মূর্খের সমস্যা হচ্ছে সে যে কিছুই জানেনা তা সে প্রকাশ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। যেমন ওর কাছে কোন একটি তথ্য দিন, যার সম্পর্কে ওর কোন ধারণাই নাই, সে করবে কি তথ্যটি সত্য নাকি মিথ্যা, সেটা যাচাই বাছাইয়ে না গিয়ে সেই তথ্যটি মানুষের কাছে প্রচার শুরু করে দিবে। ওর ধারণা হয়, এতে বুঝি লোকে ওকে জ্ঞানী ভাববে। অথচ, ভুল তথ্যটির মাধ্যমে ও যে নিজের অজ্ঞতাকে সবার সামনে তুলে আনছে, সেটাই সে বুঝতে পারেনা।
যেমন নজরুল-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক গু-জবের একটি হচ্ছে, তাঁদের মাঝে সম্পর্ক ভাল ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ষড়যন্ত্র করে নিজে নোবেল পেয়ে গেছে, এবং নজরুলকে পেতে দেয়নি। এবং ষড়যন্ত্র করে নজরুলকে অসুস্থ করে ফেলেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পান, নজরুল তখন মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোর। নাক টিপলে দুধ বেরোয়। কেউ জানেই না পৃথিবীতে কাজী নজরুল ইসলাম নামেরও কেউ আছে। ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নোবেল পেয়ে যাওয়াতো অনেক দূরের কথা। উল্টো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। যা ঠাকুর পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই রবির কাছের অনেক কবি সাহিত্যিক ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, কারন ওদের দৃষ্টিতে নজরুলের কবিতায় কোন "রস" ছিল না। রবীন্দ্রনাথ উল্টো ওদের তিরস্কার করে বলেছিলেন, "তোমরা ওর কবিতায় রস অনুসন্ধানই করো না, কেবল দৃষ্টি বোলাও।"
নজরুলকে বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গের মূল কারন ছিল রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন নজরুলের কবিতা যুবসমাজে বসন্ত এনেছে। তিনি এও বলেন, তিনি তরুণ হলে তাঁর কবিতার ভাষাও ওর মতোই হতো।
নজরুলও তাঁর সঞ্চিতা কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।
এছাড়াও তাঁদের সম্পর্ক ছিল গুরুশিষ্যের মতন, স্নেহ-ভালবাসার। জীবনে বহুবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে, প্রতিবারই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কাছে টেনে বিশেষ মর্যাদা দিতেন। এমনকি শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে থাকবারও আহ্বান করেছিলেন। নজরুল শৃঙ্খলে বদ্ধ জীবন চাননি বলেই তেমন ঘটেনি। এবং নজরুলের এই স্বভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ স্নেহের বশে তাঁকে "পাগলা" বলতেন।
রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতা ও ভাষার ব্যাপারে বলতেন, "লেখা যেন না থামে। যোদ্ধা বহু পাওয়া যাবে, কিন্তু যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার মতন কবিওতো চাই।"
এবং রবীন্দ্রপ্রয়াণে নজরুলের নিজ হাতে লেখা ও কণ্ঠে আবৃত্তি করা তাঁর "রবিহারা" কবিতায় তাঁর আকুলতা টের পাওয়া যায়। পুরো কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশমান। কিছু পঙ্ক্তি এমন,
"তোমার গরবে গরব করেছি, ধরারের ভেবেছি সরা;
ভুলিয়া গিয়াছি ক্লৈব্য দীনতা উপবাস ক্ষুধা জরা।
মাথার উপরে নিত্য জ্বলিতে তুমি সূর্যের মত,
তোমারি গরবে ভাবিতে পারিনিঃ আমরা ভাগ্যহত।
এত ভালোবাসিতে যে তুমি এ ভারতে ও বাংলায়,
কোন অভিমানে তাঁদের আঁধারে ফেলে রেখে গেলে,
হায়।
বল- দর্পীর মাথার উপরে চরন রাখিয়া আর
রখা করিবে কে এই দুর্বলের সে অহংকার?"
আরও অনেক কিছু লেখা সম্ভব। কোন কোন কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে উদ্দেশ্য করে কি কি লিখেছেন, সেটার জবাব নজরুল কিভাবে দিয়েছেন থেকে শুরু করে তাঁদের মধ্যকার সাধারণ চিঠি বা কথাবার্তা ইত্যাদি সব উল্লেখ করতে গেলে এ লেখা বিশাল হয়ে যাবে। ওসব আপনারা নিজেরাই একটু কষ্ট করে পড়ে নিবেন।
আজকে বরং প্রিয় কবির আরেক বিষয়ে ফোকাস করা যাক।
কাজী নজরুল ইসলাম যখন বেঁচে ছিলেন, তখন বেচারার সমস্যা ছিল এই যে মোল্লারা তাঁকে ডাকতেন কাফের, এবং হিন্দুরা বলতো যবন। যেহেতু তিনি বিলেত ফেরত ছিলেন না, তাই বিদ্বানরা তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার দৌড় নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো।
পুরুষেরা গালি দিত, তিনি নাকি প্রচন্ড নারীঘেঁষা, এবং নারীরা তাঁকে জ্ঞান করতো নারী বিদ্বেষী হিসেবে।
তাঁর কবিতায় উর্দু ফার্সি শব্দের ছড়াছড়ি ছিল, ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি, তাই পন্ডিতরা তাঁকে নিয়ে করতেন সমালোচনা, "শনিবারের চিঠিতে" চলতো হাসাহাসি।
শুধু এই না, ইংরেজরা যে তাঁকে জেলে ভরে দিত, সেটাতো আমরা সবাই জানি, কিন্তু যারা স্বরাজ আন্দোলন করতেন, তাঁরাও যে ধরে নিতেন কবি কাজী একজন পাজি, যে স্বরাজেতে নিমরাজি, এইটা কয়জন জানেন?
মোট কথা, তখনকার যুগে, সেই সমাজে যত রকমের উপগোত্র ছিল, সবাই ছিল এই কবির উপর খ্যাপা। সবাই তাঁর দোষ ধরতেন, গালাগালি করে দূরে ঠেলে দিতেন।
তারপরে তিনি হলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। জীবিতাবস্থায় যে সম্মান আর ভালবাসা তাঁর প্রাপ্য ছিল, বোধশক্তি হারানো ও দৈহিক মৃত্যুর পরে সেটা পেলেন।
তবে সমস্যা এখনও দূর হয়নি। দৃশ্য উল্টে গেছে, তবু লেন্সের ফোকাস জুম আউট করলে বুঝা যায়, মূল চিত্র পাল্টে যায়নি।
সে যুগে নাস্তিকরা তাঁকে আস্তিক বলে গালাগাল করলেও বর্তমান নাস্তিকরা দাবি করে নজরুল ছিলেন ধর্মবিদ্বেষী। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যে লোক জিন্দেগীতে নজরুলের একটি কবিতাও পড়েনি, সে তাঁরই কবিতার এক দুইলাইন কোট করে বলে, এই যে দেখুন, নজরুল এই যুগে জন্মালে কোপ খেতেন। উদাহরণ,
"বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!"
কিংবা,
"মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।"
প্রথম উক্তিটি কবির "খালেদ" কবিতা থেকে নেয়া। "খালেদ" মানে আমাদের মুসলিমদের অতি প্রিয় খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ), সাহাবী, ইসলামের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা জেনারেল, বিশ্ব বিজয়ী বীর। যাকে নবী (সঃ) ভালবেসে নাম দিয়েছিলেন "আল্লাহর তরবারি।" এই কবিতাটি সেই মহাবীরের প্রতি একজন "সিপাহী" কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য। পুরো কবিতা পড়লে যে লোক দাবি করছিল/করে/করবে যে নজরুল ধর্মবিদ্বেষী কিংবা নাস্তিক, সেই একই লোক বলবে, "এই কবিতো জঙ্গি! জিহাদের ডাক দেয়! তরবারি হাতে শহীদ হতে চায়!"
দ্বিতীয় কবিতাটি কবির "মানুষ" কবিতা থেকে নেয়া। বিশ্ব সাহিত্য রত্নভাণ্ডারে এমন হীরা কোহিনূর দ্বিতীয়টি আছে কিনা কে জানে! সাতদিন ধরে ক্ষুধার্ত এক ভুখারীর আর্তনাদ এই কবিতার চরণে ফুটে উঠেছে। একবার শুধু পড়ে দেখুন। যদি "মানুষ" হয়ে থাকেন, আগামী হাজার বছর পরেও এই কবিতা পাঠককে মানসিকভাবে ভীষণ নাড়া দিবে, আবেগ ছিন্নভিন্ন করে দিবে, চোখের বাঁধে বিস্ফোরণ ঘটাবে। উপরে উল্লেখিত চরণগুলির ঠিক পরের লাইনগুলোই পড়ুন,
"আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির, —বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে বাজে।
আমরা তাদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ।
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি কে জানে কে আছে
আমাতে মহামহিম।"
এরপর শুধু পড়তে থাকুন, এবং অবাক হয়ে ভাববেন এ কি লিখে গেলেন কবি! আমরা কেন কখনও এইভাবে ভেবে দেখিনা! কবিতাটিতে নবীজির এক বিখ্যাত হাদিসের উল্লেখ আছে, কবি বলছেন, "তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়/ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!" এটুকু পড়ে আস্তিক লোকে গালাগালি করতে পারে শুনে। বলে কি ব্যাটা! দুনিয়ার সব মন্দির মসজিদ গির্জা নাকি একটি মানুষের ক্ষুদ্র দেহের সমান নয়!
কিন্তু সুনান ইবনে মাজায় বর্ণিত হাদিস বলে, এই যে মহাপবিত্র কাবা ঘর, যার সমকক্ষ পবিত্র আর কিছুই নয় মুসলিমদের কাছে, সেটিও মানুষের প্রাণের তুলনায়, জান মালের তুলনায় সমকক্ষ নয়। মূল ভাব হলো, একটি মানুষকে অকারনে হত্যা করা, তাঁর জানমালের ক্ষতি করা, তাঁকে কষ্ট দেয়া, তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটানো, কাবা ঘরে হামলার চাইতেও গর্হিত কাজ।
মূর্খেরা তর্ক করতে পারে, নবীজি বলেছেন "মুমিনের প্রাণ/জান/মাল" আপনি বা নজরুল কেন বললেন, "মানুষ"?
তা এই মূর্খ কি এই তর্ক করার আগে এই প্রশ্নের উত্তর দিবে, কে মুমিন, কে মুনাফেক ইত্যাদি বিচারের দায়িত্ব কি আল্লাহ একে দিয়েছেন? সে কি মানুষের অন্তরে কি আছে জেনে বুঝে ফেলেছে?
যদি আমরা এই সহজ সত্যটাই বুঝতাম!
এবং তা বুঝিনা বলেই কবিতাটি শুরু হয় দুই ভন্ডের ভণ্ডামি দিয়ে, মন্দিরের পূজারী ও মসজিদের মোল্লা, একজন ক্ষুধার্তকে তাড়িয়ে দিয়ে ভজনালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে শিরনি/প্রসাদ নিয়ে বাড়ি চলে যায়। খোদার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে লাথি দিয়ে এরাই দাবি করে এরা খোদার আপনজন!
মোট কথা, যারা দাবি করে নজরুল নাস্তিক ছিলেন, ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন, এরা জীবনেও তাঁর লেখা পড়েনি। পড়েনি তাঁর লেখা ইসলামী গজল, গান, কবিতাগুলো। পড়েনি তাঁর "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ" "অনাগত" সহ অসংখ্য কবিতা। নজরুল সমস্ত জীবন আরাধনা করে গেছেন "শহীদ" হবার মধ্য দিয়ে পৃথিবী ছাড়তে, এই কথা অস্বীকার করবে কিভাবে? "আমপারা কাব্য" নামে কুরআন শরীফের শেষ অধ্যায়টি যে এই কবি আস্ত তর্জমা করে ফেলেছেন, এবং এজন্য তাঁকে প্রচন্ড পরিশ্রম করে একই সাথে আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখতে হয়েছে, তা এরা জানেই না।
এবং এ সূত্র ধরেই একবার এক মোল্লা আমাকে বললেন, "নজরুলের রেফারেন্স নেয়া উচিৎ না। তাঁর ঈমানের ঠিক নাই।"
আমি বলেছিলাম, "তাহলে উনার সমপর্যায়ে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী লেখা কেউ লিখেছেন কিনা আমাকে জানান। একশো বছর পেরিয়ে গেল, বাংলার এত এত মুসলিম সাহিত্যিক "রমজানের ঐ রোজার শেষে" বা "তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে" কিংবা "ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ" গানগুলোর বিকল্প তৈরী করতে পারলো না, আর আপনারা ফতোয়া দিয়ে দিচ্ছেন তাঁর ঈমানের ঠিক নাই?"
নজরুলের জীবনকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমেরই এই ধারণা ছিল। তাঁর কাব্যে দেবদেবীর নাম উল্লেখ করা হয়, কাজেই তিনি মুমিন হতেই পারেন না। তাছাড়া বিয়েও করেছেন হিন্দুকে। যদিও তাঁর মতে হিন্দু নয়, আহলে কিতাবী হিসেবে বিয়ে করেছিলেন। এ নিয়ে তর্কে গিয়ে লাভ নেই। টপিক পাল্টে যাবে।
এখন আবার উল্টো দৃশ্য। লোকজন দাবি করেন তিনি এক্সক্লুসিভলি ইসলামের কবি। এরপক্ষে রেফারেন্সের অভাব নেই। আগেই বলেছি, তাঁর পর্যায়ে ইসলামিক কবিতা বাংলার কোন বাপের ব্যাটা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি, পারবেও না। সেই ভাষা, সেই অলংকারই গত হয়েছে বহুদিন হলো। তবে ওরা যেটা ভুল করে তা হচ্ছে, নজরুলের আরও অন্যান্য সাহিত্যকর্মকে তাঁরা ঢেকে রাখেন। "আনন্দময়ীর আগমন" "শ্যামা সংগীত" ইত্যাদি থেকে নজরুলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তিনি যে হিন্দু রমণী বিয়ে করেছিলেন, সেটাও চেপে যান। এইটাওতো আরেক পর্যায়ের এক্সট্রিমিজম।
ধর্ম থেকে সরে রাজনীতিতে আসা যাক।
এই কথা আমরা সবাই জানি যে নজরুল ছিলেন ইংরেজদের জুলুম বিরোধী। কিন্তু এও সত্য, একই সাথে তিনি স্বরাজীদেরও চাঁদা আদায়ের বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে ভারতে যেখানে কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে মরছে, সেখানে "স্বরাজ এনে দেব" - প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদের কাছ থেকেই টাকা তুলে নেয়া নজরুল সমর্থন করতেন না। তিনি নিজে দেখেছেন ক্ষুধার্ত মা তাঁর শিশুদের না খাইয়ে সেই টাকা তুলে দিয়েছেন নেতাদের হাতে। তিনি দেখেছেন বাড়িতে ছেলের লাশ ঢেকে রেখে মা গিয়েছেন ভিক্ষা করতে। এইসব দৃশ্য তিনি নিতে পারতেন না। রক্তে বিদ্রোহী সৈনিক হলেও, একজন বীর যোদ্ধা হলেও, তিনিইতো ছিলেন একজন প্রেমিক কবি। মানব প্রেমকে নিজের আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন কিভাবে? তাঁর নিজের ভাষায়, "বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।" (আমার কৈফিয়ৎ)
সাহিত্যিকরা তাঁর কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতো। মর্মাহত হয়ে তিনি প্রেমের গান/গজল লেখা শুরু করেন। এই সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই বলেন, "ঈশ্বর তোমাকে তলোয়ার দিয়েছেন যুদ্ধ লড়তে, আর তুমি কিনা তা দিয়ে দাড়ি কামানো শুরু করে দিলে?"
গুরুর স্নেহে কবি আবারও তাঁর মনোবল খুঁজে পান। তাঁর হাত ধরে আবারও ঝলসে উঠে তলোয়ার। কণ্ঠ পায় নিপীড়িতের আর্তনাদ।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের আসল পরিচয়টা তবে কি? তিনি বিদ্রোহী? তিনি প্রেমিক? তিনি আস্তিক? তিনি নাস্তিক? স্বদেশী? বিদেশির গোলাম? তিনি কী?
উত্তরটা তিনিই দিয়েছেন "রাজবন্দীর জবানবন্দি"তে। যেখানে তিনি বলেন তাঁর ভগবান হচ্ছে "ন্যায়।" তিনি ন্যায়ের পক্ষে কণ্ঠ তুলে গেছেন, তিনি অন্যায়ের বিরোধিতা করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি যা বলেন, তা তাঁর হয়ে ভগবান/ঈশ্বর/খোদা তাঁকে দিয়ে বলান। তিনি বিশ্বাস করেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসামির কাঠগড়ায় তাঁকে যখন দাঁড়াতে হয়, তাঁর পেছনে পরমকরুনাময় ঠিক সেভাবেই থাকেন যেভাবে তিনি ছিলেন যীশু বা গান্ধীর সময়ে।
পবিত্র কোরান পড়ুন। আল্লাহ বলেছেন ন্যায়ের ব্যাপারে আপোষ না করতে। নিজের বিরুদ্ধে যেতে হলেও যেতে। আল্লাহই ন্যায়। ন্যায়ের পক্ষে থাকলে গোটা পৃথিবী আপনার বিরুদ্ধে গেলেও আল্লাহকে পাবেন। অন্যায়ের পক্ষ নিয়ে গোটা পৃথিবীর মালিক হয়ে গেলেও আল্লাহকে হারিয়ে ফেলবেন।
নজরুল কোন মহান সাহিত্যকর্ম, সাহিত্যের সেবা, মহাকাব্য রচনা, কিংবা সাহিত্য জগতে নিজের নাম চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে কলম ধরেননি। তিনি বলেছেন, ওটা তাঁরাই করুক, যারা সুখে শান্তিতে থাকেন। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের ব্রত ছিল একটিই, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান এবং জালিমের সর্বনাশ ঘটানো। কাজী নজরুল ইসলামকে তাই বিশেষ কোন বিশেষণে বিশেষায়িত না করে এইভাবেই গ্রহণ করতে শিখুন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি, তাই দোহাই লাগে, নজরুল রচনাবলী একবার হলেও পড়ুন। ভাবুন। এতে লাভ ভিন্ন ক্ষতি হবে না।
যে কারনে এত দীর্ঘ লেখা লিখলাম, তা হচ্ছে, আমাদের হতভাগা গ্রূপটির ভাগ্যও এই কবির সাথে মিলে যায়।
নাস্তিক বলে আমরা ছাগল পুষি, ছাগলের রাখাল বলে আমাদের তারা ডাকে "ছাখাল।"
আর ছাগু বলে আমরা মডারেট/সুশীল, নাস্তিকদের পেইড এজেন্ট, ইহুদি নাসারাদের পেইড এজেন্ট। মানে আমি বুঝিনা, কার এত টাকা আছে আর আজাইরা সময় আছে যে কাউকে এমন লেখালেখির জন্য পয়সা দিবে, মানে, ব্রেইন কতটা ডিফেক্টিভ হলে লোকে এমন আজাইরা চিন্তাভাবনাও মনে আনে!
দুই পক্ষের গালাগালির ভিড়ে লোকে ভুলে যায়, যখন ওর বিরুদ্ধে কোন অন্যায় হয়, তখন এই গ্রূপটাই সবার আগে ওর পাশে দাঁড়ায়, এবং সে যদি অন্যায়কারী হয়, তবে তার বিরুদ্ধে। ক্যানভাস কখনই অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয় না। এজন্য যার বিরুদ্ধেই যেতে হোক না কেন।
আমাদের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির জন্মবার্ষিকীতে নিজেদের কথা টেনে আনলাম বলে দুঃখিত। শুধু এইটুকু বুঝাতে চাই, আমরা তাঁকে মননে ধারণ করতে চেষ্টা করি।
প্রিয়তম কবি কাজী নজরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করছি, এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। লিখে দিতে পারি, আসানসোলের দুখু মিয়া যদি পৃথিবীতে না আসতেন, তবে সম্পদশালী বাংলা সাহিত্য তাঁর বিপুলাংশের ঐশ্বর্য্য, স্বর্ণ রৌপ্য মনিমুক্তা ভান্ডার হতে বঞ্চিত হতো নিশ্চিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৩ রাত ১০:০২