ওদের গাঁয়ের নাম চরকান্দা। সীমান্তবর্তী নদী মহানন্দার কোল ঘেঁষে এর অবস্থান।বাংলাদেশের অন্য আট দশটা গ্রামের মতোই দারিদ্রের ছাপ সর্বত্র । কিশোরী মেয়ের বেণির মতো সরু নদী মহানন্দা কিন্তু প্রচণ্ড খরস্রোতা । গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর একমাত্র অবলম্বন ওই নদী। আবহমানকাল কাল ধরে মমতাময়ী মহানন্দা ওদের জড়িয়ে আছে পরম আদরে। বছরের পর বছর খরস্রোতা নদীর তীব্র স্রোতে ভেসে আসে অসংখ্য পাথর। সেই পাথর নদী থেকে বাজারে বিক্রি করে রুটি রুজির জোগান দেয় এরা।
গাঁয়ের লোকজন যখন নদী থেকে পাথর উঠায়, তখন সেগুলো আর পাথর থাকেনা। একেকটি টুকরো তখন হয়ে ওঠে প্রত্যেকটি মানুষের পেটের দানা...একেকটি বেঁচে থাকার আশ্রয়।
আবেদ আলির মা বলতেন ,এই নদী আমাদের মা । নদীটার দিলডা অনেক বড় রে । সে ছো্ট বেলায় বুঝতো না নদীর আবার দিল থাকে নাকি ? ওর আম্মা সালেহা মাঝে মাঝেই এমনই অদ্ভুত কথা বলতেন । সে মা একদিন রাতে বলা নেই কওয়া নেই- আচমকা মরে গেলেন। আবেদ বুঝ হয়ে তার বাবাকে দেখেনি ,মায়ের মুখে শুনেছে বাবা নাকি ঢাকা গিয়ে আর ফিরে আসে নি । সেই থেকে মাই সংসার দেখাশুনা করত ,সংসার বলতে আবেদ আলি আর পাঁচ বছর বয়সী ছো্ট বোন ফাতেমা । এই তিনজনের ছোট্ট সংসার । কিন্তু আবেদ আলির মাত্র তের বছর বয়সে তার মা সালেহা খাতুন চলে গেলেন না ফেরার দেশে , পেছনে ফেলে গেলেন আবেদ আর ফাতেমাকে ।
সালেহা যেদিন মারা গেলেন তার পরদিন সকাল থেকেই আবেদ আলি মহানন্দায় পাথর তুলতে বেরিয়ে পড়লো।জগতের সব কষ্টের মধ্যে সবচেয়ে অসহনীয় কষ্ট হলো পেটের কষ্ট ।মায়ের মৃত্যুর সব শোক ম্লান করে দিলো পেটের দায় ।শুরু হলো সংগ্রামী জীবন । মা সালেহা মারা গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আসলেই মহানন্দা মমতাময়ী মা এটা ওদের পেটের দানার যোগান দেয় ।
আজ আচমকা সেই দানায় ভাগ বসাতে এসেছে দখলদার বাহিনী। গত ক'দিন আগে এক দুপুরবেলা বিনা নোটিশেই ভারতীয় বিএসএফ অবৈধভাবে দখল করেছে মহানন্দাকে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে নিরন্তর খেটে চলা মানুষগুলোর একমাত্র স্বপ্নকে কেড়ে নিতে চায় পাষণ্ডের দল। তাই নদী থেকে পাথর উঠানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ওরা।
মহানন্দা ওদের কাছে মায়ের মতন। গাঁয়ের প্রতিটি অধিবাসীর ছেলেবেলা কেটেছে নদীতীরে খেলা করে, শৈশবের উচ্ছল বসন্তগুলো পার হয়েছে নদীর বুকে সাঁতার কেটে। মহানন্দার সাথে ওদের সখ্যতা বহুদিনের।কতো রোদমাখা দুপুর,পড়ন্ত বিকেল অনায়াসে কাটিয়ে দিয়েছে শীতল পানিতে গা জুড়িয়ে । কিন্তু আজ কোন স্বার্থপর গোষ্ঠী ওদের পেটের ভাত কেড়ে নিতে চায়? ওদের সর্বশান্ত করতে চায়? আর আবেদ আলিসহ গাঁয়ের অন্যান্য লোকজন এমন অন্যায্য দাবি মানবে কেন? তাই একরকম দুঃসাহস দেখিয়ে ওরা আবার নামে মহানন্দায়। নিষেধাজ্ঞার তিন - চারদিন পরেই আবেদ আলি, মতি ফকরুলরা আবার পাথর তুলতে নামে। চিরচেনা ঠাণ্ডা জল ওদের কেমন নেশা ধরিয়ে দেয়। মন ভরে ওরা পাথর তুলে যায়।
হঠাৎ সামনে থেকে আওয়াজ ভেসে আসে - " হল্ট! রোখ যাও, গোলি মার দোংগা "। আবেদ আলিরা অবাক চোখে সামনে তাকায়, নিষ্পাপ চোখগুলোতে লেপ্টে আছে ভয়ের কালোছায়া।একদল বিএসএফ মেশিনগানের নল তাক করে আছে ওদের দিকে ।সীমান্তবর্তী লোক , বিএসএফের সাথে ওদের ভাই বন্ধুর সম্পর্ক । শৈশবে কতবার যে খেলতে খেলতে ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই কিন্তু কখনো তো এমন কঠোর ব্যবহার করেনি তারা । আজ ওদের চোখে খুনের নেশা কেন ।
জেলেপাড়ার মতি যেন কিছুই শোনেনি। আরো পাথর তোলার নেশায় এগিয়ে যায় সে। ঠিক সে সময় ঘটে নৃশংস ঘটনাটি। সামনে নদীর তীরে মেশিনগান তাক করে থাকা বিএসএফ হায়েনারা একযোগে গুলি চালায় মতিনকে টার্গেট করে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার দেহ। তাজা রক্তে লাল হয়ে ওঠে মহানন্দার শীতল পানি । ওরা ভয়ার্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মতি ওদের সবার বাল্যবন্ধু। একসাথে একই পাড়ায় বড় হয়েছে সবাই। আজ চোখের সামনে এভাবে খুন হতে দেখে দিশা হারিয়ে ফেলল সে। রাতেই প্রচণ্ড জ্বর ওঠে আবেদ আলির।
মতি খুন হওয়ার হপ্তা তিনেক পরের ঘটনা। সবার ঘরেই ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে অভাব। এই নদী ছিলো ওদের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ওই ঘটনার পর কেউ আর সেখানে পা বাড়ায়নি। সারা গাঁ শোকে স্তব্ধ। যেন এক অশুভ প্রেতাত্মা ভর করেছে চর জুড়ে। আবেদ আলির ঘরেও একমুঠো চাল নেই। মা - বাপ হারা আদরের বোনটির দিকে তাকিয়ে সে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে । আবার যাবে সে মহানন্দায়। ওদের পাড়ার ফকরুদ্দি, কান্দিবাড়ির ফজু আর বিক্রমও ওর সাথে যেতে রাজি হয়। এতদিনের প্রিয় নদী যেন ওদের চুম্বনের মতোন টানে। যে টান অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ওদের নেই। কিন্তু বাঁধ সাধে ফাতেমা। কোন মতেই সে যেতে দেবে না ভাইকে। কাঁদো কাঁদো গলায় মিনতি করে " ভাইজান তোমা মহানন্দায় নামবেন নাকো। "
" আইজ আমারে বাঁধা দিস না ফাতেমা। ঘরে এক ছটাক চাইল নাই, মহানন্দা মোরে ডাকতেছে, মোরে থামাইছ না। "
"মতির রক্ত এখনো মহানন্দা হতি মোছে নাই। "
"মহানন্দায় রক্তের দাগ থাকেরে। একদিন গুলি হয়েছে বইলা পত্যেক দিন হবে? " জোরের সাথে কথাগুলো বলে দ্রুত বেরিয়ে যায় আবেদ আলি। ওদিকে ফাতেমা চিন্তায় অস্থির। সে খোদার কাছে অনবরত প্রার্থনা করে '- যেন তার ভাইটা সুস্থ দেহে ফিরে আসে।
আসলে মতির মৃত্যু ফাতেমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে ।সেদিন দুপুরের কথা মনে আছে তার , মাত্র গোসল করে ফাতেমা রোদে বসে চুল শুকোচ্ছিলো ,ঠিক সে সময় গুলির শব্দটা শুনতে পায় ।গুলির আওয়াজের সাথে সাথে যেন গাছের পাখিগুলো সরসর করে উড়ে গেল। গাছের পাতায় কিসের কাঁপন ,পুরো পরিবেশে যেন অশুভ কিছু আছর করেছে । .সেদিন সন্ধ্যায় হতভাগা মতির লাশ বিএসএফ দিয়ে যায় চরে ।
দুপুরের দিকে আবেদ আলি হাসিমুখ নিয়ে ঘরে ফেরে। ওর চোখজোড়ায় খুশির বন্যা। বহুদিন পর সেই চিরচেনা পানিতে শরীর জুড়াতে পেরে মহাখুশি। চোখেমুখে চরম উত্তেজনা।
"দেখছ ফাতেমা। খালি খালি ভয় খাইছ। আইজ ত পাথর আনলাম কিছু হইছে? "
তার আনন্দ দেখে ফাতেমা ও আনন্দিত। ওদের আবার সুদিন ফিরে আসবে। দুমুঠো অন্ন জুটবে পেটে।
পরদিন সাত সকালে বিছানায় শুয়েই ফাতেমা দেখল মানুষটা যায় মহানন্দার দিকে। আজ আর বাঁধা দেয় না ফাতেমা। কাল যখন কিছু হয় নাই আজও কিছু হবেনা। সে শুয়ে শুয়ে ভাবে আজ তার ভাইয়ের জন্য পায়েস রাঁধবে। আবেদ আলি পায়েস বড়ই পছন্দ করে।ঘরে অল্প আতপ চাল আছে। দুদুর মার কাছ থেকে আধা সের দুধ এনে চাল বসিয়ে দেয় চুলায়। এতদিন তো পেটের ভাতই জোটেনি, আবার পায়েস।
পানি বলক মারতে শুরু করেছে, চালও ফুটছে ।এখন সন্ধ্যা ।কিছুক্ষণের মধ্যেই আবেদ আলি এসে পড়বে পাথর বিক্রি করে ।ঠিক তখনই একটা গুলির শব্দ ভেসে আসল দূরে কোথাও। চমকে ওঠে সে । না না না এসব কি ভাবছে । গুলি হবে কেন !ওসব মনের কল্পনা ।আচমকা অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পায় ।সেই সঙ্গে হাহাকার জড়ানো কোলাহল ।গাছের পাখিগুলো যেন সর্সর্ করে উড়ে গেল ।গাছের পাতায় কিসের কাঁপন ।মতি মারা যাওয়ার দিন এমন হয়েছিল।আচ্ছা সন্ধ্যাবেলা তো সব পাখি ঘরে ফেরে ।. ভাই জীবিত ফিরে আসবে কি ?
বাহ কি সুন্দর ঘ্রাণ বেরিয়েছে পায়েসের। ভারী পায়ের শব্দ আরো কাছে এসেছে । ফাতেমা এড়াতে চায় এই অশুভ আওয়াজ। আবার লাকড়ি ঢুকিয়ে দেয় চুলায়। আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে রান্নায়। পায়েসের ঘ্রাণ ভেসে চলে...রক্তে লাল হয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর কোল ঘেঁষে...দূরে আরও বহুদূরে ।
ছবিঃ মহানন্দা নদী থেকে পাথর তোলার দৃশ্য ।
ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬