***ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্কতা ও ঈমানের দাবী(প্রথম পর্ব)***
ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্কতা ও ঈমানের দাবী
মূল: মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল হামদ
দৃষ্টি অবনত রাখা:
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনাকাঙ্খিত চিত্র কখনো সমানে এস হাজির হয়। এমনতাবস্থায় ব্যক্তি যদি তার দৃষ্টিকে অবনত করে নেয়, তবে সে একদিকে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল অন্যদিকে নিজের হৃদয়কেও তৃপ্তি দিতে সক্ষম হল। চোখ হৃদয়ের আয়না। চোখের লাগাম ছেড়ে দেওয়া অনুশোচনার কারণ, পক্ষান্তরে দৃষ্টি অবনতকরণ, হৃদয়কে শান্ত-তৃপ্ত করে। যখন কেউ তরি দৃষ্টিকে লাগাম লাগিয়ে রাখে তখন তার হৃদয়ও কামনা-বাসনার মুখে লাগাম লাগিয়ে রাখে। চোখ উন্মুক্ত স্বাধীন করে দিলে, হৃদয়ও উন্মুক্ত স্বাধীন হয়ে যায়।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنْ أَبْصَـرِهِمْ وَيَحْفَظُواْ فُرُوجَهُمْ ذلِكَ أَزْكَى لَهُمْ
অর্থ: মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। (সূরা নূর: ৩০)
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা, দৃষ্টি অবনত করা ও লজ্জাস্থান হেফাজত করাকে আত্মার পরিশুদ্ধির সমধিক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। আর আত্মার পরিশুদ্ধির অর্থ সকলপ্রকার দুষ্ট, অশালীন, জুলুম, শিরক, মিথ্যা ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া।’
নিশ্চিত হওয়া:
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য এটা জরুরি যে, সে যা বলছে বা পড়ছে অথবা বর্ণনা করছে তার শুদ্ধতা ভালভাবে যাচাই করে নেয়া, কেননা একটা মানুষেরে বুদ্ধিমত্তা ও ঈমানের পরিচয়। আর এটা জরুরি এ জন্যও যে, ইন্টারনেটে ভালমন্দ সবই লেখা হয়, সক্ষম-অক্ষম সবাই তাতে লেখে। অনেকেই আবার অপরিচিত নাম বা ছদ্মনামে লেখে।
সে কারণেই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ হবে সতর্কতা অবলম্বন করা। তাই যখন সে কোন সংবাদ বা অন্য কোন বিষয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবে। নিশ্চিত হওয়ার পর এ সংবাদ বা তথ্যটি প্রচারের উপযোগিতা নিয়ে ভাববে। যদি তা কল্যাণকর হয় তবে প্রচার করবে। অন্যথায় তা প্রচার থেকে বিরত থাকবে। এই ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কারণে কত খারাবিই না সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এমন রয়েছে যারা ইন্টারনেটে যা পায় মহাসত্যের মতো বিশ্বাস করে নেয়। এটা নির্বুদ্ধিতার আলামত; কেননা বুদ্ধিমানের আচরণ হল নিশ্চিত হওয়া, সত্য-মিথ্যা যাচাই করে নেয়া। এমনকী কোন সুপরিচিত ব্যক্তির কথা হলেও তা যাচাই করে দেখা উচিত। অপরিচিত মানুষের কথাবর্তার বেলায় কি অবস্থান নিতে হবে তা বলাই বাহুল্য। মানুষ যা শোনে তাই প্রচার করতে শুর করা থেকে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘ব্যক্তির মিথ্যা বলার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তা বর্ণনা করতে লাগে।’ (মুসলিম)
ফেতনা-ফাসাদের সময় এ আদবটি অধিক গুরুত্বসহ পালন করা জরুরি। যে ব্যক্তি নিজের উপকার চায় তার উচিত নিরাপদে থাকার খাতিরে, র্ভৎসনা থেকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, এই আদবটি কঠিনভাবে ধরে রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِذَا جَآءَهُمْ أَمْرٌ مِّنَ الاٌّمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُواْ بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُوْلِى الاٌّمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ وَلَوْلاَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لاَتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَـنَ إِلاَّ قَلِيلاً
অর্থ: আর যখন তাদের কাছে শান্তি কিংবা ভীতিজনক কোন বিষয় আসে, তখন তারা তা প্রচার করে। আর যদি তারা সেটি রাসূলে কাছে এবং তাদের কর্তৃত্বের অধিকারীদের কাছে পৌছে দিত, তাহলে অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা তা উদ্ভাবন করে তারা তা জানত। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত না হত, তবে অবশ্যই অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা শয়তানের অনুসরণ করতে। (সূরা নিসা: ৮৩)
শায়খ আল্লামা আব্দুর রহমান আসসুদি এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার বান্দাদেরকে, তাদের অযাচিত কাজ করার পর একটি দীক্ষা। অর্থাৎ যখন তারা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মুখোমুখি হবে, সর্বসাধারণের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন বিষয় হবে, মুমিনদের আনন্দের বা দু॥খের কোন সংবাদ থাকবে, তবে এ বিষয়ে প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে এবং সংবাদটি প্রচারে দ্রুততার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং বিষয়টিকে রাসূল ও উলুল আমররের কাছে রুজু করতে হবে, উলুল আমর হলেন, জ্ঞানী ও সুচিন্তিত মতামত দিতে পারঙ্গম, নসিতকারী ও সুভদ্র ব্যক্তি যারা বিষয়ের নিগূঢ়তায় প্রবেশ করতে এবং মুমিনের স্বার্থ কোথায় তা বুঝতে সক্ষম। তারা যদি মনে করেন যে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য প্রচার করলে ফায়দা হবে, মুমিনদের উদ্দমতা বেড়ে যাবে, তাদের আনন্দের কারণ হবে, শত্রুপক্ষের অনুশোচনা বর্ধনের কারণ হবে, তাহলে তা প্রচার করবে, এর অন্যথা হলে তা প্রচার থেকে বিরত থাকবে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘তাদের মধ্যে যারা তা উদ্ভাবন করে তারা তা জানত’’। অর্থাৎ তারা তাদের সুচিন্তা ও জ্ঞানের তা থেকে সঠিক বিষয়টি উদ্ধার করতে পারবে।
এখানে আমরা আরেকটি আদর্শিক বিধান পাচ্ছি, আর তা হল, কোথাও যদি বাহাস শুরু হয় তবে উচিত হবে এ বিষয়ে যারা দক্ষ তাদের শরণাপন্ন হওয়া। নিজেকে এগিয়ে না দেয়া, কেননা এটাই নির্ভুলতার জন্য সমধিক উপযোগী পদ্ধতী।
কোন কিছু শোনার সাথে সাথে তা প্রচার করতে লেগে যাওয়া উচিত নয়, এ বিধানটিও আমরা উক্ত আয়াতে পাই। বরং কথা বলার পূর্বে চিন্তাভাবনা করে দেখা, কল্যাণ কোথায় তা ভেবে দেখে প্রচার করবে কি করবে না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও বিধান পাচ্ছি উক্ত আয়াতে।
নিশ্চিত হওয়া ও ভেবে চিন্তে দেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে শায়খ অন্য একটি আয়াত উল্লেখ করেন, আয়াতটি হল,
فَتَعَـلَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ وَلاَ تَعْجَلْ بِالْقُرْءانِ مِن قَبْلِ إَن يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهُ وَقُل رَّبِّ زِدْنِى عِلْماً
অর্থ: তোমার প্রতি ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তুমি কুরআন পাঠে তাড়াহুড়া করো না এবং তুমি বল, ‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ (সূরা ত্বহা: ১১৪)
তিনি বলেন, এখানে জ্ঞান অন্বেষণকারীর একটি শিক্ষণীয় আদব রয়েছে, আর তা হাল ইলমের ব্যাপারে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা। কোন বিষয়ে রায় দিতে তাড়াহুড়া না করা। গর্ববোধে নিপতিত না হওয়া। উপকারী ইলম অর্জন যাতে সহজ হয় সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। তিনি আরেকটি আয়াত উল্লেখ করেন,
لَّوْلا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَـتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْراً وَقَالُواْ هَـذَآ إِفْكٌ مُّبِينٌ
অর্থ: যখন তোমরা এটা শুনলে তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা তাদের নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলে না এবং বলল না যে, ‘এটাতো সুস্পষ্ট অপবাদ’। (সূরা নূর: ১২)
এ আয়াত উল্লেখপূর্বক তিনি বলেন, এখানে আল্লাহ তাআলা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন যে, যখন মুমিনরা অন্যান্য মুমিন ভাইদের চরিত্রহননকারী কোন খারাপ সংবাদ শুনবে তখন তাদের ঈমান ও প্রকাশ্য অবস্থা সম্পর্কে যা জানা আছে তার প্রতি নজর দিবে। সমালোচকদের কথায় কান দিবে না। বরং বিরাজমান মূল বিষয়কে ভিত্তি হিসেবে ধরবে, সমালোচকদের কথা বিশ্বাস না করে তা বরং প্রত্যাখ্যান করবে।
চলবে..... (ইনশাল্লাহ)