টুকরো - ৭, টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪ , টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১
বৃষ্টির প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙ্গে ছেলেটির। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, মুষলধারে পড়ছে বৃষ্টি। জানালার ফাঁক গলে ভেতরে এসে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ছাট। উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে সে। রুম অন্ধকার হয়ে যায়। লাইটটা জ্বেলে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে পাঁচটা বাজে। একটু পরই রিডিং রুমে যাওয়ার কথা।
ছেলেটি বিরক্ত হয় বৃষ্টির উপর। কি দরকার ছিল এখন আসার? আরেকটু পর এলে কি এমন সমস্যা হতো ওর? এ ধারা কতক্ষণ চলবে কে জানে? ক' দিন ধরে বৃষ্টি শুরু হলে থামা তো দূরের কথা, দু-তিন ঘন্টার মধ্যে আর কমারও কোন লক্ষণ দেখায় না। যে রকম শুরু হয়েছে, ছাতায় নিজেকেই বাঁচানো দায় হবে, তার উপর বইপত্র নিয়ে হোস্টেল থেকে কলেজ ভবনের রিডিং রুম পর্যন্ত যাওয়া তো অসম্ভব। ছেলেটি ভাবে, মেয়েটিকে ফোন করে বলে দেবে যে বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আসতে পারবে না, ও যেন রুমেই পড়া শুরু করে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় ছেলেটা। কিন্তু সে ফোন করার আগেই রিং বাজতে থাকে। মেয়েটা ফোন করেছে তাকে। ছেলেটি মনে মনে হাসে - টেলিপ্যাথি! মেয়েটিও একই কথা বলার জন্য ফোন করেছে তাকে?
ফোনে মেয়েটির কথা কেটে কেটে যায়। বুঝতে পারে না ছেলেটা। লাইন কেটে যায়। সে ফোন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ পর মেসেজ আসে - 'পেট ব্যথা করছে অনেকক্ষণ ধরে। অ্যাপেনডিক্স-এর পেইন হতে পারে। হাসপাতালে যাব। জলদি আস।'
আঁতকে ওঠে ছেলেটি। দ্রুত বার কয়েক চেষ্টা করে ফোনের। কিন্তু বার বারই লাইন কেটে যেতে থাকে। কথা বোঝা যায় না। সে মেসেজ পাঠায় - '৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি রুমমেট বা পাশের কোন মেয়েকে নিয়ে বাইরে আসো। এলএইচ - এর সামনে এসে কল দিব।'
কতটা খারাপ অবস্থা কে জানে? ছেলেটার উদ্বেগ বাড়তে থাকে। যদি তেমন খারাপ হয় কাল সকালেই হয়তো অপারেশন করিয়ে ফেলতে হবে। ডাক্তার দেখিয়ে এখনি তাহলে টেস্ট করাতে দিতে হবে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। দ্রুত তৈরী হয়ে ড্রয়ার খোলে। হাজার তিনেক টাকা ছিল সেখানে। পুরোটাই মানিব্যাগে ভরে ছাতাটা হাতে নিয়ে বের হয় ছেলেটি। বৃষ্টি পড়ছে সেই একই বেগে। মনে মনে কষে গালাগাল দেয় বৃষ্টিকে।
লেডিস হোস্টেলের সামনে দিয়েই হাসপাতালে যেতে হয়। সেখানে আসতে আসতে অনেকখানিই ভিজে যায় ছেলেটি। ঐ টুকু ছাতা শরীর বাঁচাতে পারে না। কিন্তু সেদিকে নজর দেয়ার কথা মাথায়ই আসে না ছেলেটার।
লেডিস হোস্টেলের সামনে এসে দেখে মেয়েটি হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। একা। রেইনকোট নেই গায়ে, হাতে ছাতাও নেই। ভিজে চুপচুপে হওয়া যাকে বলে, মেয়েটির অবস্থা তা-ই।
'কি ব্যাপার? কাউকে পাও নাই? ব্যথা কি খুব বেশী?' ছেলেটির গলা উদ্বেগে কেঁপে কেঁপে যায়।
মেয়েটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সামনে হেঁটে যায়। কলেজ ভবন আর লেডিস হোস্টেলের সামনে বসার একটা জায়গা আছে। সেখানে গিয়ে বসে -'এখন ব্যথা নাই'।
'এখন ব্যথা নাই মানে? অ্যাপেনডিক্সের ব্যথা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল?'
'হ্যাঁ, গেল। কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যথা থাকলেই তুমি বেশী খুশী হতে?'
কি কথার কি জবাব! ছেলেটি ভ্রূ কোঁচকায়। তবে ব্যথা নেই শুনে স্বস্তি বোধ করে।
'তুমি তোমার মাথায় ছাতায় ধরে আছো কেন? দেখতেছো না, আমি পুরা ভিজে গেছি। তোমার কি আমার প্রতি সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যেও ছাতা সরায়ে রাখা উচিত না?'
ছাতাটা মাথার উপর থেকে সরিয়ে পাশে রাখে ছেলেটা। আর তখনই হঠাৎ করে মাথায় ঢোকে পুরো ব্যাপারটা। সে বাঁ দিকের ভ্রূ উঁচু করে মেয়েটির দিকে বাঁকা চোখে তাকায় - 'আ-চ্ছা!'
বেশ ক'দিন ধরেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। মেয়েটি প্রতিদিনই আবদার করছে ছেলেটির সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। ছেলেটি সায় দিচ্ছিল না। বৃষ্টিতে ভেজার আইডিয়া তার একদমই পছন্দের না। ভেজার মধ্যে কি আর মজা! বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা। হাতঘড়ি না হয় ওয়াটার-প্রুফ, মোবাইলে না হয় কাভার দেয়া-- তারপরও, যদি পানি ঢোকে, নষ্ট হয়ে যায়? আবার ভেজা অবস্থায় হোস্টেল পর্যন্ত যাওয়াটাও কেমন যেন।
মেয়েটি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে ছেলেটিকে দেখায়, তার 'ষড়যন্ত্র' যে ছেলেটি ধরে ফেলেছে, বুঝতে পারে। সুর করে বলে - 'জ্বিইই!'
তবে ছেলেটির তেমন খারাপ লাগছে না এখন। মেয়েটির চোখে-মুখে যে আনন্দের আভা, উচ্ছ্বাস- তা দেখার জন্য সে তো তার পুরো দুনিয়াই দিয়ে দিতে পারে, হাতঘড়ি আর মোবাইলের মতো তুচ্ছ ব্যাপার আর তখন মাথায় আসে না।
মেয়েটি উঠে দাঁড়ায় - 'চল, হাঁটি।'
পাশ থেকে ছাতাটা হাতে নিতে নিতে ছেলেটি হালকা গলায় বলে, 'তোমার অবস্থা একদিন ঐ রাখাল বালকটার মতো হবে। এভাবে মিথ্যা কথা বলতে থাকলে দেখবা একদিন সত্যি কথাও বিশ্বাস করবো না।'
মেয়েটি ফিরে তাকায় - 'কে? তুমি? বাজি লাগ, আমি যা-ই বলি, জীবনে কখনোই তা তোমার কাছে মিথ্যা বলে মনে হবে না।'
এক হাত দিয়ে বৃষ্টি থেকে চোখ আড়াল করে আকাশের দিকে মুখ তোলে ছেলেটি। সরাসরি মুখে এসে পড়ে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। ভাল লাগে।
'তা-ও ঠিক'- মনে মনে মেয়েটির সাথে একমত হয় সে। নিশ্চিত হারের এ বাজি ধরার ইচ্ছে হয় না তার।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৩:৫২