একসাথে ৪ দিন ছুটি পাওয়ায় মিজান ভাই (আমার সহকর্মী) বললেন চলেন ঘুরে আসি কোথাও।
-কোথায় যাওয়া যায়?
-এইতো কাছাকাছি কোথাও।
-কিন্তু আমার যে পাত্তি শর্ট। এই মাসে যে অনেক এক্সট্রা খরচ হবে আমার।
-আরে লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন। আপনি রাজি কিনা বলেন।
চিন্তা করে দেখলাম অনেক দিন ঘুরতে যাওয়া হয়না কোথাও, কাছাকাছি গেলেতো খরচ বেশী হবে না। টাকাটা যেহেতু ধার পাওয়া যাবে মিজান ভাইয়ের কাছে তাহলে যাই না কেন?
-ও কে, ট্যুর প্লান করেন।
-ট্যুর প্লান রেডি।
-কোথায় যাচ্ছি আমরা?
-শ্রীমঙ্গল চা বাগান, চা কারখানা দেখব প্রথম দিন। পরের দিন লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বন ও মাধমকুন্ড দেখে পরের দিন ফিরব আমরা।
-রাতে থকবো কই?
-বনের মধ্যে পাহাড়ে?
- মানে? (আমি তো টাসকি খাইলাম, আবার মনের মধ্যে বেশ খানিকটা থ্রিল অনুভব করলাম)
-সময় হলে জানতে পারবেন।
আমরা শনিবারের দিন বেরিয়ে পড়লাম সকাল ১১টায়। মিজান ভাই, ভাবী, তাদের দুই বাচ্চা আর আমি(ম্যারিড ব্যাচেলর) মোট ৫ জন। মিজান ভাই রাতেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছেন। সকালে আমরা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি রাস্তায়। কিছুক্ষণ পর দেখলাম এক পিচ্চি গাড়ি চালিয়ে আমাদের পাশে এসে থামল। কথা বলে জানা গেল ও আমাদের নিয়ে যাবে।
- লাইসেন্স আছে?
-জি স্যার।
-এই বয়সে ওরা লাইসেন্স দিল?
- স্যার পাঁচ বছর হল লাইসেন্স দিয়েছে, মুচকি হেসে জবাব দিল ছেলেটা।
ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যায় না ওর লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়েছে। তবে ওকে দেখে বেশ শান্ত স্বভাবের আর কনফিডেন্ট মনে হল আমার। আমরা চড়ে বসলাম। মিজান ভাই ভাবীকে জিজ্ঞেস করলেন টাকা পয়সা ঠিকঠাক মত রেখেছ তো? মিজান ভাইয়ের ছয় বছর বয়সী ছেলে শ্রাবণ বলল বাবা আমার কাছে ১০ টাকা আছে, অসুবিধা নাই। আমরা হেসে ফেললাম।
সুনামগঞ্জ থেকে গাড়ি ছাড়ল। লক্ষ্য শ্রীমঙ্গলের শমসের নগর। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মিনিট চল্লিশের পথ। বাংলাদেশের একটি নামকরা ব্রান্ডের চায়ের কারখানা ও বাগান সেখানে। মিজান ভাইয়ের গ্রামের এক ভাই কর্মরত আছেন সেখানে। মিনিট চল্লিশেক চলার পর আমরা রাস্তার পাশে থামলাম। মিজান ভাইয়ের ৮ বছর বয়সী মেয়ে সপ্তর্ষীর জন্যই থামা। দিনের বেলা ওকে নিয়ে জার্নি করাই বেশ সমস্যার। গাড়িতে চড়লেই কিছুক্ষণ পর অসুস্থ হয়ে পড়ে ও। আমাদের ট্যুর প্লানটাও এমনভাবে করা ছিল যে আমরা মাঝে মাঝে ওর জন্য পথে বিরতি নিব। গাড়ি থেকে নামার পর মুক্ত বাতাসে এলে মুহূর্তেই ওর অসুস্থতা যেন উবে যায়। ব্যাপারটা খানিকটা ওর সাইকোলজিক্যাল ও। যাই হোক রাস্তার পাশে একটা খোলা মাঠ মত দেখে আমরা নামলাম। নেমে নাস্তাও সারা হল। ভাবী বাসা থেকে পিঠা, নুডুল্স সহ আরো অনেক রকমের নাস্তা বানিয়ে সাথে নিয়েছিলেন। মিনিট বিশেক বিরতির পর আমরা আবার রওনা দিলাম।
মিনিট বিশেক চলার পর শ্রাবণ বলল বাবা আউটপুট দিব। ব্যাপারটা আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে সপ্তর্ষির কাছে জানলাম ওর বাবা কিছুদিন আগে ওকে কম্পিউটারের ইনপুট-আউটপুট শেখাতে গিয়ে উদাহরণ হিসাবে এটা নাকি বলেছিল আমরা যা খাই তা হলো আমাদের ইনপুট, আর শরীর থেকে যা বের করে দিই তা আউটপুট। শ্রাবণ সেটা শুনেছিল।
ওর বাবা বলল, এই মাত্র না তুমি দিলে।
-আবার দিব।
-না, এখন দেওয়া যাবে না, আরো পরে।
শ্রাবণ চেচাতে লাগল। অগত্যা উপায় না দেখে মিজান ভাই ড্রাইভার কে সুবিধামত জায়গা দেখে থামতে বললেন। এই ভাবে পথে অন্তত ৩ থেকে ৪ বার সপ্তর্ষির মুক্ত বাতাস ইনপুট, গাড়ির গ্যাস ইনপুট আর শ্রাবণের আউটপুটের বিরতি দিতে দিতে আমরা সাড়ে তিনটার দিকে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। প্রথমেই গেলাম চায়ের কারখানায় চায়ের উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখতে। আমাদের গাইড করলেন সেই ভাই।
চায়ের পাতা বাগান থেকে এনে এখানে রাখা হয় ২৪ ঘন্টা। ট্যাঙ্কের নিচ দিয়ে বাতাস প্রবাহিত করা হয়, এতে পাতা গুলো ৩০% আর্দ্রতা হারায়।
এরপর পাতাগুলো হলারের মধ্যে ঢালা হয়।
পাতাগুলো পিষে দানাদার হয়ে এভাবে কয়েকটি ট্রের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে যেতে থাকে।
এরপর এটি একটি ঘূর্ণায়মান পাইপের মধ্যে পড়ে। তখন দানাগুলো অনেকটা গোলাকার আকার পায়।
এরপর দানাগুলো লম্বা একটি চলমান ট্রের উপর দিয়ে খুব আস্তে আস্তে যেতে থাকে। তখন এর ফার্মেন্টেশন সম্পন্ন হয়(কোন রাসায়নিক ছাড়াই)
দানাগুলো প্রতি স্টেজেই আর্দ্রতা হারানো সত্ত্বেও ফার্মেন্টেশন শেষে এটি বেশ আর্দ্র থেকে যায়। এর পর সেগুলো আরো কয়েটি ট্রের উপর দিয়ে চলে যায় চালনীতে যখন সেগুলো বেশ ঝরঝরে হয়ে যায়।
এখানে বিভিন্ন গ্রেডের দানাগুলো আলাদা হয়ে যায়।
আলাদা আলাদা গ্রেডের দানাগুলোকে এরকম আরো দুইবার রিগ্রেডিং করা হয়।
এরপর দানা গুলোকে ড্রায়ারে ফেলা হয় এবং বের হয়ে আসে ফাইনাল প্রডাক্ট।
এরপর চাপাতিগুলো বস্তায় ভরে রাখা হয় গোডাউনে এবং পরে পাঠানো হয় প্যাকিং ফ্যাক্টরিতে।
কারখানার মধ্যে কর্মরত শ্রমিক।
চকচকে প্যাকেটে মোড়া চা ই আমরা দেখি। কিন্তু আমরা কি জানি চা ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার অনেক স্টেজই স্বাস্থ্য সম্মত নয় । যেমন বাগান থেকে চাপাতা গুলো তুলে এনে এগুলো না ধুয়েই হলারে প্রবেশ করানো হয়। কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের কোন বিশেষ এপ্রোন নাই, নাই কোন হ্যান্ড গ্লোভস। কাজ করার সময় চাপাতির উপর দিয়ে তারা খালি পায়ে হাঁটা চলাও করে। অথচ এই চা ই আমরা কিরকম আয়েশের সাথে চুমুক দিই তাই না?
(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


