somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবতু ভাগ মিলখা

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের অফিস জিমের জন্ম থেকেই আমি মেম্বার। অফিসের সবার আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মতন বডি বানাতে একটি ফাইভস্টার জিমের সব ফ্যাসিলিটিজ (সুইমিং পুল এবং সনা ছাড়া) আমাদের জিমে আছে। যন্ত্রপাতি ছাড়াও এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়। ইয়োগা, সাইক্লিং, বক্সিং ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছোটবেলায় "রকি" সিনেমা দেখে ইচ্ছে জেগেছিল বক্সার হবার। সিলেটে কোন বক্সিং ক্লাব ছিল না। রাস্তাঘাটে মারামারি করেই লোকে বক্সিংয়ের মজা নিত। "ভদ্রলোকের" সন্তান হওয়ার কারনে আমার সেই সুযোগ ছিল না।
তবে খুব দৌড়াতাম। সাইক্লিং করতাম পুরো শহরময়। দুই তিনটা কাঁচা ডিম কপাকপ গিলে ফেলতাম।
আমাকে ব্যায়াম করতে দেখলে আশেপাশের কিছু মানুষ টিটকারি করতো, "এমনিতেই তোমার শরীরে মাংস নাই এক ছটাক, তুমি বেয়াম করলেতো হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবে না।"
যে যুগে বড় হয়েছি, সেই যুগে তেল চর্বিওয়ালা থলথলে চেহারা ও শরীর না হলে লোকে "রোগা" "আনফিট" বিবেচনা করতো। স্বাস্থ্য বলতে মোটা শরীরকেই গণনায় ধরতো।
ভারী ভারী ডাম্বেল তুলে হাতের মাসলের উপর কাজ করতাম। বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ইত্যাদিই ছিল মূল ফোকাস। আমাদের যুগে "সিক্সপ্যাক" এতটা সেনসেশন ছিল না। সিক্সপ্যাক বানানোও কঠিন ছিল। দৌড়, পুশআপ (বুকডন), উঠকবৈঠক, স্কিপিং ইত্যাদিই ছিল ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ। আর ডাম্বেল দিয়ে বাকিটা সারো।
এদেশে আসার পর মাঝে ২৪ আওয়ার জিমে যোগ দিয়েছিলাম মূলত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। রাত ১১-১২টার দিকে জিমে যেতাম, ব্যায়াম শেষে গরম পানির জিকুজিতে শুয়ে অথবা স্টিম বাথ নিতে নিতে আড্ডা চলতো। কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে অনিয়মিত হয়ে গেলাম।
অফিসে জিম খোলায় তাই প্রথম দিকে খুব উৎসাহের সাথে যোগ দিয়েছিলাম। ভাগ মিলখা ভাগ সিনেমা তখন মাত্র বেরিয়েছে। মনের মধ্যে গান বাজে, "আবতু ভাগ মিলখা, তু বানজা নাগ মিলখা, তু পাগড়ি বাঁধ মিলখা...."
"এখন তুই দৌড়া মিলখা!"
মিলখা সিংকে বলা হলেও আমারও দৌড়াতে ইচ্ছা করে।
কয়েক বছরের গ্যাপ হয়ে গেছে। এখন দৌড়াতে গিয়েই বুঝি নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং না করার পার্থক্য।
একদিন খুব ভাব নিয়ে ট্রেডমিলে দৌড়াতে গেলাম। পাশে এক বুড়ি দৌড়াচ্ছে। চুলের পাক দেখে বুঝা যায় বয়স অবশ্যই পঞ্চাশ পেরিয়েছে। আমাদের দেশে অনেক মহিলা এই বয়সেই লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেনা। ইনি বিদেশিনী বলেই দৌড়াচ্ছে।
তাঁর শরীরের ঘাম, দৌড়ের গতি ইত্যাদি দেখে মনে হলো দেড় দুই মাইল দৌড়ে ফেলেছে। ধরে নিলাম আর কিছুক্ষনের মধ্যেই হাঁপিয়ে গিয়ে অন্য কোন ব্যায়াম শুরু করবেন।
আমি খুব ভাব নিয়ে দৌড় শুরু করলাম। মেশিন সেট করা আছে সমতলে। কয়েক মিটার যেতেই দম ফুরিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে পাশের বুড়ি দৌড়েই যাচ্ছে, দৌড়েই যাচ্ছে। মেশিনে সেটিং চেঞ্জ করে সমতল থেকে ঢালু করলাম। এতে দৌড়ানো হবে বেশি, হাঁপানো হবে কম। আরও কয়েক মিটার দৌড়ালাম। দম শেষ। বুড়ির দৌড় শেষ হয়না।
দৌড়ের গতি কমালাম। কিছুতেই বুড়ি মহিলার আগে দৌড় থামানো যাবেনা। দেশের ইজ্জতের ব্যাপার। মহিলা কী মনে করবে, অ্যামেরিকান বুড়ি মাইলের পর মাইল দৌড়াতে পারে, বাংলাদেশী যুবক কয়েক মাইল দৌড়াতেই ফুস! হাহাহা।
বুড়ির হাসির শব্দ বুকে শেলের মতন বিঁধে। মনের পর্দায় লাল সবুজ পতাকা উড়তে থাকে। ঐ পতাকার ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব আমার হাতে। আমি দৌড়াই।
মনে মনে মোটিভেশনাল গানও ধরি, "আবতু ভাগ মিলখা,"
লাভ হয়না। উল্টা "ভাগ" শব্দটার বাংলা মানেটা মনে পড়ে যায়। "এখন তুই পালা মিলখা, এই বুড়ির সাথে টিকবি না মিলখা, তুই অফ যা মিলখা।"
বুড়ি মনে হলো দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন। আমার হৃদযন্ত্র তখন চিৎকার করে বলছে "ফাজলামি বন্ধ কর! নাহলে কিন্তু কার্যক্রম বন্ধ করে দিব। হরতাল! হরতাল!"
আমি তাঁর কথা শুনে দৌড় থামালাম। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে কে অকালে মরতে চায়?
মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি ততক্ষনে। পৃথিবীময় এত অক্সিজেন, আমার ফুসফুস তখন সামান্য অক্সিজেনের জন্য হাতড়ে ফিরছে।
টলতে টলতে গেলাম ডাম্বেল আলগাতে। ওটাতে আমি এক্সপার্ট। ক্লাস সিক্স থেকে ডাম্বেল তুলে ব্যায়াম করেছি। দেখি ওটাতে দেশের ইজ্জ্ত রক্ষা করতে পারি কিনা।
দেশে থাকতে পাঁচ কেজি ডাম্বেল (এগারো পাউন্ডের মতন) নিয়ে কেরামতি করতাম। এখানে ১০ পাউন্ডের ডাম্বেল তুললাম। ওজনে যদিও কম, তবু কষ্ট হলো একটু। আগের মতন সহজে লিফটিং হলো না। বুঝলাম কলকব্জায় জং ধরেছে সামান্য। ব্যাপার না। অভ্যাসে ঠিক হয়ে যাবে।
সাদা কালো কলিগদের দিকে তাকিয়ে অবাক। এরা বিশ-পঁচিশ পাউন্ডের ডাম্বেল তুলে তুলে ব্যয়াম করছে। মেয়েরা দশ পাউন্ডেরগুলি নিয়ে ব্যায়াম করে।
এইবারও এদের সাথে প্রতিযোগিতায় গেলাম না। শেষে হৃদযন্ত্রের মতন হাত যন্ত্রও বিদ্রোহ করতে পারে।
ট্রেডমিলে বুড়ি তখনও দৌড়াচ্ছে। গতির নড়নচড়ন নেই।
পাশে দেখি এক ভারতীয় ছেলে এখানে ওখানে টুটা ফুটা ব্যায়াম করছে। আমার চেয়েও দুরবস্থা। সে ট্রেডমিলে গিয়ে দৌড়াদৌড়ির ঝামেলাতেই যায়নি। পাঁচ পাউন্ডের ছোট ছোট দুইটা ডাম্বেল নিয়ে কিছুক্ষন লিফটিং করে হাঁপিয়ে গেল। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে এমন ভাব নিল যেন টাইগার শ্রফের মাসল বানিয়ে ফেলেছে। আহ! একেইতো খুঁজছিলাম! কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে পাশে পেলেই না ব্যায়াম করে আনন্দ।
আমি তাঁর পাশে হৃত্বিক রোশনের ভাব নিয়ে ব্যায়াম করতে লাগলাম। Pec dec ফ্লাই মেশিনে গিয়ে কিছুক্ষন কেরামতি করলাম। রোয়িং মেশিনও কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করলাম। ও এখনও আড়াই পাউন্ডের ডাম্বেল নিয়ে হাপাচ্ছে। বুড়ি এখনও ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে।
কয়েক মিনিটের মাথায় ছেলেটি গোসল করতে চলে গেল। বুড়ির পাশে আমার যে অবস্থা হয়েছিল, আমার পাশে বোধয় তাঁরও একই অবস্থা হয়েছিল। ওর মনের মিলখা সিংও হয়তো গান গাচ্ছিল, "আব তু নিকাললে মিলখা। পাতলী গালি পাকারলে মিলখা।"
বুঝিয়ে দিল, বলিউডের নায়ক হৃত্বিক রোশন, টাইগার শ্রফ হলেও, ওদের আমজনতাও আমাদের রুবেল, সোহেল রানা, জসিম।
এর পরেও কয়েকদিন ঐ সময়ে গিয়েছি ঐ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করতে। খুঁজেই পাই নাই ভাইজানকে। প্রতিবারই দেখি ঐ বুড়ি ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে। ভাগ মিলখা ভাগ সিনেমাটা কী সেও সাবটাইটেল দিয়ে দেখেছে নাকি? সিনেমাটাকে দেখি সে সিরিয়াসলিই নিয়ে নিয়েছে।
দুই বছর হতে চললো জিমে যাওয়া হয়না। যাওয়া হয়না বললে ভুল বলা হবে। দুপুরের দিকে শুধু গোসল করতে যাই। ভাবছি আবারও ব্যয়াম শুরু করবো। বুড়ি এখনও সমান তালে দৌড়ে নাকি কে জানে! সে কতটা "বুড়ি" হলে একদিন আমি তাঁকে দৌড়ে হারাতে পারবো, সেটাওতো জানতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৩৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×