somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

প্রজ্জলিত মেশকাত
ব্যক্তিজীবনে অহিংসায় বিশ্বাস করি। বুদ্ধের দর্শন গভীরভাবে ভাবায় আমায়। “আসক্তিই সকল দুঃখের কারণ, অধিকারবোধ থেকেই দুঃখের সৃষ্টি।” এই দুটো বাক্যের উপর অগাধ বিশ্বাস। কারো চিন্তা-চেতনাকেই ছোট করে দেখিনা। আমি বিশ্বাস করি যে মতবাদই হোক, তার গভীরে না ঢ

আমার অনন্ত যুদ্ধ

১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“হেরে যাবো বলেতো আসিনি। ভেসে যাবো বলেতো জোয়ারে ভাসিনি।" আয়ুব বাচ্চুর একটা গানের দুই লাইন। এই গানটা শুনে মেডিকেল লাইফে অনুপ্রেরণা পেতাম। আমাদের নিজস্ব একটা ব্যান্ড ছিলো মরফিয়াস নামে। সেই ব্যান্ডের লিগ্যাসি ক্যাম্পাসে টিকে আছে কিনা জানা নেই। আন্ডারগ্র্যাডের প্রফেশনাল পরীক্ষাগুলো একচান্সে সবগুলো পাশ করি সৌভাগ্যক্রমে। তখনও বাইপোলার ডিপ্রেশন ছিলো। ডিপ্রেশনের কারণে পড়তে পারতাম না অনেক সময়। তাই কখনো কখনো পরীক্ষার দুই একদিন আগে পিসিতে এনএফএস খেলতে বসে যেতাম। পোলাপাইন ঈর্শা থেকে আবার কখনো তাচ্ছিল্য করে বলতো, “তোরতো সব পড়া শেষ তাই খেলতে বসছিস। আর আমরা চোখে সর্ষে ফুল দেখতেছি।“ আমি হতাশার হাসি হাসতাম। ওদেরকে বোঝাতে পারতাম না কতোটা ডিপ্রেশনে ভোগার জন্যে আমি পড়া ছেড়ে পিসি নিয়ে বসেছি। শেষ পর্যন্ত পাশ করে যেতাম। আর ওরা ভাবতো আমি ব্রিলিয়ান্ট। আসলে মোটেও তা নয়। দেখা যেতো পুরো মোটিভেশন আসতো পরীক্ষার আগের রাতে। তখন সারারাত ধরে পড়তাম। তারপর দুই একঘন্টা শুয়ে থেকে পরীক্ষা দিয়ে চলে যেতাম। আমি বুঝতাম আমার বাইপোলার ডিপ্রেশন হয়তো বিসিএস পর্যন্ত পার করতে দিবে কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভুগাবে।

যেমনটা ভেবেছিলাম তাই হলো। বিসিএস হলো। কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে পাঁচ পাঁচবার একটা ভিন্ন ঘরানার সাবজেক্টে এফসিপিএস দেওয়ার পরও অল্প অল্পের জন্যে একবারো হলোনা। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যায়। আমার ডিসর্ডার জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল। মৃত বন্ধু সোহাগ স্বপ্নে প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে আসতো, এখনো আসে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় সোহাগকে নিয়ে আমার ডিলুউশন আর হ্যালুসিনেশন হতে লাগলো। আমি রাতে ঘুমাতাম। ঘুম ঠিকভাবে হতোনা। আর সকালে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যাওয়ার মতো শক্তি পর্যন্ত থাকতোনা। সরকারি চাকরি। তাই কোনভাবে চলে যেতে থাকলো। প্রাইভেট জব হলে নেহাতই চলে যেতো। আমি ন্যায়পরায়ণ মানুষ। বিছানায় শুয়ে থেকে রাষ্ট্রের বেতন নেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার কখনো ছিলোনা। কিন্তু কিছু করার রাস্তা নেই। আসতে আসতে নিজের শরীর মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আউটডোরে বসতে লাগলাম। অনেকটা সময় চলে গেলো। এরপর দুইবার এমএসে ব্যর্থ হয়ে সবশেষ ভালো একটা সাবজেক্টে পোস্ট গ্র্যাড ডিপ্লোমাতে চান্স পেলাম।

কোর্সের দিনগুলো সবমিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিলো। আমি রোগাক্রান্ত হলেও একাডেমিক মানুষ। রোগীর কাজ করতে দেহ মনের সাথে যুদ্ধ করে সম্পন্ন করতাম। ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্টে আমি সবচেয়ে বেশি অ্যাক্টিভ থাকতাম। সবসময় একটা বিষয়ই মাথায় কাজ করতো যে আমার অবহেলার কারণে বা আমার ভুলের জন্যে একটা রোগী মারা গেলে কোনদিন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। রোগীদের ভালবাসাও পেলাম অনেক। এই অনুভূতিটা স্বর্গীয়। অনেকের অনেক দোয়া পেলাম। একবার একরোগী একঝুড়ি ফল কিনে এনেছে আমার জন্যে প্রফেসরের রাউন্ডে থাকা অবস্থায়। আমিতো কোনভাবেই নিবোনা। রীতিমতো রাগারাগি করছিলাম আর লজ্জা পাচ্ছিলাম। তখন আমার স্যারই আমাকে নিতে অনুরোধ করলেন। বললেন কেউ ভালোবেসে কিছু নিয়ে আসলে আল্লাহর রাসূল(সাঃ) ফিরিয়ে দিতেন না। এই ভালোবাসা তুমি অর্জন করেছো। কেস প্রেজেন্টেশনগুলো বেশ ভালো হতে লাগলো। কিন্তু আমি জানতাম কোন না কোন সময় আমি ক্র্যাশ করবো। আমার ডিসর্ডার আমাকে আটকে দিবে। তেমনই ঘটলো। কোভিডের আক্রমণে চিকিৎসা আর একাডেমিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লো। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন সব বন্ধ হয়ে গেলো। প্রফেসররা হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দিলো কোভিডের ভয়ে। সবকাজ আমরা জুনিয়র ডাক্তাররা করতে লাগলাম। ওটিও একদম কমে গেলো। কাজ শেখা বন্ধ হয়ে গেলো। মাঝখানে কিছুটা শুরু হলেও সেকেন্ড ওয়েভে সব শেষ হয়ে গেল।

আমার পড়াশুনা সব লাটে উঠলো। তারমধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা ছিলো ডমেস্টিক ভায়োলেন্স। যার স্বীকার আমি নিজেই। তাইরে নাইরে করে কোর্সটা শেষ হয়ে গেলো। সবমিলিয়ে চারবার পরীক্ষা হয়ে গেল। এরমধ্যে দুইবার রিটেনে বসেছি। প্রচন্ডতম ডিপ্রেশন আমাকে ভাইবা আর ক্লিনিক্যালে বসতে দেয়নি একবারো। একবার ফর্মফিলাপের টাকা শেষ তারিখের পরের দিন জমা দেওয়াতে ফর্ম ফিলাপ করতে পারিনি। আরেকবার সারারাত পড়ার পর সকালে মনে হলো এই প্রস্তুতিতে রিটেন পাশ হবেনা। উল্লেখ্য যে আন্ডারগ্র্যাডের রিটেন আর পোস্ট গ্র্যাডের রিটেনের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। আন্ডারগ্র্যাডে সব উত্তর দিয়ে আসলেই পাশ। কিন্তু পোস্ট গ্র্যাডের রিটেন প্রশ্ন তৈরিই করা হয় ফেল করার জন্যে। যাইহোক প্রিপারেশন যথাযথ থাকলে পাশ হয়ে যায়। কিন্তু সেখানেই ঘাটতি। আমার জীবনের সবকিছুর দ্বায়িত্ব আমার। কোভিডের জন্যে আমার পড়াশুনা থেমে থাকলেওতো অন্যদের থেমে থাকেনি। আমি দুইবার কোভিড আক্রান্ত হই। দ্বিতীয়বার কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হই। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রিটিক্যাল লেভেলে কমে যায়। বেঁচে যাই কিন্তু দাগ থেকে যায়। কোভিড নিউমোনিয়ার পর ডিপ্রেশন জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায়। সকাল সন্ধ্যা দুই বেলা না হলেও অন্ততঃ একবেলা দৌঁড়াতাম। সেটা আর পেরে উঠিনা। প্রায় ছয়মাস কিছুই মনে রাখতে পারতাম না। এক্কেবারে কিচ্ছুনা। লিখে লিখে রাখতাম। কার সাথে ফোনে কথা বলছি তাও মনে থাকতোনা। পুরো মেমরি রিকভার করতে একবছরের বেশি সময় লেগে যায়।

তবু এখনও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পাশ করার স্বপ্ন দেখে যাই। জানিনা পারবো কিন। চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগে থেকেই সব পড়ে রাখার চেষ্টা করছি যাতে পরীক্ষার সময় চাপ কম পড়ে। পরীক্ষার সময় চাপ বেশি নিলে বাইপোলার ডিপ্রেশন ট্রিগার্ড হয়ে যায়। আর একবার একটা এপিসোড শুরু হয়ে গেলে সেটা থেকে বের হয়ে আসা অনেকটা সময়ের ব্যপার। ততোদিনে পরীক্ষা শেষ। আর ফেল নিশ্চিত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এই অস্তিত্ব বহন করাটায় আমার জন্যে কষ্টের হয়ে যায়। তখন মাথার মধ্যে আত্বহত্যার চিন্তা ভর করে। প্রচন্ড রাগ হয় স্রষ্টার উপর আর নিজের উপর। নিজেকে এইভেবে স্বান্ত্বনা দেই যে আমার মেডিকেলের চারজন আর স্কুলের তিনজন মিলিয়ে মোট সাতজন বন্ধু এরই মধ্যে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা গেছে। আমি বেঁচেতো আছি। আর কিছু মানুষের জন্যে কিছুতো করতে পারছি। এটাই কম কিসের?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৪২
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×