somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : দুঃখবোধের দহন

১৪ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঠিক একঘন্টা দশ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড ধরে আমি সিলিংয়ের সাথে ঝুলছি। বাসার কেউই অবশ্য এখনো কিচ্ছুটি টের পায়নি, কারণ আমার রুমের দরজা বন্ধ।

জীবিত মানুষেরা বন্ধ দরজার ওপাশে কি হচ্ছে দেখতে পারে না, আমি পারছি। আধা ঘন্টা আগে আম্মু আমার রুমের সামনে এসে নাজু নাজু বলে ডেকে গিয়েছেন আমি স্পষ্ট দেখেছি। কারণ আমি মৃত। ঠিক এক ঘন্টা দশ মিনিট আগে আমি মরে গেছি।

হ্যাঁ সেই জঘন্যতম রেজাল্টটাই আমার আত্মহত্যার পেছনে দায়ী। আমার নাম ছিলো নুসরাত শারমিন নাজলি, আমার একমুঠো স্বপ্ন ছিলো সবার যেমন থাকে। আমিও একডালি ইচ্ছের ফানুস উড়িয়েছিলাম সবাই যেমন উড়ায়। আজকে দুপুরে বুঝেছিলাম আমার স্বপ্নগুলি ভেঙে চুরমার হয়েছে, আমি এ প্লাস পাইনি।

শুনেছি আমার বান্ধবীরা সবাই এ প্লাস পেয়েছে। নাসরিন, দুর্বা এমনকি নিয়মিত ক্লাস ফাঁকি দেয়া আফরিন ও জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। কিন্তু আমার সাথেই কেন এমন হলো?
আমার রেজাল্টে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন আমার আম্মু। রেজাল্ট শুনে অনেক্ষণ আমার সাথে কথা বলেন নি। কেনইবা বলবেন? এতো পড়াশোনা করেও আমি এ প্লাস পাইনি। অথচ আমার জিপিএ ফাইভ পাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিলো। এমন রেজাল্ট আমি কল্পনাও করিনি, হায় নিয়তি!

মারা যাওয়ার পর আমি এক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম, আমি এখন যখন যেভাবে ইচ্ছা যেতে পারছি। আমার শরীর এখন অনেক হালকা - ঠিক যেন বাতাসের মতো।
আমার রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে এলাম। আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দা বেশ বড়, গরমের দিনেও দখিনা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে। এ মুহূর্তে আব্বু -আম্মু দুজনেই বারান্দায় বসে কি যেন গুজুরগুজুর করছেন, আমি কাছে গেলাম আশ্চর্য তারা কেউই আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি তাদের আরো কাছে এসে গেলাম।

- মেয়েটা দুপুর থেকে কিছুই খায়নি রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে, কি মুশকিলে পড়া গেল।
আম্মুর গলায় উদ্বেগ।

- তুমি আবার কিছু বলেছ নাকি? আচ্ছা ওকে ডেকে আনো, আজকে বাবা মেয়ে একসাথে বসে ভাত খাব। আর ওর ড্রেসটা বের কর।
আব্বু আদুরে গলায় বললেন।

আমার আব্বু আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন বলছি কারণ এখন তিনি চাইলেও আমাকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবেন না, খুনসুটি করে বলবেন না বুড়িমা আমার চুলগুলি টেনে দেতো। তার সব আদরের জাল নিষ্ঠুরের মতো ছিঁড়ে ফেলে আমি চলে এসেছি না ফেরার দেশে।

ছোটবেলায় আমি আব্বুর ন্যাওটা ছিলাম, সারাক্ষণ তাকে জালাতাম। রাতে তার পাশে না ঘুমালে মনে হতো আমার ঘুম হয়নি। গভীর রাতে যখন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠেছি তখন তিনি পরম নির্ভরতার হাত দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতেন, সেই পরম প্রশান্তির হাত মৃত্যুর আগমূহুর্ত পর্যন্ত আব্বু ধরেছিলেন।

আম্মু কি যেন বের করলেন আলমারি থেকে। হুম চিনতে পেরেছি আমার নতুন ড্রেস। আমি বায়না ধরেছিলাম জিপিএ ফাইভ পেলে আমার পছন্দের এই ড্রেসটা কিনে দিতে হবে। কি আশ্চর্য আমি তো এ প্লাস পাইনি, তারপরও আব্বু কিনে এনেছেন। আমি চোখের পানি আটকে রাখতে পারলাম না। এ গ্রেড পাওয়ার পর ভেবেছিলাম আব্বু অনেক রাগ করবেন। কিন্তু তিনি আমার পছন্দের পোশাক কিনে এনেছেন!

আম্মু যদি আমার মারা যাওয়ার জানতে পারেন তাহলে কি করবেন কে জানে? একবার শৈশবে হারিয়ে গিয়েছিলাম, আমাকে না পেয়ে আম্মু নাকি তিনদিন ভাত মুখে দেননি। সারাক্ষণ কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। এইতো সেদিন প্রথমবার রক্ত দেখে কি ভয়টা পেয়েছি, কিন্তু আম্মু কি আদর করে সব শেখালেন। আমার প্রতিটি দুঃখ আম্মুকে দুঃখ দিত, আমার হাসিমুখ তিনি প্রাণভরে উপভোগ করতেন।

টুংটাং। আমাদের বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো, কে যেন এসেছে দরজায়। আম্মু এগিয়ে খুলে দিলেন দরজা। একি আমার বান্ধবীরা সব উপস্থিত! মাহি, দুর্বা আফরিন সবাই আমাদের বাসায়, আমার সাথে বোধহয় দেখা করতে এসেছে। ড্রয়িং রুমে বসলো সবাই। আমিও ওদের সাথে বসে গেলাম। আমার কান্না পাচ্ছে কারণ ওরা কেউই আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বামপাশে সোফায় চিকন মেয়েটি দুর্বা। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওকে নিয়ে কতদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি! সোনালী বিকেলে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়িয়েছি কতদূর!

ওরা সবাই মিলে কি যেন প্লান করছে। আমি আরেকটু কাছে গেলাম। আমার জন্মদিনে এবার ওরা কি গিফট দেবে সেটা নিয়েই আলাপ চলছিল। ওরা নাকি আমাকে কি সারপ্রাইজ দেবে।

এই ঘরে এখন যারা আছে তারা সবাই আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু আমি এদের সবার ভালোবাসার শক্ত হাতকে উপেক্ষা করেছি, চলে গেছি অনেক দূরে।
জানি আজকের বিকেলটাও অনেক সুন্দর হবে। উথালপাথাল জোছনায় ভেসে যাবে রাতগুলো। ভোরের পাখিরা শত সহস্র বছর কোলাহল করে যাবে। শুধু আমিই থাকবো না এই সুন্দর পৃথিবীতে।

আমি নুসরাত শারমিন নাজলি। আমি এ প্লাস পাইনি, আমি আত্মহত্যা করেছি একঘন্টা দশ মিনিট আগে।
( গল্পটি তাদেরকে সঁপে দিলাম যারা আনন্দময় জীবনকে তুচ্ছ পরীক্ষার ফলাফলের কাছে বিসর্জন দিতে চায়)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

Testimony of Sixty- By Edward Kennedy বাংলাদেশের রক্তাক্ত সত্যের এক আন্তর্জাতিক স্বীকারোক্তি

লিখেছেন কিরকুট, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৩




১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর বৈপরীত্যের বছর। এটি যেমন ছিল অন্ধকার ও রক্তাক্ত, তেমনি ছিল সত্যের প্রতি অবিচল এক সময়কাল। এই বছরের গণহত্যা, শরণার্থী স্রোত ও মানবিক বিপর্যয়ের বিবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×