somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাঁওতাল বিদ্রোহ: উপমহাদেশর প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম

০২ রা জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“স্ত্রী পুত্রের জন্য, জমি জায়গা বাস্তু ভিটার জন্য, হায় হায় এ মারামারি, এ কাটাকাটি। গো-মহিষ, লাঙ্গল, ধন সম্পত্তির জন্য পূর্বের মত সব আবার ফিরে পাবার জন্য, আমরা অবশ্যই বিদ্রোহ করব।” সাঁওতাল বিদ্রোহের ঠিক পূর্বে এই গানটি ভাগলপুর ডিভিশন এবং তৎকালীন বীরভূম জেলার প্রতিটি সাঁওতাল গ্রামে বিদ্রোহের উত্তাল তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ তার দেশীয় দোসরদের দিয়ে সাঁওতালসহ নি¤œবর্গীয় মানুষের উপর খাজনা আদায়ের নামে যে অত্যাচারের বুলডোজার চালিয়েছিল সেই জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবার জন্যই ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন চার ভ্রাতা সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব এবং তাদের দুই বোন ফুলো মুর্মু ও ঝানো মুর্মুদের আহ্বানে ৪ শতাধিক গ্রামের প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভারতের দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের ভগনাডিহি গ্রামে জমায়েত হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকার ও তাদের দেশীয় দালালশ্রেণী জমিদার, সুদখোর, মহাজন, ব্যবসায়ী, কণ্ট্রাকটার, পুলিশ-দারোগা, ভূমি অফিসারের কর্মচারী এবং বরকন্দাজদের জুলুম অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু সাঁওতালদের বিদ্রোহ ছিলনা। এটা ছিল বিট্রিশদের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ও নি¤œবর্গীয় মানুষের দুঃখ দুর্দশা না শুনেই বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এতে করে বিদ্রোহীরাও ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তীর-ধনুক হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আধুনিক অস্ত্র বনাম তীর-ধনুকের অসম যুদ্ধে ৩০ হাজার সাঁওতালের জীবন নিয়ে সেদিন ব্রিটিশ সরকার কঠোর হাতে বিদ্রোহকে দমন করেছিল। পরবর্তীতে সাঁওতাল বিদ্রোহকে অনেক লেখক বুদ্ধিজীবী মহল নানাভাবে নামকরণ করে এই ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিকতাকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। ‘আরণ্য জনপদে’ গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘হাঙ্গামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কার্ল মার্কস তার ‘Notes on Indian History’ ঘড়ঃবং ড়হ ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু’ -এ সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘গেরিলা যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১৩০০ সনে তার ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ প্রবন্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুলকে ‘সাঁওতাল উপবিপ্লব’ বলেছেন। ভারতীয় ইতিহাসকর দিগম্বর চক্রবর্ত্তীই সাঁওতাল সমাজের বাইরের কেউ, যিনি ১৮৯৫-৯৬ সালে লিখিত তার History of Santal Hul পুস্তকে হুলকে প্রথম ‘হুল’ অর্থাৎ ‘বিদ্রোহ’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল চাষিদের বিদ্রোহ, বর্তমান বাংলাদেশে (পাবনা ও বগুড়া) ১৮৭২ সালে ঘটে যাওয়া রায়ত অভ্যুত্থান, ১৮৭৫-৭৬ সালে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা কৃষকদের অভ্যুত্থান, ১৯৪৬-৪৭ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নাচোলের তেভাগা আন্দোলনসহ ইতিহাসের অন্যান্য কৃষক আন্দোলন সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার এবং আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ। কিন্তু বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী-নি¤œবর্গীয় জনগণের জমি প্রতিনিয়ত জবর দখল হয়ে যাচ্ছে। কেউ জাল দলিল তৈরী করে, মিথ্যা মামলা চাপিয়ে দিয়ে, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, দেশান্তরে বাধ্য করে, নারীদের প্রতি সহিংসতা করে এবং অনেকসময় হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে জমি-জঙ্গল-জলাধার জবর দখল করছে। বাদ যাচ্ছেনা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র ভূমি। মানুষের মৃত্যুর শেষ ঠিকানা শ্মশান ভূমিও দখল হচ্ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ বন বিভাগ এবং বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোও ক্ষত বিক্ষত করছে পবিত্র ভূমিকে। যেখানে আদিবাসীদের জমিগুলোই ভূমি দখলকারীদের এক নম্বর টার্গেটে পরিণত হয়েছে। অথচ এই আদিবাসীরাই এদেশের শষ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত অন্যতম জনশক্তি হওয়ার পরও জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে আজ নিঃস্ব এবং ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। আজকে যদি আমরা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমিহারা সাঁওতাল-বাঙ্গালিদের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আজকে সেখানে আদিবাসী-বাঙ্গালিদের বাপ দাদার ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি রাষ্ট্র জোরপূর্বক চিনিকলের নামে দখল করে রেখেছে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সে জমিগুলোর উপর অধিকার দাবি করলেও রাষ্ট্র তার পুলিশী বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণ অব্যাহত রেখেছে। ১৮৫৫ সালে আদিবাসীদের অবস্থা আর আজকে ২০১৮ সালে এসে এই স্বাধীন বাংলাদেশে সাঁওতালসহ ৫৪টির অধিক আদিবাসীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য দেখা যাচ্ছেনা। তখনো আদিবাসীরা শোষিত ছিল। এখনো তারা শোষিত। শাসকশ্রেণীর চেহারা বদলেছে কিন্তু শোষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

ভারতবর্ষের জমিদারি-মহাজনী শোষণ ব্যবস্থার মূলে কূঠারাঘাত করেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। প্রথম অবস্থায় মহাজন জমিদারদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম শুরু হলেও অচিরেই এই অবস্থা সৃষ্টির মূলহোতা বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহই ভারতবর্ষের মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য্য। যদিও ইতিহাস রচনাকারীরা বারবার আদিবাসী ও নিম্নবর্গীয়দের প্রকৃত ইতিহাসকে লুকানোর চেষ্টা করেছে এবং সাঁওতাল বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেছে। তারপরেও সাঁওতাল বিদ্রোহ স্বমহিমায় আজ উজ্জ্বলিত। তবে যে শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল আজকে সেই শ্রেণী শাসনের রূপ বদলালেও শোষণ রয়ে গেছে। ব্রিটিশ শাসকরা পোশাক বদলেছে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে, ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসী এবং নিপীড়িত, বঞ্চিত, কৃষক, শ্রমিক, নি¤œবর্গীয়দের উপর তাদের শোষন নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। নানা উপায়ে এক ধরনের অদৃশ্যমান উপনিবেশ তৈরি করে রেখেছে। তবে ইতিহাস বদলা নেয়, কৃষক-শ্রমিক-আদিবাসী জনতা প্রয়োজনে আবারো হুল (বিদ্রোহ) এর ডাক দিবে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অনুপ্রেরনা আমাদের সকলকে যুগে যুগে মুক্তির স্বপ্ন দেখাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:১৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×