আকাশের বুকে জেগে থাকা অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ দেখে আনমনেই অরিন্দমের কথা মনে পড়লো প্রীতিলতার। এরকম কতো সুন্দর চাঁদের ছবি তুলে দিতো অরিন্দম আর বলতো আকাশে আজ তোমাকে দেখা যাচ্ছে। জানালাটা বন্ধ করে বিছানায় শুয়েশুয়ে ইনবক্সে অরিন্দমের পাঠানো শেষ কবিতাটা বের করলো প্রীতিলতা। এই কবিতাই যে অরিন্দমের শেষ কবিতা হবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। সবসময় অদ্ভুত কথা বলতো তাকে অরিন্দম। সব কথা বিশ্বাস করতোনা সে। ভাবতো এইসব অরিন্দম সবার সাথেই করে। অরিন্দমের মৃত্যুর পর প্রীতিলতা বুঝতে পেরেছিলো অরিন্দম অন্তত তাকে যে ভালোবাসে এটা বুঝাতে কখনো কোনো মিথ্যে বলেনি। হোক সেটা স্বাভাবিক কথাবার্তায় কিংবা তাকে লিখে দেয়া অসংখ্য কবিতায়। শেষ কবিতাটা আজ আবার পড়া শুরু করলো সে।
প্রীতিলতা
আমি অসংখ্য বার অসংখ্য উপমায়
তোমার সৌন্দর্যের প্রসংশা করি
আমি কোনো উপলক্ষ পাই কিংবা না পাই
বার বার শুধু বলি ভালোবাসি।
কেন বলি জানো?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে
তুমি যেন কোনো একদিন
আমার অস্তিত্ব উপলব্ধি করো।
তোমার ওই অসম্ভব সুন্দর মুখয়ব,
মায়াবী দু'টি চোখ আর
নিষ্পাপ সৌন্দর্য খচিত হাসিতে
তুমি যেন আমাকেই ভাব।
যে আমি আমার জন্য
ঈশ্বরের কাছে নতজানু হইনি কোনোদিন
সে আমি তোমাকে চাইতে
ঈশ্বরের পায়ে পড়ব প্রতিদিন....
আমি তো আমাকে ভালোবাসতে বলছিনা
আমি যে ভালোবাসি অন্তত ভুলে যেওনা।
এতো বোকা আমি নই
তোমাকে ভুলার বৃথা চেষ্টায়
করবো কালক্ষেপন
আমি তো নিজেকেই ভুলে যেতে
করছি নিরন্তর অনুশীলন।
ভুলে যেও তখন নিজেকে নিজেই যখন
আমি ভুলে যাব একদিন
যেদিন সমাপনী মঞ্চের পর্দা নামবে
ভালোবাসি বলে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করা কেউ
ওপাশে চিরতরে হারিয়ে যাবে...
প্রীতিলতার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো পুরোটা পড়ে শেষ করার আগেই।
শরীরে হঠাৎ রাজ্যের ক্লান্তি যেন ঝেঁকে বসলো। তারপর...
কে ওখানে? অরিন্দম!
-অরিন্দমের আত্মা বলতে পারো।
তুমি তো মারা গেছো।
-হ্যাঁ।
তুমি কী আমার স্বপ্নে এসেছো?
-আসলে স্বপ্ন না। তোমার শরীরটা তোমার বিছানায় পড়ে আছে বহু আলোকবর্ষ দূরে।তোমার আত্মা এসে আমায় খুজে বের করেছে।
কোথায় তুমি?
- কোথায় বললে বুঝতে পারবেনা, মনে করো মহাশূন্যে। এখানে জীবিত আর মৃত আত্মারা মিলিত হয়। আমি নিজেও জানিনা কোথায় আছি আর কিভাবে আছি। সম্ভবত তোমার মতো কোনো জীবিত আত্মা আমাদের সন্ধানে আসলে আমরা জেগে উঠি।
আজ অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখেছো?
- নাহ এখান থেকে চাঁদ সূর্য কিছু দেখা যায়না।
স্বর্গ নরক?
- নাহ এখনো তেমন কিছুরও দেখা মিলেনি।
আজ তোমার শেষ কবিতাটা পড়ছিলাম। আমাকে লিখে দিয়েছিলে তুমি। আমার জন্যেই লিখেছিলে।
- সে জন্যেই তোমার আত্মা আমায় খুজতে এসেছে।
কেন?
- সম্ভবত আমার শূন্যতা তোমায় কষ্ট দিয়েছিল। জীবিত মানুষ মৃত কাউকে কোনো কারণে গভীরভাবে মনে করলে ঘুমিয়ে যাবার পর সে মানুষের আত্মা মৃত আত্মাটার সন্ধানে বের হয়। তখন আমাদের সাথে দেখা হয়ে যায়।
তোমার ব্যাখ্যা সঠিক না-কি না জানিনা তবে তোমার কবিতা পড়ার সময় তুমি যে নেই মেনে নিতে পারছিলামনা। আচ্ছা অরিন্দম তুমি কী সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলে?
- ভুলে গেছি।
ভুলে গেছ মানে? তুমি কী আমার উপর অভিমান করেই নিজেকে মেরে ফেলেছো।
- নাহ তো। মরে যাবার সময় বুঝতে পেরেছিলাম কেউ কারো জন্যে নিজেকে শেষ করেনা আসলে।
তাহলে?
-নিজেকে প্রচন্ড রকম ঘৃণা হলে তবেই মানুষ মানুষকে মেরে ফেলে কারণ নিজের প্রতি যখন নিজেরই চরম ঘৃণা সৃষ্টি হয় তখন আর বাঁচার কোনো অনুপ্রেরণা অবশিষ্ট থাকেনা।
সেই ঘৃণাটা কেন জন্মেছিলো?
-নিজেকে ভালোবাসতে পারছিলামনা আর তাই।
কেন?
-ভালোবাসা সব ফুরিয়ে গিয়েছিলো, নিজেকে ভালোবাসার জন্য কিছু অবশিষ্ট ছিলনা।
ভালোবাসা ফুরিয়ে গিয়েছিলো কিভাবে?আমাকে ভালোবাসতে বাসতে?
-জানিনা।
আমি জানি কিন্তু ভুল করেছিলে অরিন্দম। এতো ভালো কেন বাসতে গিয়েছিলে? আমি তো কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাইনি, কথাও দেইনি কিছু।
- তোমাকে কোনো দোষ দেইনি তো আমি। তোমাকে যে ভালোবাসতাম তুমি তো সেটাই বিশ্বাস করতেনা।
করতাম।
- উহু, করতেনা কারণ ভালো তোমাকে অনেকেই বাসতো। সবসময় আমাকে সবার মতোই দেখেছিলে। তোমার কাছে কোনোদিন আলাদা হতে পারিনি।
-তাই বলে মরে যেতে হবে?
- না তো, তবে আমি যে নিজেকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম।
নিজেকে ঘৃণা করলেই মারা যায় মানুষ?
জানিনা।
কিভাবে মারা গিয়েছিলে তবে?
জানিনা, সিলিং ফ্যানের সাথে নিজেকে ঝুলতে দেখেছিলাম সে রাতে। তারপর কিছু মনে নেই।
তাহলে আত্মহত্যাই করেছিলে স্বীকার করলে?
- কিছু স্বীকার করছিনা। এখানে কোনো স্বীকারোক্তি হয়না।
আমার কথা মনে পড়ে?
-কারো কথাই মনে পড়েনা। শুধুমাত্র জীবিত কোনো আত্মা যদি দেখা করতে আসে তবে আলাপ হয়। আলাপকালে অন্য দু'একজনের কথা উঠলে তাদের কথাও মনে পড়ে।
বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে, তারা আসেনা?
-খুব বেশী আসে। বিশেষ করে মা। আমি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করি। জড়িয়ে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না। খুব কষ্ট হয়।
তোমার সর্বনাশা আবেগ কী তোমার পিছু ছেড়েছে?
- হ্যাঁ, আমি আসলে জীবন থেকে নয় জীবনের সব আবেগ অনুভূতি থেকে মুক্তির আশায় এখানে পালিয়ে এসেছি। মুক্তির স্বাদ আমি পেয়েছি প্রীতিলতা। তবে এই মুক্তির স্বাদ পেতে আমাকে অনেক সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে, অনেক জীবন্ত যন্ত্রণা পাড়ি দিতে হয়েছে।
তোমাকে দেখতে পারছিনা কেন অরিন্দম?
- এখানে আসলে দৃষ্টিশক্তি বলে কিছু নেই। এখানে কেউ কাউকে দেখেনা। শুধু এক আত্মার আগমনে অন্য আত্মা জেগে উঠে। তুমি এসেছ তাই আমি জেগে উঠেছি।
আমার ঘুম ভাঙ্গতেই তোমার আত্মা হারিয়ে যাবে তাইনা?
- হয়তো।
কিছু মানুষ তো ঘুমের ঘোরে মারা যায়। তাদের আত্মা সম্ভবত এভাবে কারো সন্ধানে এসে আর ফিরে যায়না ইচ্ছে করেই না-কি যেতে পারেনা?
- আমার জানা নেই। এখানে ইচ্ছেশক্তি কাজ করে কি-না জানিনা।
আমি যদি থেকে যেতে চাই।
- আমি তো চাইনা থেকে যাও।
কেন খুব বেশী রেগে আছো নাকি ঘৃণা অরিন্দম।
- এখানে রাগ-অভিমান, ইচ্ছে-অনিচ্ছে কিছু কাজ করেনা।
আমাকে রেখে দাও অরিন্দম তোমার কাছে।
- আমার সে ক্ষমতা নেই।
যদি ক্ষমতা থাকতো তবে?
- জানিনা।
আমাকে আর ভালোবাসনা?
-নাহ।
তুমি তো বলেছিলে তোমার ভালোবাসার কোনো শেষ নেই।
.......
চুপ করে আছো কেন অরিন্দম?
.....
অরিন্দম?
হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা অনুভূতি কাঁপিয়ে দিল প্রীতিলতাকে। তার ঘুম ভেঙে গেল। প্রচণ্ড গরমের রাতে এই অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি কেন হলো বুঝতে পারছেনা সে। ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাতেই অরিন্দমের কথা মনে পড়লো। কেউ কেউ বলে সিলিং ফ্যানের সাথে সে ফাঁস নিয়েছিলো যদিও তার পরিবারপরিজনের কেউ স্বীকার করেনি। এক লাফে উঠে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করে দিল প্রীতিলতা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:২৮