somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : 'ফেরা' - ঈদসংখ্যা, ত্রৈমাসিক 'পারি'

২২ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝিক-ঝিক-ঝিক-ঝিক - টানা একই তাল-লয়-ছন্দের পরিবর্তন ঘটে, সাথে গতিরও। বোঝা যায়, ধীরে ধীরে থামতে যাচ্ছে ট্রেনটা। যাত্রীদের মাঝে চাঞ্চল্য দেখা যায়। কেউ দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। দুই সারি সীটের মাঝখানে খানিকটা হেঁটে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার জড়তা কাটায়। উপরের তাকে রাখা ব্যাগটা নিচে নামায়। কেউ বা কোলের বাচ্চাটার ঘুম ভাঙানোয় সচেষ্ট হয়। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ছাপিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বস্তি ফুটে ওঠে সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু তাপসীর চেহারায় কোন অভিব্যক্তি ফোটে না। কোনো তাড়াও দেখা যায় না তার মাঝে। অথচ এই গন্তব্যে পৌঁছার আকুলতা প্রথম শ্রেণীর বগিটির সকল যাত্রীর চেয়ে তারই সম্ভবত সবচেয়ে বেশী। তার যে দীর্ঘ এক যুগের প্রতীক্ষা!

পাশে বসা মামা তাড়া দেন তাপসীকে - ‘রেডি হ। স্টেশন তো আইসা গেল। সামনের দরজা দিয়ে নামমু আমরা।’

আলগোছে মামার দিকে চোখ ফেরায় তাপসী। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন অচেনা এক অনুভব। সব কিছু এখনও কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলেই কি এসব মিথ্যে হয়ে যাবে?

ট্রেন পুরোপুরি থেমে দাঁড়ানোর আগেই বগির দুপাশের দরজায় মানুষের লাইন দীর্ঘ হয়ে যায়। নামার প্রতিযোগিতায় হুড়োহুড়ি-হৈচৈ। যেন বা এক দন্ড দেরী হলেই ট্রেনখানা কাঙ্খিত স্টেশন পেছনে ফেলে তাদের নিয়ে পাড়ি জমাবে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দরজার কাছে এসে তাপসী বুক ভরে শ্বাস নিতে চায় একবার। কিন্তু সামনে তাকিয়ে চমকে ওঠে। ট্রেনের দরজার মুখেই প্ল্যাটফর্মে মানুষের ভীড়। মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় জনা চল্লিশ-পঞ্চাশ। ভয় হয়, বুঝি বা তাকে নামার ফুরসৎটুকু না দিয়ে ঠেলেই এরা উঠে পড়বে ট্রেনে। তবে, পরক্ষণেই বুঝতে পারে, এরা ট্রেন ধরার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত যাত্রী নয়। এরকম ভীড়ের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা তাপসীর জন্য নতুন কিছু নয়। তবু অভিভূত হয়ে যায় সে- শুধু তার জন্য প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে তার গ্রাম বা জেলার এতো মানুষ- কখনো কি ভাবতে পেরেছিল সে?

মা-কে চোখে পড়তেই আবেগের বাঁধ ভেঙে যায় তাপসীর। মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। চারদিকে স্লোগান ওঠে তাপসীর নাম ধরে।
ট্রেনটা চলে যেতেই প্ল্যাটফরমে মানুষের ভীড় কমে কিছুটা। তবে, তাপসীকে ঘিরে থাকা জটলাটার আকার পরিবর্তিত হয় না। এগিয়ে এসে কয়েকজন পরিচয় দিতে থাকলে মায়ের বুক থেকে মুখ উঠাতে বাধ্য হয় তাপসী। জেলার বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারী অফিসের কর্মকর্তা তারা। তাদের কথার কোনো কিছুই যেন কানে ঢোকে না তাপসীর। কোনো প্রশ্নের জবাবও দিতে পারে না মুখের ভাষায়। তরুণ-তরুণীদের একটা দল তাপসীর গলায় পরিয়ে দেয় ফুলের মালা, হাতে তুলে দেয় গুচ্ছ ফুলের তোড়া। এরই মাঝে কে একজন প্যাকেট খুলে মিষ্টি তুলে দেয় তাপসীর মুখে। ক্যামেরার ফ্লাস জ্বলে ওঠে বারংবার। তাপসীর ঘোর লাগা চোখে তখনও বিস্ময়। কি কি যেন অনুষ্ঠানের কথা বলেন তারা, কবে কবে যেন কোথায় কোথায় যেতে হবে তাপসীকে। তাপসীর কান ভেদ করে মর্মে পৌঁছে না কোনো কথাই। তাপসীর ভাই ফারুক সামনে এগিয়ে এসে ওসব ব্যাপারে কথা বলে তাদের সাথে।
কর্মকর্তা গোছের লোকজন চলে যাবার পর যেন অন্যদের দিকে চোখ ফেরানোর ফুরসৎ পায় তাপসী। কিছুটা দূরে কুন্ঠিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। শরীর ভেঙে গেছে অনেকখানি, চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। বারো বছর তাপসী চোখের দেখাটাও দেখেনি বাবাকে। বাবাও চান নি কখনো। ফোনেও কথা হয় নি দীর্ঘ দশ বছর। গত দুই বছরে তাপসী মোবাইলে ফোন করলে মাঝে-মধ্যে কথা হয়েছে বাবার সাথে। তবে স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারেনি বাবা-মেয়ে কেউ-ই। ‘কেমন আছ?’ ‘ভালো আছি’- এর পর কেউ কোনো কথা খুঁজে পায়নি। ‘তোমার মায়ের সাথে কথা বলো’ বা ‘মাকে দাও’- বলে দুু তরফেই যেন আলাপচারিতার অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে। মা যখন বলেছিলেন- ‘বাড়ি ফিরে আয়, গ্রামের সবাই চায় তুই ফিরে আয়’- অভিমান ভরা কন্ঠে তাপসী বলেছিল - ‘বাবা তো বলে না।’ মায়ের অনুরোধে বাবা ফোনে বলেছিলেন- ‘তুমি গ্রামে আসো, সবাই তোমাকে দেখতে চায়।’ ছোটবেলায় তাপসীকে ‘তুই’ করেই ডাকতেন, এখন ‘তুমি’র আড়ালে যেন অলংঘ্য দূরত্বের প্রতিধ্বনি। ও কটা শব্দও বলেছিলেন অনেক জড়তা নিয়ে, অনেক কুন্ঠার স্বরে। সেই জড়তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেন না বাবা। তাপসীরও বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরার তীব্র ইচ্ছাকে শিকল পরিয়ে রাখে সেই কুন্ঠাই।

দুই বছরের ছোট ভাই ফারুক অবশ্য সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার পাশে পাশেই থাকে। গত বারো বছরে ভাইয়ের সাথেও তাপসীর দেখা হয়েছে মোটে বার তিনেক। শেষবার বছর দুয়েক আগে। মামা বা ফারুকের সাথে মা দু-তিন বছরে একবার ঢাকা যেতেন। কিন্তু বাবা কখনোই যেতেন না। বছর দুয়েক আগে নিজের টাকায় মাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল তাপসী। এর পর থেকে ফোনে নিয়মিতই কথা হতো মা-ভাইয়ের সাথে।
‘কেমন আছে মা?’- বলে সামনে এগিয়ে আসা বৃদ্ধটিকে চিনতে কিছুটা সময় লাগে তাপসীর। বারো বছরে প্রস্থে আরো চওড়া হয়েছে লোকটা, চুল-দাঁড়ি-গোঁফ সব সাদা হয়ে গেছে। মায়ের কাছে শুনেছে - ওসমান চাচা এখন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তিনি স্টেশন পর্যন্ত চলে আসবেন- এতটা ভাবেনি তাপসী। ওসমান চাচা কি ভুলে গেছেন সেদিনের কথা? তাপসী তো কখনো ভুলতে পারেনি।

ওসমান চাচার দিকে তাকিয়ে সেদিনের ঘটনাটা হুবহু চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাপসীর। রাতের অন্ধকারে বাবা-মা তাকে নিয়ে গিয়েছিল ওসমান চাচার বাড়িতে। ওসমান চাচা তখন গ্রামের প্রধান তিন মাতবরের একজন। তখনকার ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে গলায় গলায় খাতির। তাপসীর বাবা আগে ওসমান চাচার জমি বর্গা চাষ করতো বলে পূর্ব-পরিচিতও। সেই ভরসায়ই বাবা-মা আগে ওসমান চাচার কাছেই যান। সব শুনে ওসমান চাচা বাবাকে বলেন - ‘তোমার মাইয়ার স্বভাব-চরিত্র ভালা নি? এত্তো ডাঙ্গর অইছে, তা-ও পোলাগো লগে এতো ঢলাঢলি কিসের? ভর দুপুরে অর ঐ বাড়ি যাওয়ার কি দরকার আছিল?’

‘আমি তো খেলা দেখবার গেছিলাম। পত্যেকদিনই তো যাই। আইনুল ভাই-ই তো কইছিল যাইতে।’ - মিন মিন করে বলে তেরো বছরের কিশোরী তাপসী।
তা ঠিক। খেলা দেখতেই গিয়েছিল তাপসী। প্রায় প্রত্যেকদিনই যায়। আশপাশে কেবল আইনুলদেরই রঙিন টিভি ছিল তখন। চারদিকে সবার মুখে বিশ্বকাপ ফুটবলের কথা শুনে খেলা দেখার প্রবল ইচ্ছা জাগে তাপসীরও। ছোটবেলা থেকেই খেলাটার প্রচন্ড ভক্ত সে। তবে, সরাসরি খেলাগুলো গভীর রাতে হওয়ায় সেগুলো দেখতে পারতো না তাপসী। আইনুলদের ড্রয়িংরুমে রাতে ছেলে-বুড়োদের আড্ডা বসতো খেলা উপলক্ষ্যে। আইনুলের কাছে তাপসী খেলা দেখার ইচ্ছার কথা পাড়তে সে বলেছিল- ‘রাইতে তো দেখবার পারবি না, বহুত লোক হয়। তুই দিনে আসিস। দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে একই খেলা আবার দেখায়। তুই তখন দেখবার আসিস।’

তাপসী সে সময়টাতেই খেলা দেখতে যায়। বাড়িতে কেউ জানে না। বাবা তো দিনে সেভাবে খেয়াল করেন না- কখন কোথায় থাকে ছেলে মেয়ে। মা-ভাই ঐ সময়টায় ঘুমায়। কখনো ওকে বের হতে দেখলে মা জিজ্ঞেস করেন। তাপসী তখন কিছুটা দূরের এক বান্ধবীর বাড়ির কথা বলে। মা-ও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তাপসী চলে যায় আইনুলদের বাড়িতে।

অধিকাংশ সময় একা একাই খেলা দেখে তাপসী। আইনুলের ব্যবসায়ী বাবা দিনে বাসায় থাকেন না। তার মা এ সময়টায় দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমান। আইনুলের ছোট বোন সুরভী মাঝে-মধ্যে তাপসীর সঙ্গে বসে খেলা দেখে। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষ্যে আইনুলের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বলে এখন বাসায়ই থাকে। তবে সে-ও এ সময় ঘুমায় বা পড়ে। মাঝে মধ্যে ড্রইংরুমে আসে খেলা দেখতে। তাপসীর পাশ ঘেঁষে বা তাপসীকে কোলের কাছে নিয়ে বসে। এতে যে মনে করার বা সাবধান হওয়ার মতো কিছু আছে- তা-ই কখনো মাথায় আসেনি কিশোরী তাপসীর। তাই ওভাবেই আইনুল ভাইয়ের সাথে বসে থাকে সে। কোনো খেলোয়াড়কে চেনে না তাপসী। কিন্তু বল পায়ে খেলোয়াড়দের কারিকুরি, কসরত যেন গোগ্রাসে গেলে। খুব ভাল লাগে ব্রাজিলের খেলা। আইনুল তাপসীকে খেলোয়াড় চেনায়। তার কাছ থেকেই রোনাল্ডো, জিদান, ক্রেসপো, ভেরন, ফিগো, বেকহামদের নাম শোনে তাপসী। ড্রিবলিং, ব্যাকহিল, লব, ভলি, ক্রস- এইসব কঠিন কঠিন শব্দ শোনে, মনে রাখার চেষ্টা করে। ফুটবল সম্পর্কে কত কিছু জানে আইনুল ভাই - ভেবে শ্রদ্ধা জাগে তার প্রতি।

এমনি করে সকালে স্কুল আর দুপুরের পর খেলা দেখে বিশ্বকাপের দিনগুলো ভালোই কাটছিল তাপসীর। হঠাৎ-ই একদিন ঘটে যায় ঘটনাটা। সেদিন আইনুলের মা আর বোন বাড়িতে ছিলেন না- কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলেন। আইনুল আর সে বসে খেলা দেখছিল। পাশ ঘেঁষে তাকে জড়িয়ে বসে খেলোয়াড়দের নাম বলে যাচ্ছিল আইনুল। তাপসীর মন-চোখ সবই খেলার দিকে। হঠাৎ বুকের বাম দিকটায় আলতো চাপ অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে সেখানে আইনুলের হাত। ছিটকে সরে আসে তাপসী আইনুলের পাশ থেকে। ‘কি করো আইনুল ভাই?’- কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে সে।
আইনুল তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। আইনুলের দৃষ্টির ভাষা আজ অন্যরকম। তাপসী ছুটে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু আইনুলের শক্তির কাছে ব্যর্থ হয় তার প্রচেষ্টা।....

‘পত্যেক দিনই তো যাই.. শরম করে না কইতে?’ রেগে ওঠেন ওসমান চাচা- ‘খেলা দেখবার যাস না খেলা করবার যাস? লাজ-শরম নাই মাইয়ার.. পত্যেক দিনই যাস তয় আইজ আইনুলের নামে বদনাম গাইবার আইছস কেন? অ.. আইজকা ট্যাকা দেয় নাই?..’

‘চুপ করেন ওসমান ভাই’ - ডুকরে কেঁদে ওঠে তাপসীর মা। ‘আল্লারস্তে চুপ করেন। আপনের পায়ে পড়ি। আমার মাইয়া অমন না। আমার মাইয়া অমন না। আপনে এর বিচার করেন।’

‘কি বিচার করুম? তুমার মাইয়ার কথা কেউ বিশ্বাস যাইবো? পোলাগো লগে ঢলাঢলি করবার লাইগা কতোবার কতোজনে ওরা বকাবাদ্যি করছে। শোধরাইছে তুমার মাইয়া? সেই দিনই তো সবুরের পোলার লগে কি কান্ডটা করছে.. মনে নাই?’

মনে আছে তাপসীর। কিন্তু তাতে তাপসীর দোষটা কোথায়? ও তো খেলতেই গিয়েছিল। আর ‘সবুরের পোলা’ শাহীনের সাথে সে তো খেলে সেই কবে থেকেই। শাহীন বয়সে তাপসীর চেয়ে বছরখানেকের ছোট। এখন তাপসী শাহীনের সমবয়সী বা তার ছোটদের সাথে খেলে। আগে সমবয়সী বা বড়দের সাথেই খেলতো। ওর বয়সী মেয়েরা যখন বউচি-দাঁড়িয়াবান্ধা-কুতকুত-সাতচারা খেলতো, তাপসী খেলতো ফুটবল। মেয়েরা কেউ ফুটবল খেলতো না। তাই ছেলেদের সাথেই খেলতো সে। ছোটবেলা থেকেই খেলে আসছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠতেই সমস্যা প্রবলতর হলো। খেলোয়াড়দের দিক থেকে কোনো আপত্তি না আসলেও গ্রামের বাপ-চাচা গোছের লোকজন আপত্তি তুললেন। বাড়ি বয়ে এসে শাসিয়েও গেলেন অনেকে- ‘মাইয়ারে সামলাও, ডাঙ্গর হইছে, অহনও অতো লাফান-কুঁদন কেন?’, ‘গ্রামের পোলাগো চরিত্র নষ্ট অইবো এক তোমার মাইয়ার লাইগাই’, ‘পোলাগো লগে বল খেলতে অইবো কেন অরে, মাইয়াগো লগে মাইয়াগো খেলা খেলবার পারে না?’, ‘কোনদিন তোমার মাইয়ারে নিয়া সালিশ বসবো, তহন কিন্তু বিপদে পইড়া যাবা। আগেই কয়া রাখলাম, তহন কিন্তু কিছু কয়ার পাবা না।’ মুরব্বীদের শাসানোর প্রতিক্রিয়ায় বাবা-মার হাতে এ নিয়ে কয়েক বার প্রচন্ড পিটুনীও খেল তাপসী। তাতে খেলাটা কয়েকদিনের জন্য বন্ধ রইলো। কিন্তু কিছুদিন পর আবার মাঠে দেখা গেল ওকে। তবে, এবার সমবয়সী বা বড়দের সাথে নয়, বয়সে ছোট ছেলেদের সাথে খেলতে শুরু করলো তাপসী। কিন্তু ছোটদের সাথে খেলতে গিয়েও সমস্যা দেখা দিল। খেলায় পেরে না উঠে শক্তিতে তাপসীকে কাত করার চেষ্টা চালানো শুরু করলো ওরা। ধাক্কা দেয়া, পায়ে লাত্থি দেয়া, জামা টেনে ধরা - এসব কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই সহ-খেলোয়াড়দের উপর চটে ছিল তাপসী। সেদিন তাপসী যখন গোলে শট নেবে, শাহীন পা থেকে বল কাড়তে না পেরে জোরে চাপ দিয়ে বসলো তার বুকে। ব্যথায় বলের দখল ছেড়ে দিতে হলো তাপসীকে। রেগে মাঠের মধ্যেই পিটানো শুরু করলো সে শাহীনকে। প্রবল মারামারি বেধে গেল দুজনে। অন্য খেলোয়াড়রা তাদের ছাড়াতে না পেরে ডেকে নিয়ে এলো বড়দের। সেদিন বাড়িতে বাবা ওর পিঠে চেলাকাঠ ভাঙলেন। জ্বরে তিনদিন ঘরে পড়ে রইলো তাপসী। যে কোন বয়সী ছেলেদের সাথে খেলার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। কিন্তু বড় জোর সাতদিন। এর পর আবার তাপসীকে দেখা গেল খেলার মাঠে।..

ওসমান চাচার বাড়ি থেকে ফিরে সেদিনও আরেকটা চেলাকাঠ ভাঙলো তাপসীর পিঠে।

পরদিন সকালে মা গেলেন আইনুলদের বাড়ি। আইনুলের মাকে ঘটনা জানাতে। ফিরলেন চরম অপমানিত হয়ে। রাতে ওসমান চাচাসহ গ্রামের বেশ কিছু লোক এলেন বাড়িতে। ভেতর ঘর থেকে সব-ই শুনলো তাপসী। তাপসী গ্রামে থাকলে উঠতি বয়সী ছেলেদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হবে। এই মেয়ে গ্রামের সর্বনাশ করবে। গ্রামের জন্য তাপসী শুধুই ক্ষতিকর একটা বোঝা। কয়েকদিন পর পর এই মেয়ের নামে নানা অভিযোগ আসছে। ওকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর না। গ্রামের স্বার্থে হয় তাপসীকে তার বাবা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিক। না হয় সমাজপতিরা সালিশে বসে তাপসীদের পরিবারকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করবে। বোঝা গেল, আইনুলের প্রভাবশালী বাবা গ্রামের মাতবরদের হাত করেছেন। আর তাপসীর উপর তো আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল অনেকে।

সেদিনই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন - ওকে আর এই গ্রামে রাখবেন না। চাষ করা আর মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু করতে শেখেননি তাপসীর বাবা। অন্যের জমি বর্গা চাষ আর ভরা মৌসুমে পাশের বিল থেকে মাছ ধরে বিক্রি করেই সংসার চালান। নিজের বলতে বাড়ির ভিটেটুকু আর তিন শতাংশ জমি। সেটুকু তার বাবাকে মৌখিকভাবে দান করে গিয়েছিলেন জমির মালিক। তারও কোন দলিল-কাগজপত্র নেই। এখন এই মেয়ের জন্য গ্রামের মাতবরদের চটালে ভিক্ষে করে খেতে হবে বাকী জীবন, থাকতে হবে গাছ তলায়।

তাপসীর মা অনেক কাঁদলেন। কিন্তু বাবা তার সিদ্ধান্তে অনড়। বলে দিলেন- যার জন্য গ্রামের লোকজনের সামনে এমন অপমান, সেই মেয়ের মুখ তিনি জীবনে আর দেখতে চান না। মেয়ে তো নিজের সাথে সাথে বাবা-মার ইজ্জতও খুইয়েছেই, এখন তাকে গ্রামে রেখে নিজেদের প্রাণ খোয়াতে তিনি রাজী নন। তাপসী নামের যে মেয়ে তার ছিল, সে এখন থেকে তার কাছে মৃত।

ঢাকায় তাপসীর এক মামাকে খবর দেয়া হলো। মামা ঢাকায় মুদী দোকান চালান। তিনি এক পরিবার খুঁজে বের করলেন যাদের কাজের মেয়ে দরকার। আপাতত সেখানেই তাপসীকে পাঠানো হবে ঠিক হলো। পরে মামা খুঁজে পেতে কোনো গার্মেন্টসে কাজে লাগিয়ে দেবেন ওকে। মামা যেদিন নিতে এলেন, সেদিনও মা অঝোরে কাঁদলেন। কাঁদলো তাপসী আর ছোট ভাইটাও। বাবা কোনো কথাই বললেন না তাপসীর সাথে। গ্রাম থেকে বিতাড়িত হলো তাপসী।

সেই প্রথম তার ট্রেনে চড়া। সেই প্রথম তার ঢাকায় আসা।

....
আজ বারো বছর পর সেই ট্রেনে চড়েই ফিরেছে তাপসী। স্টেশন থেকে তাকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে মাইক্রোবাস ঠিক করা হয়েছে। মা-বাবা-ভাই-মামা সহ তাপসীকে ঐ মাইক্রোতে উঠানো হলো। মাইক্রোতে উঠলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ওসমান গণি। উঠলেন গ্রামের আরো কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তিও। সবার মুখে তাপসীর প্রশংসা। তাপসী তাদের গ্রামের গর্ব। তাদের গ্রামের নামটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে যে তাপসীর কল্যাণেই। তাপসীর স্তুতিতে তাই সবাই আজ পঞ্চমুখ।

হাসি পায় তাপসীর। নিয়তির কি অবাক লীলা! যে খেলার জের ধরে তাকে গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছিল, বারো বছর পর সেই খেলার সুবাদেই সে গ্রামে ফিরছে মাথা উঁচু করে, সকলের নয়নের মণি হয়ে। বারো বছরে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। গ্রাম ছাড়া হওয়াটা শাপে বর হয়ে এসেছিল তাপসীর জীবনে। যে বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল তাপসী, সে বাড়ির গৃহকর্তা ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির এক কর্মকর্তা। তিনি তাপসীর মুখে তার কাহিনী শুনে তাকে পরখ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন বিকেএসপিতে। তার পরের সময়টুকু তাপসীর প্রতিভা, কঠোর শ্রম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের গল্প। সাফল্যে যে তাপসী আজ বরণীয় সারা দেশ জুড়ে, তার দিক থেকে তার নিজ গ্রাম কিভাবে আর মুখ ফিরিয়ে থাকে? তাই যে গ্রাম থেকে অপমানিত হয়ে, মাথা নিচু করে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাকে, সেখানেই আজ সসম্মানে ফিরে চলেছে দক্ষিণ এশীয় মহিলা ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সহ-অধিনায়ক, টুর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড় তাপসী।
....................................
ত্রৈমাসিক 'পারি' -এর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:১৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×