একটা সময়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের ফরম্যাট এমন ছিল যে প্রথম তিরিশ-চল্লিশ ওভার পর্যন্ত ব্যাটসম্যানরা দেখেশুনে খেলবে, তারপরে উইকেট হাতে থাকলে ধুমধাম মেরে কেটে স্কোর লম্বা করবে। সেই সময়ে ভিভ রিচার্ডস এবং দুয়েকজন এদিক সেদিক বাদে মোটামুটি সব গ্রেট ব্যাটসম্যানই ছিলেন এমন। ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট আশির উপরে মানে সবার চোখ কপালে উঠে যেত। নব্বই হলেতো কথাই নাই।
শ্রীলংকা দলেও সনৎ জয়সুরিয়া এবং রমেশ কালুভিথারানার রোলও তেমনই ছিল, শেষের দিকে এসে দ্রুত রান তুলে বিদায়। ওদের থেকে মানুষের আশা প্রত্যাশা তেমন বেশি কিছু ছিল না।
ওদের ভাগ্য ভাল ছিল যে ওদের ক্যাপ্টেনের নাম ছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গা। এইরকম ক্রিকেট ব্রেনওয়ালা ক্যাপ্টেন সেই নব্বইয়ে শুধু হান্সি ক্রনিয়ের মধ্যেই পেয়েছিলাম। ইন ফ্যাক্ট, ওর পর্যায়ের ক্যাপ্টেন এখনও আমার মনে হয় কেউ আসতে পারেনি। আমি নিশ্চিত, আমার বয়সী বা আমার চেয়ে বড়রা, যারা সেই সময়ের সাউথ আফ্রিকার খেলা দেখেছেন, দলটাকে পছন্দ করুক বা ঘৃণা, চোখ বন্ধ করে বলবে, হ্যা, তাঁদেরও দেখা সবচেয়ে প্রতিভাবান, বিচক্ষণ, স্ট্রিট স্মার্ট, দুর্দান্ত অধিনায়কের নাম হ্যান্সি ক্রনিয়ে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্থান থেকে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পাতালে পতন - ক্রনিয়েকে নিয়ে আমার ভালবাসা, মান অভিমান ইত্যাদি নিয়ে লেখার অনেক কিছু আছে। একদিন সময় হলে অবশ্যই লিখবো ইন শা আল্লাহ। আপাতত রানাতুঙ্গাকে নিয়ে কিছু বলি।
তা রানাতুঙ্গা খেয়াল করলেন জয়সুরিয়া শেষের দিকে এসে কেবল বাউন্ডারিতে ক্যাচ আউট হচ্ছে। ও বেচারার কিছুই করার নাই। হাতে বল থাকে কম, ওর রোলটাও পিঞ্চ হিটিংয়ের। তাই, প্রতি বলেই ওকে তুলে মারতে হয়। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে না, "লাগলে বাড়ি বাউন্ডারি, না লাগলে আউট!" ওর ব্যাটিং স্টাইলটাই ছিল তেমন।
রানাতুঙ্গা তখন কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সাথে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন জয়সুরিয়া এবং কালুভিথারানাকে ওপেনিংয়ে নামাবেন।
তখন ফিল্ড রেস্ট্রিকশন ছিল পনেরো ওভার পর্যন্ত। ম্যাচের প্রথম পনেরো ওভার সার্কেলের বাইরে কেবল দুইজন প্লেয়ার থাকতে পারবে। জয়সুরিয়া যেহেতু বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিয়ে আউট হচ্ছে, প্রথম পনেরো ওভারের ঐ সময়টাতে সেগুলোই বাউন্ডারি হবে।
জুয়া? অবশ্যই। বিরাট বাজি ধরা হচ্ছে। সামনেই বিশ্বকাপ, এখন এইসব নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার সময়টাই নাই। তারপরেও, যদি ভাগ্য সহায়তা করে, যদি চাল ঠিক মতন কাজ করে, তাহলেই বাজিমাৎ! প্রতিপক্ষ কোন কৌশল খুঁজে বের করার আগেই বিশ্বকাপ ট্রফি শ্রীলংকার ড্রেসিং রুমে শোভা পাবে।
হোয়াটমোরের কাছে দারুন লাগলো আইডিয়াটা। অতি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত!
আপত্তি জানালো খোদ জয়সুরিয়া এবং কালুভিথারানা। তাঁদের ভয়, এতে করে তাঁদের ক্যারিয়ারই ধ্বংস হয়ে যাবে। ওপেনিংয়ে নামলো, পিটাতে গিয়ে আউট হয়ে গেল, তারপর? অফ ফর্মের কারনে দল থেকেই ওদের বিদায় করে দিবে না?
রানাতুঙ্গা বললেন, "তোমাদের ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। তোমরা আমার নির্দেশ মেনে খেলতে নামো। যদি আউট হয়ে যাও, চিন্তা করো না, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।"
ক্যাপ্টেনের এই কনফিডেন্স, এই নিশ্চয়তা পেয়ে সনৎ জয়সুরিয়া এবং রমেশ কালুভিথারানা ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন।
বাকিটা ক্রিকেটের দিন বদলের ইতিহাস।
নব্বইয়ে প্রতিটা দলের ওপেনিং বোলারদের নামগুলি একটু বলি, মোটামুটি প্রত্যেকেই লেজেন্ড। ওয়াসিম-ওয়াকার-আকিব জাভেদ, ওয়ালস-এম্ব্রোস-বিশপ, ম্যাকগ্রা-ফ্লেমিং, ডোনাল্ড-পোলক, জাভাগল শ্রীনাথ - এমনকি জিম্বাবুয়েতেও ছিলেন হিথ স্ট্রিক - সাথে যোগ করেন পিচ যেখানে বাউন্স, সুইং, সিম ইত্যাদি থাকতো। সেই সব বোলাররা শ্রীলংকার বিপক্ষে বল করতে নামার সময়ে কলিজা হাতে নিয়ে নামতো। ভাল বল মন্দ বল ইত্যাদির কোন দেখাদেখি নাই, এরা একটা মিশনেই খেলতে নামতো এবং সেটা হচ্ছে প্রথম বল থেকেই প্রতিপক্ষের কনফিডেন্সের মাম্মি ড্যাডি এক করে ফেলা। ওদের কেউ আউট হলে মাঠে নামতো আসাংকা গুরুসিন্হা। তারপরে সব ব্যাটসম্যানদের বস, অরবিন্দ ডি সিলভা। এরপরে রানাতুঙ্গা স্বয়ং, রোশন মহানামা, হাসান তিলকারত্না। সময়ে সময়ে ব্যাট ঝলসে উঠতো চামিন্ডা ভাসেরও। তখনকার ওয়ানডে ক্রিকেটে যেখানে আড়াইশো রানকেও অনেকে সেফ মনে করতো, শ্রীলংকা একবার ৩৯৮ করে ফেলল। তিনশো রান তোলা ওদের জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। সাত-আট পর্যন্ত ব্যাটসম্যান, ওদের ঘাবড়াবার কি কিছু ছিল? মঙ্গোল যোদ্ধারা যেমন যুদ্ধের আগেই প্রতিপক্ষের ভয়ের কারনে জিতে যেত, শ্রীলংকার অবস্থাও সেটা ছিল।
ফল, ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। কেউ ওদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি।
এবং সনৎ জয়সুরিয়া জিতলেন টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার।
রানাতুঙ্গার সেই টেকনিক এবং এর সফলতা ওয়ানডে ক্রিকেটকেই বদলে দিল। পাকিস্তান দলে ঢুকে পড়লো শহীদ আফ্রিদি। যদিও স্পিনার হিসেবে এসেছিল, কিন্তু নেটে ওর মারধরের স্টাইলে মুগ্ধ হয়ে ওয়াসিম আকরাম ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক সাঈদ আনোয়ারকে বলেন ওকে উপরের দিকে খেলাতে। নেমেই সাঁইত্রিশ বলে সেঞ্চুরি, সেই শ্রীলংকার বিপক্ষেই। পাকিস্তানের ডু-অর ডাই ম্যাচে মহাশক্তিশালী শ্রীলংকাকে রানরেটের ব্যবধানে হারাতে অমন একটা মিরাকেলেরই প্রয়োজন ছিল। ঐ ইনিংসের পরেই আফ্রিদি ওপেনিংয়ে নামতে শুরু করে। লোকে দীর্ঘদিনের জন্য ভুলে যায় ও আসলে একজন বোলার।
ইন্ডিয়ার কাছে দীর্ঘদিন কোন জবাব ছিল না। নানানভাবে এক্সপেরিমেন্ট করলো, লাভ হলো না।
এরপরে আবির্ভাব ঘটে বীরেন্দ্র সেহওয়াগের। দূর থেকে দেখে বুঝার উপায় ছিল না কোনটা টেন্ডুলকার, কোনটা সেহওয়াগ। কিন্তু ব্যাটিং দেখলেই বুঝা যেত এইটাই ইন্ডিয়ার নতুন মাল। টেন্ডুলকার টেক্সটবুক ক্রিকেট খেলতো তো সেহওয়াগ কি খেলতো ওই ভাল বলতে পারবে। ক্রিকেটের সাথে টেনিস, ব্যাডমিন্টন, হকি, বেসবল সব মিলায়ে একটা কিছু। পা নড়েনা এক ইঞ্চিও, অথচ নিখুঁত টাইমিং! ওপেনিংয়ে যে বিস্ফোরকের সন্ধানে ইন্ডিয়া ছিল, সেটা ওরা পেয়ে গেল।
নাক উঁচু অস্ট্রেলিয়াও তাঁদের দলে পরিবর্তন আনলো। এতটাই যে ওরা আরেক ধাপ উপরে উঠে টেস্ট ও ওয়ানডের জন্য দুইটা আলাদা দল ঘোষণা দিয়ে দিল। ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়লো ওদের অন্যতম গ্রেট মার্ক টেলর, যিনি কিনা একই সাথে অধিনায়ক ও ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন। ওদের সর্বকালের সর্বসেরা উইকেট কিপার ইয়ান হিলিও টেস্ট দলে স্থায়ী হলেন - এবং এই দুইজনের অভাব পূরণের পাহাড়সম দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামতে হলো তরুণ এডাম গিলক্রিস্টকে।
তো যা বলছিলাম, এখন পৃথিবীর সব দেশই ওয়ানডে ম্যাচের একদম প্রথম বল থেকেই বোলারদের উপর চড়াও হয়। শুরুটা বিচ্ছিন্নভাবে এই ঐ দল করলেও একে চিরস্থায়ী বাঁক বদলে ভূমিকা রাখে শ্রীলংকা।
তেমনই এখন বাজবল নিয়েও টেস্ট ক্রিকেটে তুমুল আলোচনা চলছে। টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা মুনি নানান মত নিয়ে হাজির হলেও কারোরটাই ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। তারপরে ইংল্যান্ড যখন বাজবল ক্রিকেট শুরু করলো, তখন থেকে মঞ্চের সব আলো ইংল্যান্ডের উপর। এতটাই যে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের চাইতেও মানুষের উৎসাহ আর প্রত্যাশা তখন এশেজের দিকে। অস্ট্রেলিয়া কি পারবে ইংল্যান্ডের বাজবল ক্রিকেটের জবাব দিতে?
ম্যাচের প্রথম বলেই ক্রাউলি বাউন্ডারি দিয়ে শুরু করে। তারপরে প্রথম দিনেই অমন অবস্থান থেকে ডিক্লেয়ার দেয়া। শেষ পর্যন্ত যদিও সেটাই ব্যাকফায়ার করে, কিন্তু স্টোকসের প্ল্যানটা আসলেই দারুন ছিল। কোন ব্যাটসম্যানই দিনের একদম শেষ আধাঘন্টা ব্যাট করতে পছন্দ করে না। ওপেনাররাতো নয়ই। অস্ট্রেলিয়া কি তবে নাইট ওয়াচম্যান দিয়ে ওপেনিং করাবে? নতুন বলে ইংল্যান্ড যদি একটি উইকেট তুলে নিতে পারতো, এবং তারপরে নাইট ওয়াচম্যানের উইকেট - তাহলে এই টেস্টের কাহিনী ভিন্ন হতো নিশ্চিত। তবে এইটাই ক্রিকেট। আপনি এক প্ল্যান করে আসবেন, ঘটবে ভিন্ন কিছু।
স্টোকসের এমন চিন্তাভাবনা, ব্র্যান্ডন ম্যাকালামের সাথে তাঁর জুটি সেই নব্বইয়ের রানাতুঙ্গা-হোয়াটমোর এবং ক্রনিয়ে-উলমারের জুটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে বাজবল, তারপরে ব্রামব্রেলা ফিল্ডিং, অমন পাটা উইকেটেও নেইল বাইটিং ফিনিশিং - সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট আইসিইউ থেকে ফিরে এসেছে। প্রথম ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া বলেই জিততে পেরেছে - অন্য যেকোন দল হলেই ঘাবড়ে যেত, হাল ছেড়ে দিত। প্রশ্ন হচ্ছে, একই ঘটনা ওরাই বা কতবার ঘটাতে পারবে?
অনেকদিন পর এই প্রথম কোন টেস্ট ম্যাচের প্রতিটা সেশনে মানুষ স্কোর বোর্ডের দিকে নজর রেখেছে। না জানি কোন নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে স্টোকস! এইটাইতো দরকার ছিল।
আশা করি অন্যান্য দলগুলোও বাজবল ক্রিকেটের দিকেই ঝুঁকবে। পাঁচদিনের লড়াই শেষে ড্র হওয়া ঝিমানো টেস্টম্যাচের রাজত্ব শেষ করতে এমন ভয়ডরহীন ক্রিকেটের কোন বিকল্প নাই।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০২৩ রাত ১০:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




