তাহের মিয়া রোগা মানুষ। গায়ে গতরে খেটে পরিবার চালানোর সাধ্য নেই। দুদিন পর পর অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় পরে থাকতে হয়। অসহায় স্ত্রী এ বাড়ি ও বাড়ি দৌড়ে যতটুকু সম্ভব পরিবারের জন্য করে। এক বেলা খায় তো দু বেলা খাবার জোটেনা। ছেলে মেয়েদের স্কুলের খরচও চালানো যাচ্ছে না কোন মতে। পরিবারের একমাত্র উপার্যনকারী ব্যাক্তি যখন আর কর্মক্ষম থাকে না, তখন সেই পরিবারের দুর্গতি কেমন হয় সেটা বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। যে ঘটনাটা বললাম সেটা ১৮ বছর আগের কথা। এখন তাহের মিয়া লাখপতি। ৫০-৬০ লাখ টাকার মালিক। এই অসাধ্য সাধন করেছে তার স্ত্রী আমেনা। কিভাবে, সে কথাগুলোই বলবো।
দুঃখের মেঘ যখন পরিবারের উপর থেকে কোনভাবেই সরছে না, ঠিক সেই সময় “গ্রামীন ব্যাংক” নামক সুর্যটি মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। বহু দিন পর একটু আলোর দেখা পেলো তাহের মিয়ার পরিবার। তার স্ত্রী আমেনা কার মাধ্যমে যেন জানতে পারলো, এলাকায় নতুন একটা ব্যাংক এসেছে যেটা শুধুমাত্র গরীব মহিলাদের নিয়ে কাজ করে। গরিবদের ঋণ দেয়। টাকা নিতেও কোন জামানত লাগেনা। একথা শোনার পর খোজ নিয়ে দেখলো ঘটনা সত্যি। শুরু হল গ্রামীন ব্যাংকের সাথে আমেনার পথ চলা।
শুরুতে ব্যাংক থেকে ৫০০০ টাকা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দুটো গরু কিনল। তখনও হাল চাষের আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছেনি । গরু দিয়েই জমি চাষ করতে হতো। নিজের কোন জমি ছিলনা বিধায় আমেনা ঠিক করলো গরু দিয়ে টাকার বিনিময়ে অন্যের জমি হাল দিবে সাথে নিজেও ভাগে চাষ করবে। শুরুতে শুধু ধানের জমিই ভাগে চাষ করতো। পরে ভাবলো শুধু ধান কেন, বিভিন্ন শাক সব্জিও তো চাষ করা যায়। নিজের গরু যেহেতু আছে হালের খরচও লাগবে না। ফলে তার লাভ বেশি হবে। ছোট ছেলে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বড় ছেলে কে সাথে নিয়ে কাজে নেমে পরলো। বছর দুয়েক পর হাতে যখন কিছু টাকা জমলো, ঠিক করল ব্যাংক থেকে এবার আরো বেশি টাকা তুলে বাজারে একটা মুদি দোকান দিবে। তাই করল। মুদি দোকান থেকে লাভের টাকা জমিয়ে আরো ঋণ নিয়ে এখন মুদি দোকান ছাড়াও আরো দুটা দোকানের মালিক সে। একটা ওয়ার্কশপ আরেকটা বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দোকান। বর্তমানে আমেনার পরিবার বেশ অবস্থাসম্পন্ন। শধু যে টাকাই উপার্যন করেছে তা না, সাথে তার পরিবারের নিরাপদ স্যানিটেশন, জীবানুমুক্ত মুক্ত পানি এবং পুষ্টির চাহিদাও নিশ্চিত করেছে। সবই সম্ভব হয়েছে গ্রামীন ব্যাংকের সাহাজ্য এবং পরামর্শে।
এটা ছিল গ্রামের একজন আমেনার কাহীনি। এরকম শত শত আমেনার জীবন পাল্টে দিয়েছে এই গ্রামীন ব্যাংক নাম সুর্যটি। নিজের চোখে দেখা ঘটনা বললাম। আজ গ্রামের বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারের অবস্থা পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামীনব্যংক থেকে কখনো টাকা নেয়নি এমন পরিবার খুব কম। যারা নিয়েছে মোটামুটি সবাই এখন দু-বেলা ভাত পেট ভরে খেতে পায়। এমন একটি ঘরও নেই যে ঘরের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায় না। সবাই ঝোপঝাড় ছেড়ে স্যানিটারি লেট্রিন ব্যবহার করে। আমেনাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪ লাখ ছাড়িয়েছে।
এত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে যার মাধ্যমে, তিনি হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস।অথচ আজকের বাংলাদেশে তাকেই সবচেয়ে বেশি হেনস্ত হতে হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে এখন নানা মুনি নানা মত দেয়। সেদিন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বললেন, “গ্রামীণ ব্যাংক কোনো ব্যক্তির বা পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। এ ব্যাংকের বেশির ভাগ বিনিয়োগ সরকারের”। একদম ডাহা মিথ্যা কথা। মাননীয় মন্ত্রী, ব্যাংকটি ৮৪ লক্ষ গ্রামীন মহিলাদের। গ্রামীন ব্যাংক যখন শুরু হয়, তখন সরকার ১ কোটি ৮০ টাকা বিনিয়োগ করেছিল। জন্মের পর সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে আর কোনো টাকা দেয়নি। কিন্তু ব্যাংক তো থেমে নেই। সরকার তার মূলধনের পরিমাণ না বাড়ানোয় কার্যত সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আজ গ্রামীন ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৮৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ৪ কোটি মানুষ ব্যাংকটির সাথে জরিত। ভবিষ্যতে যদি সরকারের মুলধন না বাড়ে, একসময় বিনিয়োগ শুন্যের কোটায় নেমে আসবে।
বুঝে হোক না বুঝে হোক, গ্রামীন ব্যাংককে যারা দোষারোপ করে তাদের প্রথম অভিযোগই হলো গ্রামীন ব্যাংক সুদ বেশি নেয়। কোন ব্যাংক থেকে সুদ বেশি নেয়? এটা কেউ আর খোজার চেষ্টা করে না। অথচ যারা তার ঋণের সরাসরি ভোক্তা, তাদের মুখ থেকে আজ পর্যন্ত গ্রামীন ব্যাংকের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে শুনিনি। সবাই তাকে পীরের মত সম্মান করে।
একবার ড. ইউনুস গেছেন এক গ্রামে। সম্ভবত রংপুরে। হাটছেন, সবার সাথে কথা বলছেন। হঠাত একজন জন মহিলা দৌড়ে এসে স্যারকে জরিয়ে ধরে বলল, আপনি আমাদের জাহান্নাম থেকে বাচালেন স্যার!
স্যার প্রশ্ন করলেন, কিভাবে?
স্যানিটারী লেট্রিনের ব্যাবস্থা করে। আগে ঝোপঝারের আড়ালে দৌড়াতে হতো। পুরুষ দের সমস্যা তেমন হত না কারন তারাতো যেখানে খুশি চাইলেই সেরে নিতে পারত কিন্তু মহিলারা তো সেটা পারত না। এই সম্মানবোধটুকু তাদের আছে। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষ করতে হত। সারা দিন চেপে রেখে সন্ধ্যার পর যা করার করতে হতো। ব্যাপারটা কত কষ্টকর বোধ করি সবাই তা আঁচ করতে পারবেন।এখন মহিলারা যখন খুশি লেট্রিনে যেতে পারে। সেই সমস্যাটা দুর করল গ্রামীন ব্যাংক । তারা শর্ত দিলো ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিবে, প্রত্যেকের বারিতেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন থাকতে হবে এবং ব্যাংক তাতে সাহাজ্য করবে। অল্প খরচে স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরি করার সুযোগ পেল সবাই। গ্রামগন্জে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা চালু করা হল। এসব সামাজিক ব্যাবসার অন্তর্ভুক্ত। এরকম সাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামীন ব্যাংকের অনেক ভুমিকা রয়েছে। আমি বলছি না যে গ্রামীন ব্যাংক একাই সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে। এটি দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে সরকারের পাশাপাশি গ্রামীন ব্যাংক সহায়ক ভুমিকা পালন করছে মাত্র। অর্থাত্ শুরুটা করছে গ্রামীন ব্যাংক। আর সেটিই সবথেকে বেশি প্রয়োজন। কারন সরকারী বা বেসরকারী ব্যাংকগুলো গরীবদের জন্য কাজ করে না বা তাদের কাছে পৌছাতে পারেনা।
সরকার ঠিক কি কারনে ড. ইউনুসের উপর নাখোশ খুব জানতে ইচ্ছা করে।সরকার একদিকে নারীর ক্ষমতায়ানের কথা বলছে অন্যদিকে নারীদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষই গ্রামীন ব্যাংক সম্পর্কে ধারনা না রাখলেও দল ইউনুস কে নিয়ে পছন্দ করেনা বলে সেও করে না। যে আইনে বহাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটি নোবেল পুরষ্কার পেল, সরকার কি এমন ত্রুটি পেল যে ভেঙ্গে ১৯ টুকরা করতে হবে? অনেকেরই হয়তো অজানা, গ্রামীন ব্যাংকই বিশ্বের একমাত্র বেসরকারি ব্যাংক যেটি নোবেল পেয়েছে। আর কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখনও পায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনুস কে হেনস্ত করা মানে নিজেদেরই ছোট করা। গোটা বিশ্বে উনার যে ভাবমুর্তি রয়েছে, হলপ করে বলতে পারি শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া তার ধারে কাছেও নাই। ২০০৮ সালে একটি সরাসরি অনলাইন নির্বাচনে ড. মো: ইউনুস বিশ্বের ১০০ জন শীর্ষ ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে ২য় নির্বাচিত হন। Yunus was voted the second topmost intellectual person in the world ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে যায়। একজন বাঙালী মুসলিম হিসেবে এই সম্মান পাওয়া সোজা কথা না। সর্বশেষ তিনি যে মার্কিন কংগ্রেশনাল এওয়ার্ড টি পেলেন, এ পর্যন্ত বিশ্বে মাত্র ৭ জনের পুরষ্কারটি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। মাইক্রোক্রেডিট এবং সামাজিক ব্যাবসা শব্দ দুটি তার কল্যানেই ডিকশনারিতে অন্তভুক্ত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাইক্রোক্রেডিট, সোসাল বিজনেস নিয়ে পরাশোনা করতে হয়, ড. ইউনুস কে নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। গ্রামীন ব্যাংক বর্তমানে দেশের গন্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
অথচ নিজের দেশে তিনি অবহেলিত। তাকে হয়রানি করার যত রকমের ষরযন্ত্র আছে সরকার এতদিন তা করেছে। এখন ষরযন্ত্র করছে ড. ইউনুসের নিজের হাতে গড়ে তোলা গ্রামীন ব্যাংককে কিভাবে ধ্বংস করা যায়। কিভাবে সোনালী ব্যাংকের মতো লুটের ব্যাংক বানানো যায়। এর ফলাফল কোন ভাবেই ভালো হবে না বরং আওয়ামীলীগ নিজেদেরই ক্ষতি করবে। দেশের মানুষ মোটেও তা পছন্দ করবে না। এমনকি যারা আওয়ামীলিগকে সমর্থন করে তারাও গ্রামীন ব্যাংক ইস্যুতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আরেকজন মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশ কখন পাবে জানি না। যা হচ্ছে খুব খারাপ হচ্ছে।
সরকার চাইলে ড. ইউনুসের ভাবমুর্তিকে কাজে লাগাতে পারত। কিন্তু তারা করছে উল্টাটা। মাননীয় সরকার, ভোটের ব্যাপারটা একটু মাথায় রাখবেন।
শেষ মুহুর্তে গ্রামীন ব্যাংককে গ্রামীন ব্যাংকের মতো চলতে দিয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজগুলোর প্রতি মনোযোগ দিন।এই ব্যাংকের কোন ক্ষতি করা মানে ৮৪ লক্ষ মহিলা এবং ৮৪ লক্ষ পরিবারের ক্ষতি করা। গরীবের সম্পদ বহুত মেরে খাইছেন, এলা ক্ষ্যামা দেন।গ্রামীন মহিলাদেরও আর দুর্বল ভাববেন না। তারা এখন নিজের পায়ে কিভাবে দাড়াতে হয় শিখে গেছে।