়ে রাজি করায়।

আজ বৃহস্পতিবার। সকালবেলা; মা ঘুম থেকে টেনে তুলে ভাত খেতে দিলো তানভীরকে। খেয়েদেয়ে ও দোকানে চলে এলো। পরিষদ এখনো বন্ধ, রাস্তা দিয়ে ছোটোছোটো বাচ্চারা ইস্কুলে যাচ্ছে, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে ওদের। তানভীর ভাবে, নিজে তো লেখাপড়া করতে পারলোনা; টুলটুলিকে অনেক অনে-ক পড়াবে ও, বড় হয়ে যেন ও ডাক্তার কিংবা উকিল হতে পারে।

এসব ভাবতে ভাবতেই দোকান খুলে ফেলে। কাজ শুরু করে দেয়, আজ দুপুরের আগেই দুটো জানালার লোহা লাগানো শেষ করতে হবে।
দ্রুত হাত চালাচ্ছিলো তানভীর, হঠাৎ হাতুড়ির নীচে বা হাতের কড়ে আঙুলটা পড়ে গিয়ে থেতলে যায়। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ও।
কাজ আর এগোয় না। হাতে ব্যথা নিয়ে কাজ করা যায়না।

দুপুরবেলা; মালিক দোকানে এসে দেখে তানভীর বসে আছে।
-কাম বাদ দিয়া বইসা থাকা ক্যান? জানালার কাজ হইছে?
-মালিক, আমার বাম হাত হাতুড়ার নিচে চাপা পইড়া থেতলি গ্যাছে, কাম করতি পারতিছিনা।
-কি! জানালা এখনো হয় নাই, আবার হাত ছেইচা বইসা আছে নবাবজাদা। আমি কাস্টমাররে কি জবাব দিমু, তর বাপ কাস্টমার যে আসতিছে।
হারামজাদার সাহস কম না!

এই বলে মালিক তানভীরকে মারতে থাকে। আবার আগের যায়গায় থাপ্পড় মারে।
তানভীর ছোট্ট মানুষ, সইতে পারেনা। রেগে যায়, মালিকের হাত ধরে কামড়ে দেয় জোরে আর বলে আমারে আর মারবেন না কইয়া দিলাম, মারলে আমিও ছাড়ুম না।

কামড়ানো হাত নিয়ে ফুসলাতে থাকে মালিক। রাগে গড়্গড় করতে থাকে অমানুষটা। হাতের কাছেই ছিলো একটা রড। ফস করে তা তুলে নেয়, জোড়ে একটা পিটনি বসিয়ে দেয় তানভীরকে। গগনবিদারী একটা চিৎকার দিয়ে তানভীর শুয়ে পরে। তারপর সব নীরব।

রাস্তা দিয়ে রিক্সা যায়, টুংটাং; গাড়ি যায়। মানুষ যায়; অমানুষ থাকে।
রহিম চাচার দোকানটা আজ বন্ধ, অথচ আজই অনেক বেশি আদরের দরকার ছিলো তানভীরের।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৪৩
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×