অনলাইন জগতে "সুষুপ্ত পাঠক" নামে একটা গরু আছে। এই গরু কোন কিছু ভ্যারিফিকেশন ছাড়াই যা মনে চায় তাই লিখে। সমস্যা হচ্ছে, এর পাঠকদের জ্ঞানও ওর মতোই, শূন্য। তাই এই গরুকে ওরা গুরুজ্ঞান করে।
তা কিছুদিন আগে এই গরু একটা পোস্ট করেছে যে ইসলাম ধর্মে নাকি ধর্ষণের কোন শাস্তি নাই। উল্টো ধর্ষিতাকে প্রমান করতে হয় সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চার সাক্ষী হাজির না করলে ওকে পেটানো হয়।
বরাবরের মতোই কোন পড়াশোনা খোঁজ খবর ছাড়াই সে এই স্ট্যাটাস প্রসব করেছে এবং পাবলিকও কোন পড়াশোনা খোঁজ খবর ছাড়াই সেটা শেয়ার করে দাবি করছে "দেখো, এছলাম কত খ্রাপ!"
ইসলাম ধর্মের আইনে যাওয়ার আগে আধুনিক বিশ্বের প্রচলিত আইন ব্যবস্থাতেই দৃষ্টি বুলানো যাক। আমেরিকার কথাই ধরি। আশা করি এদের আইনের প্রয়োগ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের কিছুটা হলেও আস্থা আছে। তা এই দেশেও যদি কোন মেয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে বলে ওকে রেপ করা হয়েছে, পুলিশ সাথে সাথে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে দেয়না। ভুল করেতো অবশ্যই, এদেশে অতি তুচ্ছ কারণেও অনেক মেয়ে ইচ্ছাকৃত ধর্ষণের অভিযোগ তুলে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে, কিংবা বয়ফ্রেন্ড অন্য মেয়ের সাথে লটরপটর করে, শায়েস্তা করতে রেপের অভিযোগ দিয়ে দেয়। তারপরে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে, যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলেতো শাস্তি হয়ই। আর যদি অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, তাহলে এই ছেলে অভিযোগকারী মেয়ের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারে।
এখন বলেন, দুই আইনে পার্থক্যটা কোথায় থাকলো?
আপনি বলতে পারেন, "ইসলাম চারজন চাক্ষুষ সাক্ষী চাইছে।" তা চার সাক্ষীর কনসেপ্ট হচ্ছে beyond reasonable doubt যেন অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কারন ইসলামে রেপের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কারোর অভিযোগ শুনেই পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করার পরে মেয়েটা বলল "স্যরি, আসলে ও রেপ করে নাই, করেছে তমুক।" তাহলে মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন?
মার্কিন আদালতও আপনার কাছ থেকে মিনিমাম "চার সাক্ষী" দাবি করবে। কোন সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ, ডিএনএ ম্যাচিং, ডাক্তারি রিপোর্ট, পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাহলে আমাকে বলেন, পার্থক্যটা কি? জীবনে আর কোন গরুর লেখা পড়ে চিন্তাভাবনা না করেই শেয়ার শুরু করবেন?
এখন আসি এই বিষয়ে ইসলাম আসলেই কি বলে।
ইসলামের নাম্বার ওয়ান সোর্স অফ ইনফরমেশন হচ্ছে কুরআন। কোন বিষয়ে খটকা লাগলে প্রথমেই আমরা কুরআন ঘাঁটবো। তারপরে সেখানে না পেলে হাদিস গ্রন্থ।
কুরআনে সূরা আল মায়েদের ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন "যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা (ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ ইত্যাদি, যা সমাজে কাউকে নিরাপদে চলতে ব্যাঘাত ঘটায়) সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।"
তা হাদিস হিসেবে আবু দাউদ গ্রন্থে একটি হাদিস উল্লেখ করা যাক। নবীর যুগে ঘটা একমাত্র ধর্ষণের ঘটনা। আগে হাদীসটি হুবহু উল্লেখ করি, তারপরে ব্যাখ্যায় যাব।
"নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে যখন একজন মহিলা নামাজের জন্য বাইরে বের হন, তখন এক ব্যক্তি তাকে আক্রমণ করে এবং তাকে জোর করে (ধর্ষণ) করে।
মহিলা চিৎকার করলে লোকটা পালিয়ে গেল, আর অপর একজন পুরুষ এলে সে বললো: ঐ ব্যক্তি আমার সাথে "এমন অমন" করেছে। আর যখন মুহাজিরদের একটি দল এলো, তখন সে বললো: ঐ ব্যক্তি আমার সাথে "এমন অমন" করেছে। তারা গিয়ে সেই ব্যক্তিকে ধরে তার কাছে নিয়ে এলো, যাকে তারা মনে করেছিল যে তার সাথে "সহবাস" করেছে এবং তাকে তার কাছে নিয়ে এলো।
সে বললো: হ্যাঁ, এই সে। তারপর তারা তাকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে নিয়ে এলো।
যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন, তখন যে ব্যক্তি (আসলে) তাকে নির্যাতন করেছিল সে দাঁড়িয়ে বললো: হে আল্লাহর রাসূল! আমিই সেই ব্যক্তি যে তার সাথে এটা করেছে।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহিলাকে বললেন: যাও, কারণ আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
কিন্তু তিনি লোকটিকে (যাকে প্রথমে ধরা হয়েছিল) কিছু ভালো কথা বললেন, এবং যে লোকটি তার সাথে সহবাস করেছিল, সে সম্পর্কে তিনি বললেন: তাকে পাথর মেরে হত্যা করো।
তিনি আরও বললেন: সে (আসামি) এত বেশি তওবা করেছে যে, যদি মদীনার লোকেরাও একইভাবে তওবা করত, তাহলে তাদের কাছ থেকে তা কবুল করা হত।" (আবু দাউদ ৪৩৭৯)
সহজ সরল হাদিস। নবীর (সঃ) মদিনায়, সাহাবী আর মুনাফেকে ঠাসা শহরে এক মহিলা ধর্ষণের শিকার হন। মহিলা যার নামে অভিযোগ করেন, পরে দেখা যায় সে ব্যক্তি নির্দোষ। আর আসল অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজে শিকার করে নেয়ায় ওকে শাস্তি দেয়া হয়।
বিচারে বসে নবীজি (সঃ) একবারও বলেন নাই "মাহরাম ছাড়া তুমি কেন বেরিয়েছিলে? এই মেয়ে এই! তোমার পর্দা কই? মাহরাম ছাড়া হজ্বও ফরজ না, আর তুমি বেরিয়েছো? তোমাকে আগে শাস্তি দিব, রেপিস্টকেতো দিবই।"
জ্বি, ভাইরাল মোল্লা আর রিয়েল আলেমে পার্থক্য এটাই। ভাইরাল মোল্লা এটা ওটা টুকটাক পড়াশোনা করে মুখস্ত বিদ্যা ঝাড়ে। ওয়াজ থেকে টাকা কামায়।
তা নবী (সঃ) মহিলার অবস্থা দেখে বুঝেছেন সে সত্য বলছে (সে একটা ভিক্টিম)। কিন্তু তা প্রমানের জন্য চার সাক্ষীর তলব কিন্তু করেন নাই। এটাও উল্লেখযোগ্য।
সাথে সাথে তাড়াহুড়া করে অভিযুক্তকে মৃত্যুদন্ডও দেননি, কারন মহিলা মানসিক ও শারীরিক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছেন। আসলেই লোকটি অপরাধী কিনা, সেটা সন্দেহাতীতভাবে তখনও প্রমাণিত হয়নি।
এবং বিচার চলাকালীন অবস্থায় এক ব্যক্তি বিবেকের তাড়নায় নিজের অপরাধবোধ থেকেই নিজ অপরাধ স্বীকার করে নিলে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। ভুল/মিথ্যা অভিযোগকারী রমণীকে বেত্রাঘাত করা হয়না (সুষুপ্ত গরু যেমনটা দাবি করেছিল), এবং অপরাধীকে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের রায় দেন।
এখন কেউ যদি বলে "এছলামে ধর্ষণের কোন বিচার নাই" তাহলে হাদিসে বর্ণিত ঘটনা কি নরেন্দ্র মোদির যুগে ইন্ডিয়ায় হয়েছে? স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) বিচার করেছেন, তিনি কুরআনের বিরুদ্ধে যাবেন? পাবলিকের ব্রেনটা কোথায় থাকে?
ইদানিং দেশে ধর্ষণের খবর খুব শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে। ভাইরাল মোল্লাও। সে নিজের স্বল্প জ্ঞানে যা জানে সেটা সে সাজেস্ট করেছে। যদিও সেটা ভিকটিম ব্লেমিং হয়ে গেছে, গ্যাং রেপকেও জাস্টিফাই করছে বলে মনে হয়, তবুও তার নিয়্যত ধর্ষণের বিরুদ্ধে, এইটা বুঝা যাচ্ছে। ওর সমাধান হচ্ছে, "মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখো। বাইরে না বেরোলে রেপ হবে না।"
মেয়েরা যে ঘরের ভিতরেই রেপ হচ্ছে, এই ব্যাপারে ভাইরাল মোল্লা নীরব।
সুষুপ্ত গরু কোন সমাধান সাজেস্ট করে নাই। ওর নিয়্যতই হচ্ছে "এছলাম ধর্মে ধর্ষণের বিচার নাই" - এইটা নিয়ে কিছুক্ষন এটেনশন পাওয়া। তা হয়তো সে পেয়েছেও।
আমার স্বল্পজ্ঞানে আমি যতটুকু বুঝি, ধর্ষণ সমস্যার সমাধান আমার আপনার নিজেদের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। বাইরে কঠিন শাস্তি আর ন্যায়বিচারের কোন বিকল্প নেই সত্য, কিন্তু পুরুষরা যদি ভিতর থেকে নিজেদের না শোধরে, আপনি নবীর মদীনাতেও ধর্ষণ আটকাতে পারবেন না। এইটাতো উপরেই প্রমান দিলাম।
আমি, আপনি, আমরা পুরুষেরা নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার পাশাপাশি আমার ভাই, আমার ছেলেদেরও শেখাবো মেয়েদের কিভাবে সম্মান করতে হয়। এবং "মেয়েদের সম্মান" করা শেখাতে আমাকে দূরে কোথাও যেতে হবেনা। সে নিজের মা, নিজের বোন, নিজের নানী, দাদি, খালা, ফুপু, চাচিদের সম্মান করতে শিখলেই দেশ থেকে ধর্ষণ বিদায় নিবে। আর এই সম্মান মানে শুধু দেখা হলে "আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ" বলা না, ওদের সাথে মিশতে হবে, কথাবার্তা বলতে হবে, এবং সবই হবে আদবের সাথে।
আমরা এমন একটা বাজে সমাজে বাস করি যেখানে স্কুলে বা খেলার মাঠে গেলে আজেবাজে ছেলেদের সাথে ওরা মিশবেই। বন্ধুবান্ধব ওদেরকে শিখাবে কিভাবে ক্লাসের সুন্দরী মেয়েটাকে "মাল" হিসেবে দেখতে হবে। মালটা যখন ভালোয় ভালোয় আমার হবেনা, তখন ওকে কিভাবে জোর করে ভোগ করতে হবে সেটা ঐ "মাল" মানসিকতাই শিখিয়ে নিবে।
অথচ বাড়িতে যদি এই একই ছেলে দেখে ওর বাবা ওর মাকে "একটি মাল" নয় বরং মানুষ, প্রেমিকা, অর্ধাঙ্গিনী, জীবন সঙ্গিনী হিসেবে সম্মান করছে, তখন ওর মন ওর দুষ্ট বন্ধুর পরামর্শকে রিজেক্ট করবে। ও চেষ্টা করবে সেই মেয়েটির মন জয় করার। হয়তো পড়ালেখায় ভাল করবে, নাহয় স্পোর্টসে, না হয় এসাইনমেন্টে সাহায্য করে মন জয়ের চেষ্টা করবে। আর যদি তারপরেও দেখে মেয়েটা ওকে ফেলে অন্য কাউকে পছন্দ করেছে, ছেলেটা হয়তো কষ্টে একা একা খুব কাঁদবে। কিন্তু তবুও সেই মেয়ের কোন অনিষ্ট সে করবে না।
আপনিই বলেন, আপনার ঘরে এমন কষ্টে কান্নায় ভেঙে পড়া ছেলে ভাল নাকি কোন কঠিন হৃদয়ের অমানুষ?