somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এতোদিনে পাইছি তোমার লাগ : রসিক আড্ডাবাজ হুমায়ুন আহমেদ ।

২৭ শে অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রিয় হুমায়ুন আহমেদকে আমরা সবাই চিনি লেখক-নাট্যকার-চিত্রপরিচালক হিসাবে । কিন্তু তার আড্ডাবাজির কথা আমরা ক'জনাই বা জানি । হুমায়ুন আহমেদ আপাদমস্তক একজন রসিক আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন । তার চুটকি, কৌতুক আর মুগ্ধ করানো সত্য মিথ্যার গল্প, সবই বলতেন তার চেনাজানা মানুষদের নিয়ে । আড্ডাবাজ হুমায়ুন আহমেদের এইসব মজাদার কাহিনী উঠে এসেছে প্রখ্যাত লেখক-পরিচালক শাকুর মজিদের লেখনিতে ।

লেখাটি 'সমকালে' প্রকাশিত হয়েছিল । প্রিয় শাকুর মজিদ ভাই সামহ্যোয়ারইন ব্লগে এই লেখাটি প্রকাশের জন্য আমাকে অনুমতি দিয়েছেন । সাথে বোনাস হিসাবে পেয়েছি হুমায়ুন আহমেদের আড্ডাবাজির কিছু 'এক্সপ্লোসিভ' ছবি । উল্লেখ্য, লেখাটি শাকুর মজিদ ভাইয়ের 'হুমায়ুন আহমেদ'র উপর স্মৃতিচারন মূলক প্রকাশিতব্য গ্রন্থ "এক যে ছিলো মুগ্ধকর" এর একটি অধ্যায় ।

এর আগে আমার ব্লগে উনার "ঘেটুপুত্রের লোকেশনে : শাকুর মজিদ" পোস্ট করেছিলাম । যারা পড়েন নি, পড়ে নেয়ার অনুরোধ রইলো ।

এতো দিনে পাইছি তোমার লাগ : শাকুর মজিদ

হুমায়ূন আহমেদ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তিনি আড্ডায় বসবেন আর আড্ডা জমবে না, এটা হতেই পারে না। আসরে কিছু তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার গল্প, কিছু বানানো কাহিনী আর কিছু চুটকি বলা ছিল তাঁর আড্ডার বিষয়। তাঁর সব কৌতুক, অভিনয়, চুটকি এবং সত্য-মিথ্যা মাখানো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প আমরা বহুবার শুনেছি। বলার ভঙ্গিটা এত চমৎকার যে, প্রতিবারই তাঁর এসব কৌতুক মনে হতো নতুন।



একটি বিশেষ চরিত্রে কেবল তিনি অভিনয় করে দেখাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে এক দিগম্বর পাগল যাচ্ছে। হঠাৎ করে তার সামনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী। তাদের কাছ থেকে নিজের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেমন করে সেই পাগল আড়াল করল, এই একটি মাত্র চরিত্রে অভিনয় নিজে করে দেখিয়েছেন বহুবার।
তাঁর চুটকি, কৌতুক আর মুগ্ধ করা সত্য-মিথ্যার গল্প, সবই বলতেন তাঁর চেনাজানা মানুষদের নিয়ে। এ ক্ষেত্রে প্রায় সব আড্ডায় তাঁর 'বডিগার্ড' বলে খ্যাত অন্যপ্রকাশের অন্যতম অংশীদার ও অভিনেতা কমল ছিল সবচেয়ে সহজ টার্গেট। কমলের বাড়ি নোয়াখালী। সব মিলিয়ে নোয়াখালীর কোনো প্রসঙ্গ এলে গল্পটি পড়ে যেত কমলের ওপর।
কমলকে সঙ্গে নিয়ে একবার তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন। পথে দুবাই বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে চেকইন করার সময় সিকিউরিটি অফিসার কমলকে বলেন, 'পেন নিকালো'। বুঝতে একটু সময় লেগেছিল মাত্র। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের কাছে এটা হয়ে গেল বিরাট কাহিনী। তিনি বলছেন, 'দুবাই এয়ারপোর্টে চেক ইন হচ্ছে, সিকিউরিটির ভেতর কমল যতবার পার হচ্ছে, ততবারই চিং চিং আওয়াজ। সিকিউরিটিতে আছে এক ইন্ডিয়ান, সে আমাদের চেহারার যে কাউকে দেখলেই হিন্দিতে কথা বলে। কমলকে প্রথমবার বলে, জ্যাকেট নিকালো।
কমল জ্যাকেট খোলে।
আবার চিং চিং
বেল্ট নিকালো
বেল্ট খুলে কমল সিকিউরিটি পার হতে গেল।
আবার চিং চিং।
পেন নিকালো
কমল এদিক ওদিক তাকায়। আমরা ছাড়া আর কোনো পরিচিত লোক নাই। এদিকে ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। সে টান মেরে তার প্যান্ট খুলে নামাল অর্ধেক। গোলাপ ফুলের নকশা করা আন্ডি পরে কমল দাঁড়িয়ে।
সিকিউরিটি অফিসার ধমক দেন। 'প্যান্ট নেহি, পেন নিকালো।'
কমল প্যান্টের পকেটে রাখা কলমটি বের করল।
এ গল্প যখন বলা হচ্ছে, কমলও উপস্থিত। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। একবার আমাকে কানে কানে বলল, ঘটনা প্রায় পুরো ঠিক, শুধু প্যান্ট খোলার বিষয়টা স্যারের বানানো। কমলের কথা, স্যার যখন এসব গল্প বলেন, সবার মুখের দিকে তাকান, সবাই আনন্দ পায়। সবার আনন্দ দেখার জন্য তিনি এসব বানান, এ জন্য আমিও চেপে যাই। বলুক না!

কমলের দিকে তাকিয়ে বলেন, 'ওর দেশি এক লোক দুবাই ডিউটি ফ্রি শপে ঘোরাঘুরি করছে। ইলেকট্রনিকসের দোকানে গিয়ে একটা টেলিভিশনের দাম জানতে চাইছে। সেলসম্যান বাঙালি, সে বলল অনেক দাম, আপনার কাছে বিক্রি করব না। লোকটি ক্ষেপে গেল। আবার দুই-তিন দোকান গেল। অন্য দোকানের বিক্রেতারা বিদেশি, তারা তাকে পাত্তা দেয় না। আবার দেশি ভাইর কাছে ফিরে এসে বলল, ভাই যা দাম বলবেন দিয়ে দেব, এই টেলিভিশন সেটের দামটা খালি বলেন। বাঙালি দোকানি বলেন, আমরা নোয়াখাইল্যার কাছে টিভি বিক্রি করি না। লোকটা ক্ষেপে গেল। বলে, আপনি জানেন কেমনে আমি নোয়াখালীর?
দোকানি জবাব দিল, ওটা তো মাইক্রো ওভেন, আপনি নোয়াখালীর লোক না হলে কি একে টেলিভিশন বলতেন?'



আমাকে দেখে মাঝে মাঝে তাঁর সিলেটি জোকস মনে পড়ত। একবার শোনান ষাটের দশকের এক গল্প।
এক লোক লন্ডন যাবে। জীবনে প্রথমবারের মতো সে প্যান্ট পরেছে এবং এই প্যান্ট পরেই বিমানে উঠেছে। বিমানে উঠে তার পেশাব করার প্রয়োজন হলো। টয়লেটে গিয়ে বহু চেষ্টা করে প্যান্ট খুলতে পারে না। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। এয়ার হোস্টেসকে বলে তার সমস্যার কথা। এয়ার হোস্টেস অত্যন্ত তমিজের সঙ্গে চেইনটি নামানোর বিষয়টি তাকে শিখিয়ে দেয়। ভদ্রলোক খুবই খুশি। তিনি হোস্টেসকে বলেন, 'নাতিন গো, খলিফা বেটায় আমার ফেন্টোর তালা মারি তুমার গেছে ছাবি ফাটাই দিছে, নায় নি?'



হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছিল সিলেটে। তিনি সিলেটি ভাষায় সামান্য বলতে পারেন। বোঝেন শতকরা একশ' ভাগ। ছোটবেলার তাঁর স্কুলের বন্ধুরা যে আবেগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি করত, তা অভিনয়-আবৃত্তি করে দেখাতেন।
এ খতা জানিতে তুমি জগৎ ঈশ্বর শাজাহান
খালো স্রুতে বেসে গেছে জীবন যৌবন দনমান,
যায় যাক শুদু তাক এ্যাক বিন্দু নয়নের জল
খালের খপোল তলে শুবরো সমুজজল...
এটা আবৃত্তির সময় তাঁর হাত ওপরে উঠছে, আঙুল নাড়ানো হচ্ছে, চোখ কুচকাচ্ছে, মুখের অবয়ব বদলাচ্ছে_ আবেগের শেষ নাই।



নিজের গল্প অন্যের ওপর বা অন্যেরটা নিজের, এমন বহু করেছেন তিনি। আমাদের আড্ডায় একবার তাঁর ছোট ভাই আহসান হাবীবের [শাহীন] রসবোধের প্রশংসা করে বলেছেন,
একবার আমাদের পারিবারিক বৈঠকে বাবার কবর ঢাকায় এনে নুহাশপল্লীতে দিবার প্রস্তাব দিলাম। সবাই রাজী। আমি বললাম_ বাবার কবর তো পিরোজপুরেও থাকবে, ঢাকায়ও হবে, বিষয়টা কেমন? শাহীন বললো_ পিরোজপুরে বাবার কবরের উপর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেবো 'টু-লেট'।
পরে একবার শাহীন ভাই বলেছেন, ঘটনা পুরাই সত্য। টু-লেট লাগানোর কথা আসলে আমি বলি নাই, ওটা দাদা-ভাইই [হুমায়ূন আহমেদ] বলেছেন। আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন আর কি।
আহসান হাবিব নামে তাঁর এক বন্ধুও আছেন। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন। তাঁরা যখন একসঙ্গে পড়তেন, আহসান হাবিব ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী, বোর্ডে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছেন [হুমায়ূন আহমেদও স্ট্যান্ড করেছেন, সম্ভবত দ্বিতীয়]। তো একসঙ্গে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে এসে ভর্তি হলেন ১৯৬৫ সালে। ভর্তির ফরম ফিলাপের সময় তাঁরা সবাই আহসান হাবিবের লেখা অনুসরণ করতেন। নিজের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ বাদে বাদবাকি তথ্য আহসান হাবিব যা দিতেন, তাঁরাও সেটা লিখতেন। শরীরে উল্লেখ করার মতো চিহ্ন_ এ জায়গায় আহসান হাবিব লিখলেন 'ডান ঘাড়ে তিল আছে'। তাঁরটা দেখে তিনিও লিখলেন 'ডান ঘাড়ে তিল আছে'।



অনেক প্রচলিত গল্পকেও তিনি বদলাতেন। ইশপের একটা গল্প সবাই জানেন। এক কাঠুরে নদীর পাড়ে কাঠ কাটতে গিয়ে তার লোহার কুড়ালটি নদীতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক মৎস্যকন্যা ভেসে উঠল পানি থেকে। তাকে একটা সোনার কুড়াল দেখাল, কাঠুরে বলল_ না। আবার ডুব দিয়ে উঠে রুপার কুড়াল দিল, কাঠুরে এবারও বলল_ না। এরপর ডুব দিয়ে উঠে লোহার কুড়ালটি দেখাল, কাঠুরে বলল_ হ্যাঁ। মৎস্যকন্যা তার সততায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তিনটি কুড়ালই দিয়ে দিল।
গল্পের এ অংশটি সবার জানা। হুমায়ূন আহমেদ সংযুক্ত করলেন পরের অংশ। সেটি হচ্ছে_
অনেক দিন পর সেই কাঠুরে তার বৌকে নিয়ে সেই নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একসময় পাড় ভেঙে তার স্ত্রী হঠাৎ করে পানিতে পড়ে একেবারেই ডুবে যায়। এ সময় আবার সেই মৎস্যকন্যা ভেসে ওঠে, তার হাতে_ মেরিলিন মনরো। তাকে দেখিয়ে বললো_ এটা কি তোমার বৌ? কাঠুরে_ জি ম্যাম, এইটাই আমার বউ। আমি তো চিনি।
মৎস্যকন্যা এবার বিভ্রান্ত। বললো_ কিছুদিন আগে তোমার সততা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, আজ আমি বড় কষ্ট পেলাম।
কাঠুরে বললো_ ম্যাডাম, আপনাকে আমি চিনি। আমি যদি বলি এই মেরিলিন মনরো আমার বৌ না, আপনি দেখাবেন শ্রীদেবীকে। আমি যখন বলব_ না, ঐ বেটিও আমার বৌ না, তখন আমাকে আমার পুরানা বৌসহ এই দুইটারে আমারে দিয়ে দেবেন। জগতে এই একজন মাত্র মেয়ে মানুষকে নিয়ে আমার জীবন অতিষ্ঠ। আমার পক্ষে তিনজনকে সামলানো সম্ভব না ম্যাডাম। বাকি দুই নারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি আসলে মিথ্যা বলেছি, প্রথমে যারে দেখাইছেন তারে নিয়াই আমি বাড়ি যেতে চাই, আমি আর চাই না।



ভোজনরসিক হুমায়ূন আহমেদ খাওয়া-দাওয়া নিয়েও যথেষ্ট রসিকতা করতেন। এক বাসায় দাওয়াত খাওয়ার পর বললেন, 'ভাবী, সেভেন আপটা শুধু প্রপার রান্না হইছে।'
চিংড়ি আর ইলিশ মাছ তাঁর খুব প্রিয়। বলতেন, চিংড়ি এমন একটা মাছ, যা রান্না করতে কোনো প্রতিভা লাগে না। এমন কথা বলতেন ইলিশ নিয়েও। বলতেন, যারা নতুন ইলিশ রেসিপি শিখতে চাও আমার কাছে আসতে পারো। আমি একটা রেসিপি জানি, এর নাম 'বগল ইলিশ'। মাছটাকে কেটেকুটে, লবণ-মসলা মাখিয়ে বগলের মধ্যে রেখে দিতে হবে। বগলের তাপে ইলিশ রান্না হয়ে যাবে। এর নাম বগল ইলিশ।
সুন্দরবন ট্যুরে একবার তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তাঁর স্কুল-কলেজ জীবনের বন্ধু সেহেরী ভাইও ছিলেন। সেহেরী ভাইয়ের বৌ খুব সহজ-সরল মহিলা। জাহাজের ছাদে বসে আছি। তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, ভাবী_ কেকা ফেরদৌসীকে আমি উত্তম ভাত রান্নার একটা কৌশল শিখিয়েছি।
সেহেরী ভাবী খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। ভাত রান্নার আবার কৌশল আছে নাকি?
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, এমন পদ্ধতিতে ভাত রাঁধতে হবে, যাতে প্রতিটা ভাত আলাদা আলাদা থাকে। এর নাম ভাত ঝরঝরি।
কী সেটা? সেহেরী ভাবীর কৌতূহল
ট্রিকসটা হচ্ছে, প্রত্যেকটা চাউল আলাদা আলাদভাবে সেদ্ধ করতে হবে।
নতুন কৌশলটি খুব পছন্দ হলো সেহেরী ভাবীর। বেশ কিছুক্ষণ তিনি এ নিয়ে চিন্তা করলেন এবং একসময় বললেন_ কিন্তু তাতে তো অনেক সময় লাগবে!
সেহেরী ভাবী তাঁকে যে এ কথা বলেছেন, সেটাকে আরও রাঙিয়ে সবার কাছে হুমায়ূন আহমেদ যখন ঘটনাটি বলেন, তখন সেহেরী ভাবী অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। ট্রিপের বাকি তিন দিন তাঁকে কেউ আর হাসতে দেখল না।
ঝর্ণা ভাবী [হুমায়ূন আহমেদের নিচ তলার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এবং প্রকাশক আলমগীর রহমানের স্ত্রী]-কেও ঠাট্টা করতে ছাড়তেন না।
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'একবার হলো কী, আমাদের ঝর্ণা ভাবী সিনেপ্লেক্সে গেছেন আমার ছবি দেখতে। ভুল করে ঢুকে গেছেন আরেক হলে। অন্য সিনেমা দেখে এসে আমাকে বলেন, হুমায়ূন ভাই, খুব সুন্দর বানাইছেন ছবিটা, অসাধারণ। কিন্তু শাওন না এই ছবিতে আছে? তাকে তো দেখলাম না।'
প্রকৃত ঘটনা ছিল এমন যে, 'আমার আছে জল' ছবির প্রিমিয়ার শোর একটা তারিখ ঠিক হয়েছিল। সেটা ঝর্ণা ভাবিকে জানানো হয়। দু'দিন আগে তারিখ বদলে যায়, সেটা তাঁকে জানানো হয়নি। ঝর্ণা ভাবী অফিস থেকে ফেরার পথে তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে সিনেপ্লেক্সে গিয়ে দেখেন_ এ ছবির কেউ ওখানে নেই, ছবির প্রদর্শনীও হচ্ছে না। এসেই যখন গেছেন, অনেকদিন বাংলা সিনেমা দেখা হয় না, তাঁরা টিকিট কেটে অন্য একটি ছবি দেখে বাসায় ফিরে পুরো ঘটনাটি হুমায়ূন আহমেদকে জানান। কোথায় নিজে অনুতপ্ত হবেন, সেটা না করে তিনি উল্টো গল্প বানিয়ে ঝর্ণা ভাবীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন। আমরাও মজা পাই।



লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে নানা রকম কৌতুক করতেন। বিশেষ করে যেসব লেখক তাঁকে তুলোধুনো করতেন_ তাদের গল্প বলতেন বেশি।
হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে একটা গল্প আছে। বহুবার বলেছেন। আজাদ সাহেব আহমেদ সাহেবকে প্রায়ই বলতেন_ তোমার লেখা ভালো, কিন্তু গভীরতা নাই।
একবার গভীরতা আনার জন্য তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্প নিজ হাতে কপি করে নিয়ে গেলেন। শুধু চরিত্রের নামগুলোকে মুসলমান করা হলো, পরিবর্তন এটুকুই। হুমায়ুন আজাদ নাকি এই গল্প পড়ে বললেন_ হুম, সবই ঠিক আছে, গভীরতা একটু কম।
একসময় এই দুই হুমায়ুনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের ইতি হয়ে যায়। তাঁর এক লেখায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে 'অপন্যাস' এবং তাঁর বেশি বেশি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে 'ইতর প্রাণী প্রসব করে বেশি' ধরনের কথাবার্তা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না।
সৈয়দ শামসুল হককে নিয়েও রসিকতা করেছেন। বলেছেন,
একবার বিচিত্রা অফিসে হক ভাইর সঙ্গে আমাকে আড্ডায় বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। হক ভাইর সেকি কঠিন কঠিন প্রশ্ন। প্রশ্নের একটি হচ্ছে_ তুমি কী করে বুঝতে পারো যে তোমার লেখা এই ৬ ফর্মা বা ৭ ফর্মায় শেষ হবে? জবাবে আমি বলেছি, হক ভাই, আপনি যখন সনেট লিখেন, তখন কেমনে ঠিক করেন যে, ১৪ লাইনেই এটা শেষ হবে?
হুমায়ূন আহমেদ এক-একটা প্রসঙ্গের কথা শেষ করেন, ঘুরে ঘুরে সবার মুখের দিকে তাকান। কে কেমন করছে দেখেন। সবাই তাঁর কথায় আনন্দ পায়, তিনি খুবই আপ্লুত হন।
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, হক ভাই আমাকে কঠিন প্রশ্ন করেন_ হুমায়ূন, তোমার লেখায় কোনো নিরীক্ষা নাই কেনো? আমি তো এক্সপেরিমেন্ট করি। আমি বললাম, হক ভাই, এক্সপেরিমেন্ট লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরা করবেন। নতুন লেখকরা করবে। আপনি করবেন কেন? আমি করব কেনো?
এসব কথা বলেই প্রথমে তাঁর স্বভাবসুলভ একটা মুচকি হাসি নিজে হাসবেন। তাঁর এই হাসি সংক্রামিত হবে সতীর্থ আড্ডাবাজদের মধ্যে।
ইমদাদুল হক মিলন পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার পর তাঁর পত্রিকা নিয়ে অনেক কৌতুক করেছেন। 'কালের কণ্ঠ'-এর ছন্দের সঙ্গে মিল রেখে অনেক মজার বাক্য বানাতেন। তাঁর একটা শুধু ছিল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ, 'পুলিশের গু খেয়ে দুই জন নিহত'_ এ সংবাদ ছাপার পর পরবর্তী চার দিন এর সংশোধনীগুলো কীভাবে ছাপা হয়েছিল এবং সব শেষে তাঁর পত্রিকার নাম ছাপার ভুলের কারণে কী হয়ে গেল তা নিয়ে রসিকতা। মিলন ভাইর মুখ লাল হয়ে যেত।



বাঙালি কী পরিমাণ আবেগপ্রবণ জাতি এর উদাহরণ দেওয়ার জন্য একটা গল্প বলতেন। গল্পটা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শহরের এক শ্রমিককে নিয়ে।
সেই শ্রমিক দুবাইতে ২৮ তলা ভবনের সবচেয়ে উঁচু তলার দেয়ালে রং-এর কাজ করছিলো। নিচে থেকে একজন চিৎকার করে বললো_ 'ঐ বশির, তোর মাইয়া ফাতিমা কাল মারা গেছে।' এ কথা শুনে লোকটি ভাবলো_ এ জীবন রেখে কোনো লাভ নাই। সে নিজেও আত্মাহুতি দেবে। ২৮ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়া শুরু করলো। ৭ তলা পর ২১ তলার কাছে এসে তার মনে হলো_ আরে, ফাতিমা নামে তো আমার কোন মেয়ে নাই! সে নামছে। ১৪ তলা পর্যন্ত নামার পর মনে হলো_ আরে, আমার মেয়ে আসবে কোত্থেকে, আমি তো বিয়েই করিনি! কিন্তু লাভ নাই, সে তো পড়ছেই। পড়তে পড়তে আরো ৭ তলার ওপর এসে তার মনে হলো_ আরে, বশির কেডা? আমার নাম তো বশির না!


( শাকুর মজিদ : স্থপতি-লেখক-নাট্যকার-পরিচালক )

তাঁর কথা বলার ধরন তাঁর লেখার মতোই, প্রায় হুবহু। তিনি যেভাবে কথা বলেন, গল্প করেন, ঘটনার বর্ণনা দেন, ঠিক সেভাবেই লেখেন।
তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৮৬ সাল থেকে। কিন্তু ২০০৮ সালের পর খুব সামান্য সময় পেয়েছি তাঁকে। যেটুকু সময় পেয়েছি তাঁকে, লেখক-নাট্যকার হিসেবে নয়, তিনি ছিলেন খুব কাছের বন্ধুর মতো একান্ত আপন, এক অতি সাধারণ আড্ডাবাজ একজন ভালো মানুষ।
'আবার বছর কুড়ি পরে' তাঁকে পেয়ে সিলেটের বাউল রমিজ মিয়ার মতো বলতে ইচ্ছা হয়েছিল_
'একবার দাঁড়াও বন্ধু/
এতো দিনে পাইছি তোমার লাগ'


কিন্তু তাঁকে কি আর কেউ দাঁড়াতে দিল ?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৪৯
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×