somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিনেমালোচনাঃ "পাই" - ড্যারেন এরোনফস্কি

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





আমার শখ যদিও নেহাত কম না তবুও এর মধ্যে একটির উল্লেখ অন্যগুলোর চেয়ে একটু গাঢ় ভাবেই করতে হবে যেটা হচ্ছে মনস্তত্ব বিশ্লেষন। সাইকোলজি জিনিসটা আমাকে ভয়াবহভাবে আকর্ষণ করে।এমনিতে মানুষ হিসাবে কমিউনিক্যাটিভ না হওয়ার কারণে সাইকোলজি স্টাডি'র জন্য আমাকে প্রায়শই দ্বারস্থ হতে হয় সাহিত্য ও শিল্পের কাছে। সেই জায়গা থেকেই সিনেমা দেখাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ খুব। নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি যে সিনেমা কেন দেখি? সময় কাটানো? বিনোদন? শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তে আসা গেছে তা হল সেই সাইকোলজি। সিনেমা আমাকে বিনোদন দেয় কিন্তু মূলত সেটা হচ্ছে একটি নতুন সাইকোলজি'র মুখোমুখি দাঁড়ানো! আমি সিনেমা দেখতে দেখতে পরিচালকের সাইকোলজি'র সামনে দাঁড়াই। খুব কম ক্ষেত্রেই অভিভূত হই, তবে যখন হই তখন খুব বেশি ইনভল্ভড হয়ে যাই।

"পাই" সিনেমাটি দেখতে দেখতে আমাকে অনুরূপ অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। এই সিনেমার পরিচালক হচ্ছেন ড্যারেন এরোনফস্কি, যাকে আপনারা "রিকুয়েম ফর এ ড্রিম" ও "রেস্লার" কিংবা হালের "ব্ল্যাক সোয়ান" এর মাধ্যমে ভালো করেই জানেন অথচ তার প্রথম সিনেমা অপেক্ষাকৃত অনালোচিত "পাই" সেরকম ভাবে দেখা হয় নাই অনেকেরই। আমি মনে করি এরোনফস্কি'র জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে তাকে সারাজীবন এমন একটি সিনেমা বানানোর চেষ্টা করতে হবে যেটা "পাই" কে অতিক্রম করবে।

আসেন এইবার পাই এর ভেতরে প্রবেশ করা যাক। পাই এর মোড়কে, দেহে ও আত্মায় শুধু একটা নাম। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র "ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহেন"। সে একজন গণিতজ্ঞ। তার মধ্যে দুইটি জিনিস খুবই প্রকট। একটা হচ্ছে পাগলামী/ইনস্যানিটি, দুই হচ্ছে মেধা/জিনিয়াস! আসলে ইনস্যানিটি ও জিনিয়াস বিষয় দুটি এতোটাই ইন্টার-রিলেটেড যে এদের সহাবস্থান মেনে নেওয়া যতোটা সহজ বিপরীতাবস্থান মেনে নেওয়া তারচেয়ে অনেকগুন কঠিন। তো যাই হোক, ম্যাক্স বসবাস করে কয়েকটি হাই টেকনিক্যাল কম্পিউটারের সাথে। সে ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, যেটা তার দরজায় তিনটি লক থেকে বোঝা যায়। প্রথম দৃশ্যেই সে বলে "আমার মা আমাকে সূর্যের তাকাতে নিষেধ করেছিলো। তাই আমি ছয় বছর বয়সে তাকিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিলেন আমি কখনোই আর দেখতে পারবো না। তারপর ব্যান্ডেজের ভেতর দিয়ে আমি আস্তে আস্তে আলো দেখতে পেলাম। সেটা ছিলো প্রথম দিন যেদিন আমার মাথাব্যাথা হয়েছিলো।" সো, ম্যাক্সের শারীরিক অসুস্থতা হচ্ছে ডিলিরিয়াম এবং ক্রনিক মাথাব্যাথা এবং নোজব্লিডিং (নাক দিয়ে রক্ত ক্ষরণ)। সে কাউকেই বিশ্বাস করে না। তার প্রাথমিক ও চুড়ান্ত বিশ্বাস তিনটি।

১) গণিত হচ্ছে মহাবিশ্বের একমাত্র ও শুদ্ধতম ভাষা।
২) মহাবিশ্ব ও প্রকৃতিকে সংখ্যার মাধ্যমে সঙ্গায়িত করা যায়।
৩) এবং প্রকৃতির সবজায়গাতেই রয়েছে বিন্যাস/প্যাটার্ন।

সে বিশ্বাস করে যদি সংখ্যার মাধ্যমে প্রকৃতির এক্সিস্টিং প্যাটার্নগুলোকে সঠিকভাবে আয়ত্ব/নির্ণয় করা যায় এবং ক্যাওস থিওরিকে ব্রেক করা যায় তাহলে যেকোন ঘটনাকে সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব, যেমন - অস্তিত্ব, প্রকৃতি কিংবা আরো সহজ উদাহরনের কথা বললে স্টক মার্কেট।
ক্যাওস থিওরি সহজাত সংজ্ঞায় অনেকটা এরকম- "the study of iterative non-linear systems in which arbitrarily small variations in initial conditions become magnified over time" ।

আগেই বলেছি সে প্রচুর নিরাপত্তাহীনতায় ও অবিশ্বাসে ভোগে। তাই মানুষ ও সমাজ এড়িয়ে চলতেই সে আগ্রহী। তার এপার্টমেন্টে দেবী নামে একজন ভারতীয় তরুণী থাকে যে তার জন্য খাবার নিয়ে যায় এবং আগ্রহ প্রকাশ করে তাকে সে এড়িয়ে চলে। তার একমাত্র বিশ্বস্ত ব্যাক্তি হচ্ছে তার পৌঢ় শিক্ষক সল। ম্যাক্স প্রোগ্রাম ডেভেলাপ করে, নিরীক্ষা করে এবং ২১৬ ডিজিটের একটি বাগ এসে তার ফলাফলকে হত্যা করে। ২১৬ ডিজিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর/উপাদান এই সিনেমায়। এই পর্যায়ে চলে আসে এই সিনেমার পঞ্চম চরিত্রের কথা- লেনি মেয়ার। লেনি হচ্ছে একজন সংখ্যাবিদ যে হাসিডিক ইহুদী। হাসিডিক ইহুদী হচ্ছে তারা যারা খুবই ধার্মিক এবং মোস আইনকানুন এর প্র্যাক্টিস করে।এদের উৎপত্তি মুলত ১৮০০ শতাব্দীর মধ্যপরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপের পিয়েস্টিক আন্দোলনের সময়। পিয়েস্টিক আন্দোলন হচ্ছে অর্থোডক্স ইহুদীর ধর্মসংক্রান্ত একটি প্রচার ও চলন। তো লেনির ম্যাক্সের সাথে একটি বারে দেখা হয়। সে বলে এখন ইহুদীদের জন্য একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তারা মনে করে ইশ্বর “তোরা” মাধ্যমে তাদের প্রকৃতির রহস্যের সূত্র দিয়ে গ্যাছেন। “তোরা”(torah) মোসবুকের পাঁচটি অংশকে নির্দেশ করে। ইহুদী বাইবেলের প্রথম তিনটি অংশকে তোরা বলা হয়। কিছু ইহুদী স্কলার মনে করেন ইশ্বরের নামটি ২১৬ ডিজিটের যা তোরায় সাংকেতিক ভাবে উল্লেখ করা আছে। এই নামটি উদ্ধার করতে পারলেই প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন সম্ভব। একটি দৃশ্যে লেনি যখন ম্যাক্সকে হিব্রু ভাষায় পিতা ও মাতা এই দুটি মিলিত অক্ষরমান যা হচ্ছে ৪৪ সেটাকে শিশু শব্দটির অক্ষরমানের সমান বলে দেখায় তখন দর্শকের এই অনুসিদ্ধান্তের প্রতি কিছুটা আস্থা তৈরি হয়। আর ম্যাক্স তখন বিভ্রান্ত হয়। লেনি তাকে নিয়ে যায় হাসিডিক জিউদের রহস্যঘেরা জগতে।

এই সিনেমার ষষ্ঠ চরিত্র হচ্ছে একজন ওয়াল স্ট্রিট বিশ্লেষনকারী “মার্সি”।সে ম্যাক্সকে নিয়োগ করতে আগ্রহী। কারণ ম্যাক্সের কিছু অনুমান সত্য হয়েছে এবং তার মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখতে পেরেছে সে। যে চরিত্রটির কথা স্কিপ করা হয়েছে সেটা হচ্ছে ম্যাক্সের এপার্টমেন্টের একটি ছোট্ট মেয়ে, যাকে ম্যাক্স তার গণিতের দক্ষতা দেখাতে পছন্দ করত। বহির্জগতের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো একমাত্র এই মেয়েটি।

ম্যাক্স সময়ের সাথে সাথে আরো টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ে। স্নায়বিক চাপ, প্রোগ্রামের ব্যর্থতা, মাথাব্যাথা, শারীরিক ব্রেকডাউন সব মিলিয়ে সে একটি প্রচণ্ড অস্থিতিশীল অবস্থায় আপতিত হয়। তার পাগলামী বাড়তে থাকে। ডিলিরিয়ামের সময় সে তার বহির্জগতের পরিচিত মানুষদের মুখোমুখি হয়। সব মিলিয়ে সিনেমার এই সময়টুকু দর্শকের স্নায়ুর উপর অসহনীয় চাপ ফেলে। এক ধরনের প্যারানয়া সৃষ্টি করে।

এই সিনেমার টেকনিক্যালিটি নিয়ে অনেকেই নাক সিটকাবেন। পুরো সিনেমা চিত্রায়িত হয়েছে একধরনের অসুস্থ, রিপালসিভ হাই-কন্ট্রাস্ট সাদা-কালোয়। ম্যাক্সের সাইকোলজির সাথে পরিচালক কোন স্যাক্রিফাইস করেন নাই। সাউন্ড এডিটিং ও ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর-এ বেশি বৈচিত্র নাই কিন্তু যথেষ্ট সাসপেন্স ও ইন্টিউশান আছে। কিছু কিছু দৃশ্যে ক্যামেরার র মুভমেন্ট উপভোগ্য। আমার মতে টেকনিক্যালিটির দিক দিয়ে ইটস এ উইনার!

“পাই” এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক্টিই নাম- শন গিলেট! ম্যাক্স কোহেনের খুবই আনওর্থোডক্স সাইকোলজি ম্যাক্স ফুটিয়েছেন প্রায় নিখুতভাবে। শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা, ইন্স্যানিটি, দ্বিধা ও অন্যান্য বৈপরীত্য প্রায় প্রতিটি অভিব্যাক্তিতে ফুটে উঠেছে এইখানে।তার অভিনয় ছিলো ডিস্টার্বিং, ডিসকন্সার্টিং, প্যারানয়েড এবং অফকোর্স ব্রিলিয়ান্ট! আমার অল টাইম ফ্যাভারেট চরিত্রের মধ্যে অবশ্যই একটি! অন্যান্যদের মধ্যে লেনি মেয়ারের চরিত্রে বেন শ্যাঙ্কমেন এর আন্ডার প্লে ভালো লেগেছে।

ড্যারেন এরোনফস্কি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলব না।আমি শুধু অপেক্ষায় আছি কবে সে পাই কে অতিক্রম করবে! এ জেম অফ আ রাইটিং, এ জেম অফ আ ডিরেকশান!

পাই আমাদের নিয়ে যায় গণিত ও পদার্থবিদ্যার মিশেলে একটি রহস্যময় জগতে। অনেকটা আত্মানুসন্ধান চলে দর্শকদের মনে। আমাদের চারপাশের প্রকৃতির দিকে একটু অন্যচোখে তাকাতে উৎসাহী করে। অনেকেই এটাকে সায়েন্স ফিকশান থ্রিলার বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আমার কাছে পাই মানেই সাইকোলজিক্যাল ড্রামা এট ইটস ভেরি বেস্ট! আমার ক্ষুদ্রতম সেরা সিনেমার লিস্টেও পাই থাকবে এবং উপরের দিকেই থাকবে। যারা সাইকোলজিক্যাল ড্রামা পছন্দ করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। “জাস্ট গো ফর ইট!!!”


ডাউনলোড লিঙ্ক - "পাই"
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৫২
১৮টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×