somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আল মাহমুদের ছোটগল্পে যৌনতা

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৪:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি আল মাহমুদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার সৌন্দর্য সৌষ্ঠব বর্ণনার জন্য তিনি এতো বেশি উপমার সৃষ্টি করেছেন যে তা আর কোনও কবির ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। তার এই বিশেষ যোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা যেমন আছে, তেমনি প্রশ্ন আছে তার লেখায় যৌনতার আধিক্য নিয়েও।

কবিতায় তিনি যেমন অলঙ্কারের আড়াল ভেঙে যৌনতাকে উদ্দাম এবং নিরাবরণ করেছেন তেমনি বরং তার চেয়েও বেশি উদোম করেছেন তার ছোটগল্পে। অথচ শেষবয়সে তার খ্যাতি জুটেছে ইসলামি ভাবধারার কবি হিসেবে। এর কারণ হয়তো তার শেষদিকের ওঠাবসার মেলামেশার কর্মস্থলের কলিগদের বিশেষ পরিচয় থাকা। তিনি দৈনিক সংগ্রামে চাকরি করেছেন। তিনি একটি বিশেষ ইসলামী দলের সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রোগ্রামাদিতে উপস্থিত থাকতেন। একই ঘরানার গানের অনুষ্ঠানে, বিচার কাজে, কিংবা পুরস্কার বিতরণীতেও তিনি থাকতেন।

কিন্তু তাঁর রচনায় এসবের খুব একটা ছাপ আছে তেমনটি দেখি না। তবে হ্যাঁ তিনি তাঁর পরবর্তীকালের লেখাসমূহে অনেকটাই সংযত হয়েছেন যৌনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে। আগের মতো যৌবনও যেমন তার ফুরিয়ে গিয়েছিল, তেমনি শেষদিকের লেখায়ও উঠে এসেছিল কবরের টান। কাব্যালঙ্কারের ছুতোয় আর যৌন সুড়সুড়ি তিনি দিতে চাননি শেষদিকে।

তার লেখায় এই যৌনতার বিষয়টি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, সাহিত্যে রাস থাকবেই, তরকারিতে যেমন লবণ থাকে, তেমনি।

আল মাহমুদ অকপটে স্বীকার করেন, তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো প্রেম ও নারী। তবে নারী ও সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখতে চান। এক নারী একজনের কাছে সুন্দর, অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে। তাই আল মাহমুদ নারীকে সৌন্দর্য না বলে আকর্ষণীয় বলতে চান। তার মানে নারী আকর্ষণ করে, তার মধ্যে আকর্ষণ করার শক্তি আছে। সেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বলেই নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় এত ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি আর্টের অংশ হিসেবেই দেখতে চান।

কবি তার ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম কবিতায় লিখেছেন— ‘বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল/ পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না/ তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল/ জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা/ পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’

আবার তিনি লিখেছেন—‘আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে/ ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল/ এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ/ ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।’

`লোক লোকান্তর`-এর `সিম্ফনি` কবিতায় শুধু নারীর শরীরকে আরাধ্য করেননি কবি, কবিতার চরণসজ্জায় আবরণহীন শব্দের আভরণ স্থান করে নিয়েছে। কবি লিখেছেন- `শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি/লজ্জায় বিবর্ণ মন ঢেকে যাবে ক্রিসেনথিমামে`। `নূহের প্রার্থনা` কবিতায়ও নারী-পুরুষ সম্পর্কই মুখ্য স্থান গ্রহণ করেছে। লিখেছেন ‌`আবার করবো পান বুকের এ উৎস ধারা হতে/জারিত অমৃত রস/এতোদিন যৌবনের নামে/যা ছিল সঞ্চিত এই সঞ্চারিত শরীরের কোষে/হে নূহ সন্তান দেবো, আপনাকে পুত্র দেবো`। `শোকের লোবান` কবিতা নিবেদিত নারীর দাবি পূরণের গল্প-ভালোবাসার কথা তুলে ধরেছেন। লিখেছেন `তামসিক কামকলা শিখে এলে/যেন এক অক্ষয় যুবতী/তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল/যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর/নিম্ননাভিমূল`। `কালের কলস` গ্রন্থের `শূন্য হাওয়া` কবিতায় কামবিন্দুকে ঘিরে নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্কের চরণবৃত্ত গড়ে উঠেছে- `ঘুমের ছল কামের জল/এখনো নাভিমূলে/মোছেনি তবু আবার এলো/আগের শয্যায়।`

এরকম অজস্র কবিতার উধৃতি দেয়া সম্ভব, যাতে স্তন উরুযুগল আর পুরুষদণ্ডের বিবরণ উদোম করে বর্ণনা করেছেন তিনি। পুরুষাঙ্গকে এক কবিতায় তিনি উগল মাছ বলে উপমাসিক্ত করেছেন।

শুধু কবিতায় নয়, ছোটগল্পে তিনি যৌনতা প্রকাশে আরও বেশি বাঙময় ছিলেন।
গল্প সমগ্র-প্রথম খণ্ডের প্রথম গল্পটায় কী অবলীলায় কবি নতুন উপমা সৃষ্টির সাথে সাথে জৈবিকতাকে তুলে ধরেছেন। গল্পের নাম পানকৌড়ির রক্ত। পানকৌড়ির রক্তের সাথে তিনি নারীর মাসিকের রক্তকে মিলিয়ে দারুণ এক উপলব্ধির সৃষ্টি করেছেন। পানকৌড়ি শিকারের পর নায়ক যখন ঘরে ফেরে তখন আদিনা ফিসফিস করে বলে ‘আজ হবে, ব্যাপারটা বন্ধ হয়েছে।’
খুব সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর মিলনাত্মক বিষয়টাকেও কী অদ্ভূৎ গুরুত্ব দিয়ে বালিহাঁস শিকারের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত টেনে এনেছেন আল মাহমুদ।
স্ত্রীর মাসিক চলকালে স্বামীর ভেতরে কী ধরনের মনোবৃত্তি খেলা করে, তার সত্যাসত্যটুকু তুলে ধরতে এতটুকু লজ্জিত হননি আল মাহমুদ। বালিহাঁস শিকারে গিয়েও নায়ক বালিহাঁসের সুডৌল স্বাস্থ্যের সাথে আদিনার মিল খুঁজে পান। আসলে আজ আদিনাকে তিনি শিকার করতে পারেননি। ভোগ করতে পারেননি। সেই রক্তওঠা কষ্টটাকে তিনি ভুলতে চেয়েছেন বালিহাঁস শিকারের মধ্য দিয়ে। এখানে আরও একটা বিষয় খুবই ভিন্নতা নিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে তাহলো আদিনা তথা গল্পের নায়ীকার গায়ের রং। আদিনার সাথে কালো বালিহাঁসের মিল খুঁজে পেলো নায়ক। আবার নায়কের মা যখন আদিনার প্রস্তাব তোলে তখন আদিনাকে সুশ্রী বলা হলেও নায়ক তা মানতে পারে না। নায়ক তাকে বলে ‘শ্যামবর্ণের নারীশরীর’। এই যে কালো বা শ্যামবর্ণের নারীকে তিনি নায়ীকা করলেন এটাই ছিল তার জিহাদ। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। কারণ তার সময়ের লেখকেরা নায়ীকা মানেই সুন্দরী, তথা দুধে আলতা ফর্সা, বা টকটকে ফর্সা, চাঁদের মতো সুন্দর, ঘর আলোকরা সৌন্দর্য বলে প্রকাশ করতেই অভ্যস্থ ছিল। আর পাঠকও যেন, নায়ীকা মানেই সুন্দরী ফর্সা ছাড়া ভাবতেই পারে না। এমনকি একই সময়ের চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে আটা ময়দা মেখে, বা মেকাপের পর মেকাপ করে নায়ীকাকে ফর্সা করা হতো। যেন কালো নারী নায়ীকা হতেই পারে না। এই চিরায়ত ধারা ভেঙে আল মাহমুদ কালো মেয়েদের নায়ীকা করতে শুরু করলেন।
একই সাথে যৌনতাকে না এড়িয়ে শিল্পের সামঞ্জস্য করে নতুন উপমা সৃষ্টিতে মগ্ন হলেন। এই গল্পে তিনি শেষের দিকে আদিনার সাথে তার নায়কের শারীরিক মিলনের দৃশ্যটি বর্ণনা করেন এভাবে--‘আমি আবার আমার একনলা বন্দুক হাতে ত্রিকোণাকৃতি চরভূমির নরম গুল্মলতায় পা মাড়িয়ে চলতে লাগলাম। নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, আমি সেখানে এসে পেশাদার শিকারীর মতো হাঁটু গেড়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম।’
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৪:১৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×