অনেকক্ষণ পর বিদ্যুৎ আসে। অনেকক্ষণ মানে ঢাকার মতো এক-দু ঘন্টা নয়। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কয়েকবারে বিদ্যুৎ-এর দেখা পাওয়া গেছে বড় জোর তিন ঘন্টা। তারপর সেই যে পালিয়েছে, আর একবার মাত্র এসেছিল রাত দশটার দিকে। ছিল আধঘন্টা মতোন। এবার যখন এলো, ঘড়ির কাঁটা তখন পেরিয়ে গেছে রাত দুটোর ঘর।
মেহেদীর চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে আছে সেই কখন থেকে। এলোমেলো নানান ভাবনায় শুধু সময় পার করা। টেনশনে ঘুম আসে না চোখে। কখন হাসপাতাল থেকে ডাক আসে - সেই টেনশন। বিদ্যুৎ আসায় পাশ থেকে পত্রিকাটা হাতে তুলে নেয়। খেলার পাতাটাই কেবল পুরো পড়েছিল দিনে। আর বাকী খবরের শিরোনামগুলোতে চোখ বুলিয়েই রেখে দিয়েছিল। এখানে পত্রিকা হাতেই আসে দুপুর একটার দিকে। বিকেল থেকে সারা সময়টাই প্রায় শুয়ে-বসে ছিল। বিদ্যুৎ ছিল না বলে পত্রিকা পড়া হয়নি আর। মাঝে একবার মোমবাতি জ্বালিয়েছিল। কিন্তু জমাট অন্ধকারের মাঝে একটুকু মোমের আলো দেখতে পেয়ে ছোট-বড় পোকামাকড়ের দল এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো চারপাশে যে আলোর কাছাকাছি থাকার চেয়ে অন্ধকারই বরং অনেক সহনীয় মনে হলো মেহেদীর কাছে।
চিকিৎসক সংক্রান্ত খবরটায় চোখ আটকায় মেহেদীর। আবারো প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের গ্রামে থেকে মানুষের সেবা করার আহ্বান জানিয়েছেন। চিকিৎসকদের এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর কন্ঠেও ছিল একই সুর, চাকরীতে যোগ দিয়ে কর্মস্থলে অনিয়মিত বা শহরাঞ্চলে বদলী হতে মরিয়া চিকিৎসকদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন তারা। বিশেষ করে সদ্য বিসিএস পাস করে সরকারী চাকরীতে যোগ দেওয়া নবীন চিকিৎসকদের প্রতি তাদের এ আহ্বান। আদৌ এ আহ্বানে কি কোন কাজ হচ্ছে? - খবরের পুরোটা পড়তে পড়তে ভাবে মেহেদী। নবীন-প্রবীণ সকল চিকিৎসকের মাঝেই শহরমুখী প্রবণতা। তরুণ চিকিৎসকরা ঢাকা অথবা অন্য মেডিকেল কলেজগুলোতে যাওয়ার জন্য উন্মুখ- তাদের ক্যারিয়ার আর পড়াশোনার জন্য, প্রবীণরা বিভাগীয় অথবা অন্ততঃ জেলা শহরগুলোতে থাকতে চাচ্ছেন প্র্যাকটিস, পরিবার আর সন্তানের পড়ালেখার স্বার্থে। তাহলে এইসব উপজেলা বা গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা দেবে কারা?
এই উপজেলার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাই তো খুব সঙ্গীন। নতুন বিসিএসে উত্তীর্ণদের পদায়নের আগে গত দুইমাস ধরে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক বলতে ছিলেন শুধু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএন্ডএফপিও) আর আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও)। দুই চিকিৎসা কর্মকর্তা, মেডিসিন-সার্জারী-গাইনী-অ্যানেসথেশিয়ার কনসালটেন্ট আর ডেন্টাল চিকিৎসকের পদ শুন্য পড়ে আছে। শুন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন চিকিৎসা কর্মকর্তার পদও। এই উপজেলায় কারো পোস্টিং হলে তদবির-লবিং করে দ্রুতই তিনি চলে যান অন্য কোথাও। পাঁচটা ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনটিতেই চিকিৎসক নেই গত ছয় মাস ধরে। সর্বশেষ বিসিএস-এ মেহেদীসহ মোট পাঁচ চিকিৎসকের পদায়ন হয়েছে এই উপজেলার পাঁচ ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। যোগদানের পাঁচদিনের মাথায় দুজন ডেপুটেশনে চলে গেছে জেলা সদর হাসপাতালে। চিকিৎসক-স্বল্পতার কারণে বাকী তিনজনকে লোকাল অর্ডারে ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বদলে কাজ করতে বলা হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু একজন এ অর্ডার বদলে নিয়েছে, রয়ে গেছে তার স্বাস্থ্য-উপকেন্দ্রেই; তার বাড়ি সেখানেই, উপকেন্দ্রের পাশেই, মা-বাবা সেখানেই থাকেন। অপর মহিলা চিকিৎসক সোনিয়ার গ্রামের বাড়ি সদর জেলায়। তিনিও জেলায় ডেপুটেশন নেয়ার চেষ্টা করছেন, তবে খুঁটির জোর অতটা শক্ত না হওয়ায় এখনো সফল হননি। তবে তিনিও যে কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবেন সদরে , তা নিশ্চিত। সদর থেকে যাতায়াত করেন তিনি, তা-ও সপ্তাহে দু-তিনদিন।
চাকরীতে যোগ দিয়েই শহরে চলে আসবে- এমন মানসিকতা মেহেদীর কখনোই ছিল না। তার ইচ্ছে ছিল, যেখানেই পোস্টিং হোক, কমপক্ষে প্রথম দু’বছর গ্রামে থেকেই মানুষের সেবা করবে সে। এ কারণে তার নিজের জেলায় পোস্টিং না হলেও বদলীর জন্য কাউকে ধরে নি সে। বাসা ও বেড়ে ওঠা ঢাকায় হলেও উপজেলায় নিয়মিত থেকেই চাকরী করবে বলে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন তারও আছে। কিন্তু চাকরীর শর্তবিধি মেনেই চাকরী করার প্রতিজ্ঞা তার, মানুষের সেবা করার মানসিকতা নিয়েই তো সে মেডিক্যালে পড়তে এসেছিল।
যোগদানের পর কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে গোছগাছ করতে ঢাকায় গিয়েছিল মেহেদী। তারপর এসে গত এক সপ্তাহ ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই আছে। থাকছে হাসপাতালের পিছনেই চিকিৎসকদের জন্য তৈরী বাসায়। তবে, দোতলা এই ভবনটি এখন পরিত্যক্ত বলে ঘোষিত। নতুন ভবন তৈরীর কাজ শেষ হয়নি এখনো। পরিত্যক্ত ভবনের দোতলার একটি রুম মোটামুটি গুছিয়ে সেখানে উঠেছে মেহেদী। বিদ্যুতের লাইন আগে থেকেই ছিল। সে নতুন বাল্ব, টিউবলাইট লাগিয়েছে। তবে, পানির লাইন নষ্ট। পানি আনতে হয় হাসপাতালের পাশের টিউবওয়েল থেকে, বালতিতে করে।
মেহেদী খুব অবাক হয় অন্যদের কথা ভেবে- আরে চাকরীর শর্ত যদি মানতে ইচ্ছে না-ই হয়, তাহলে খামাখা কেন বিসিএস দেয়া? গ্রামে থাকতে হবে, শহরের আরাম-আয়েশ পাওয়া যাবে না- এটা জেনেই তো সবাই চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছিল। তবে এখন কেন বদলীর জন্য, শহরে পোস্টিংয়ের জন্য এত দৌড়ঝাঁপ, নেতাদের ধরাধরি। কেন চাকরীস্থলে উপস্থিতি অনিয়মিত?
ভাবনার পায়ে শেকল পড়াতে চেষ্টা করে মেহেদী। ঘুমাতে হবে। কাল হাসপাতালে পুরোটা সময় একাই থাকতে হতে পারে তাকে। সকালে আউটডোর দেখতে হয়। রোগীর ভীড় অনেক। কিন্তু অধিকাংশই আসে শুধু ওষুধ নিতে। রোগীরা এসেই বলে- প্যারাসিটামল দেন, মেট্রো দেন, ভিটামিন দেন। রোগীরা সমস্যার কথা বলে না। ‘কি সমস্যা’ জিজ্ঞেস করলেও বিরক্ত হয় তারা। যদিও বা বলে, এমনভাবে বলে যে মেহেদীর সন্দেহ হয়, আদৌ সে সমস্যা তার আছে কি না। মেহেদী ছোট স্লিপে ওষুধের নাম লিখে দেয়। প্রথম দিন বেশ অদ্ভুত লেগেছিল, সমস্যা না শুনে ওষুধ লিখতে রাজী হয়নি সে। এ নিয়ে কয়েক রোগীর সাথে তর্কাতর্কি। পরে আরএমও বুঝিয়েছিলেন, এখানকার আউটডোরে আসা রোগীরা এমনই, প্রতিদিন প্রায় শ চারেক রোগীর অধিকাংশই আসে শুধু ফ্রি ওষুধ নিতে। এদের সাথে তর্কে না গিয়ে ওষুধ লিখে দেয়াই ভাল, নইলে ঝামেলা হয়। প্রত্যেকের সাথে কথা বলতে গেলে সময়েও কুলাবে না। মেহেদী দেখেছে, প্রকৃতই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রোগী আসে মূলতঃ দুপুরের পর আরএমও-এর বাসায়, ওখানেই ভিজিট দিয়ে রোগী দেখায় তারা। ইনডোরের রোগীও দেখেন আরএমও, সে শুধু সাথে সাথে থাকে। ইনডোরের প্রায় সব রোগীই মারামারির রোগী। এ এলাকায় মারামারি বেশ হয়। তাই প্রতিদিনই চার-পাঁচ জন করে আহত রোগী ভর্তি হয়। তবে এর মধ্যে অধিকাংশই ভর্তিযোগ্য নয়। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিলেই চলে। তবে, বিভিন্ন চাপে এদের ভর্তি রাখতেই হয়- আরএমও বলেছেন তাকে। কর্মচারীরা মেহেদীকে পরে বলেছে, ভর্তি রাখা আর আহতদের ইনজুরি সার্টিফিকেটে এদিক-ওদিক করার বদলে নাকি মোটা অংকের টাকা কামান আরএমও।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আশফাক চৌধুরী এক মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ-এ ঢাকায় আছেন এক সপ্তাহ আগে থেকেই। তার দায়িত্বে থাকা আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা বা আরএমও ডাঃ লিয়াকত হোসেন গেছেন জেলা সদরে। কাল সদর হাসপাতালে মাসিক মিটিং। শ্বশুর অসুস্থ বলে আজই চলে গেছেন স্ত্রীকে নিয়ে। আরএমও-এর স্ত্রীর বাড়ি সদরে। আরএমও-এর বাড়ি এই উপজেলাতেই। ছেলে-মেয়ে দুজনেই পড়ে ঢাকায়। স্ত্রীকে নিয়ে আরএমও থাকেন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সেই। দীর্ঘদিন ধরে আরএমও-এর দায়িত্বে আছেন ডাঃ লিয়াকত। তার অবসরের বাকী আছে আর মাত্র চার বছর। মূলতঃ তিনিই চালান উপজেলার এই ৩১ শয্যার হাসপাতাল। ইউএইচএন্ডএফপি হিসেবে কারো পোস্টিং হলেও বেশীদিন থাকেন না এখানে। দ্রুত বদলী হয়ে যান। যতদিন থাকেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ যোগাড় করে ঢাকাতেই থেকে যান অধিকাংশ সময়।
আরএমও সর্বক্ষণ থাকায় দুপুরের পর আর কাজের তেমন চাপ ছিল না এ কদিন মেহেদীর। আউটডোর শেষে দুটো-আড়াইটার দিকে সে রুমে চলে আসতো। দুপুরের পর জরুরী বিভাগে তেমন যেতে হতো না। মারামারির রোগী এলে আরএমও-ই দেখতেন। আরএমও ব্যস্ত থাকলে বিষ খাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্যান্য জরুরী কিছু রোগীর বেলায় মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্টরা তাকে ডাকতো বটে, তবে বেশী সমস্যা বুঝলে পাঠিয়ে দিত আরএমও-এর বাসায়। শুয়ে-বসেই দিন কাটতো মেহেদীর।
আজও এখন পর্যন্ত তাকে ডাকেনি কেউ। হোটেল থেকে দুুপুরের খাবারটা খেয়ে এসে সে থেকে যেতে চেয়েছিল হাসপাতালেই। সন্ধ্যার দিকে মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট আর কর্মচারীরা তাকে এক রকম জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে রুমে। বলেছে, তার থাকার দরকার নেই। তারা তো আছেই। তেমন জরুরী কোন রোগী এলে তারাই তাকে ডাক দেবে। তার রুম থেকে হাসপাতালে আসতে লাগবে বড়জোর আধ মিনিট। তাছাড়া এই হাসপাতালে ডাক্তারদের থাকার মতো আলাদা কোন রুম-ও নেই। জরুরী বিভাগ সংলগ্ন রুমটাতে সে থাকলে মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্টকে থাকতে হবে মাটিতে। রাতে বড়জোর দু থেকে তিনজন রোগী আসে। কোন কোন রাতে আসে না একজন রোগীও। অযথা সারা রাত জেগে বসে কাটানোর কোন মানে নেই।
তবুও টেনশনে ঘুম হয় না। কখন যে ডাক আসে! যদি ঝামেলার কোন কেস হয়? আরএমও অবশ্য আশ্বস্ত করে গেছেন, তেমন সমস্যা হবে না। কর্তব্যরত মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট রাশেদ বেশ পুরনো, অভিজ্ঞ, এই উপজেলারই বাসিন্দা। সে সামলে নিতে পারবে। মেহেদীর উপস্থিতিটাই যথেষ্ট।
রাত প্রায় তিনটা বাজতে চললো। লাইট নিভিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নেয় মেহেদী। ফোন আসে ঠিক এ সময়ই। রাশেদ ফোন দিয়েছে। মারামারিতে আহত এক রোগী আসবে এখনি। মেহেদীকে যেতে হবে।
তৈরী হয়ে বের হবে- এ সময় বিদ্যুৎ চলে যায় আবারো। টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে হাসপাতালে যায় মেহেদী।
জরুরী বিভাগে গিয়ে বসে। রোগী আসেনি তখনো। তবে, পাঁচ-ছ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে জরুরী বিভাগে। তারা জানায়, রোগী আসছে। পাঁচ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে মারামারি হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তাতে গুরুতর আহত হয়েছে এক ব্যক্তি। প্রায় মর মর অবস্থা। মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। আহত ব্যক্তি সরকারী দলের রাজনীতি করে।
আলাপচারিতার ফাঁকেই রোগী চলে আসে। সঙ্গে এক দঙ্গল লোক। জরুরী বিভাগের বাইরে থেকেই চিৎকার, চেঁচামেচি -‘ডাকতর আসে নাই? কই ডাকতর? আরে দেখে না কেন মানিকরে? আরে, মানিক মরতাছে আর কোনো ডাকতারের খোঁজ নাই? পইরা পইরা ঘুমায়?’
হৈ-চৈ করতে করতে ভেতরে ঢোকে লোকজন। আগে থেকেই ওখানে থাকা লোকদের দু-একজন বলে-‘ডাকতর আইনা রাখছি।’ আরো উচ্চ গ্রামে চড়ে নতুন আসা লোকদের স্বর- ‘কই? নিয়া আয় এহানে।’
ঘাবড়ে যায় মেহেদী। পরিস্থিতিটা তার কাছে নতুন। কি বলবে সে বুঝে উঠতে পারে না। তৎপর হয় রাশেদ আর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী খালেক। তাদের গলাও উচ্চগ্রামে ওঠে- ‘টলিতে রাখেন, টলিতে রাখেন, ডাকতর সাব আছেন, আগে সবাই সইরা দাড়ান। ডাকতর সাবরে দেখতে দেন। সরেন সরেন।’ ওরাই প্রায় ঠেলে-ধাক্কিয়ে সরায় লোকজনকে। ধরাধরি করে রোগীকে শোয়ায় ট্রলির উপর। মেহেদীর পথ করে দেয় রোগীর কাছে যাওয়ার। রোগী পর্যন্ত পৌঁছে বটে মেহেদী, কিন্তু রোগীর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। চারদিকে চিৎকার-শোরগোল, প্রতিপক্ষের নাম ধরে গালাগালি, প্রতিশোধের উচ্চনাদ প্রতিজ্ঞা- এর মাঝে কথার খেই হারিয়ে ফেলে মেহেদী। খালেকের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে লোক সরাবার। মুরব্বী গোছের এক লোককে ডেকে খালেক ভীড় কমাতে বলে। কিছু লোক বাইরে যায়। চেঁচামেচি কিছুটা কমে।
রোগী পরীক্ষা করে মেহেদী দেখে, মাথার উপরে আধ ইঞ্চি মতো জায়গা কেটে গেছে। কাটাটা খুব বেশী গভীর না। যে রকম মারাত্মক বর্ণনা দিয়েছে লোকজন, তার তুলনায় আঘাত প্রায় কিছুই না। একটা সেলাই-ই যথেষ্ট। পাশে রাশেদের দিকে তাকিয়ে মেহেদী বলে - ‘তেমন সিরিয়াস না, একটা স্টিচ দিলেই চলবে।
রাশেদ জিজ্ঞেস করে- ‘স্যার, ভর্তি....?’
‘লাগবে না। যদি...’ কথা শেষ করতে পারে না মেহেদী।
গর্জে ওঠে লোকজন- ‘ধর শালারে। লোক মরতাছে, আর কয় সিরিয়াস না। ভর্তি করবো না? সিরিয়াস ওর .... দিয়া ভইরা দিমু।’
লজ্জায়, অপমানে নির্বাক হয়ে যায় মেহেদী। উত্তেজিত কয়েক লোক এগিয়ে আসে ওর দিকে। ওদের পক্ষেরই কয়েকজন আবার ঠেকায়। খালেক বলে- ‘আচ্ছা দেখতাছি, গালাগালি কইরেন না, আপনারা বাইরে যান, রোগীর চিকিৎসা করতে দেন আগে।’
‘টাকা খাইছে’.. ‘ভর্তি না কইরা কই যায় দেখুমনে’ ..‘নয়া আইছে?’ - ইত্যকার মন্তব্য ছুটে আসে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে মেহেদী। রাশেদ ত্বরিৎ সেলাইয়ের প্রস্তুতি নেয়। মেহেদীকে সরিয়ে দেয় ওখান থেকে -'স্যার, আপনে গিয়া বসেন। আমি সেলাই করতেছি।’
অপমানে দিশাহারা মেহেদী কোনমতে গিয়ে চেয়ারে বসে। ভর্তি দেবে না- এমনটা বলেনি সে। কেবল বলেছে - ভর্তি লাগবে না। চিকিৎসক হিসেবে তো তার দায়িত্ব, রোগীর সঠিক অবস্থা ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথাটা বলা। তা-ই তো সে বলেছে! আরএমও বলেছিলেন, মারামারির রোগী যদি ভর্তি হতে চায়, রেখে দিও। এখানে চাওয়া না চাওয়ার প্রসংগ আসারই তো সুযোগ পেল না 'লাগবে না’ - এর পরের বাক্য 'যদি ওরা চায়, তাহলে থাকুক’- এ কথাটা বলার সুযোগই তো তাকে দেয়া হলো না। তার আগেই এ অপমান! ভর্তি করা লাগবে কি লাগবে না- এটা চিকিৎসক বুঝবে। এরা সিদ্ধান্ত দেয়ার কে? ভেতরে রাগ ফেনিয়ে উঠতে থাকে মেহেদীর। এই রোগী ভর্তি করবে না সে।
সেলাই দিয়ে রোগীর নাম-ঠিকানা রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখে রাশেদ। খাতাটা ওর দিকে বাড়িয়ে দেয় -'স্যার, নোট?’
ওখানে নোট লেখে না সে। কেউ শিখিয়ে না দিলেও এ কদিন রেজিস্টার খাতা দেখে সে শিখে ফেলেছে ইনজুরি নোট কিভাবে লিখতে হয়। তবে আরএমও বলে গেছেন, ইনজুরি নোট খাতায় না তুলতে। আলাদা কাগজে নোট লিখে রাখতে বলেছেন, তিনি এসে দেখবেন পরে। এ কারণে আলাদা কাগজে নোট লেখে সে - ক্ষতের স্থান, দৈর্ঘ্য, গভীরতা ইত্যাদি। রেজিস্টার খাতাটা পাশে সরিয়ে রাখে।
সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা মুরব্বী গোছের এক লোক জিজ্ঞেস করে - ‘নোট লেখলেন না।’
শান্ত গলায় উত্তর দেয় মেহেদী- ‘লিখছি।’
‘কই? - আবার প্রশ্ন করে লোকটি।
‘আপনাকে দেখাতে হবে?’ এবার একটু বাঁকা করে বলে মেহেদী।
‘অবশ্যই। আপনি টাকা খায়া সার্টিফেট উল্টায়া দিবেন, তা তো হইতে দিমু না।’- উত্তেজিত হয় লোকটি।
খালেক তাকে সরিয়ে নিয়ে কানে কানে কি যেন বলে। লোকটা এবার প্রসংগ পাল্টায় - ‘ভর্তি লেখেন।’
মেহেদী খেপে যায়, কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে জোরেই বলে- ‘ভর্তি করবো কি করবো না, এইটা আপনে বলবেন? না আমি ডিসাইড করবো? এর ভর্তি লাগবে না। ওষুধ লিখে দিতেছি। বাড়ি নিয়া খাওয়ান।’ রাশেদের দিকে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশন লেখার কাগজ চায়- ‘কাগজ দেন।’
মেহেদীর আওয়াজ জরুরী বিভাগের বাইরে চলে যায় বুঝি। উত্তেজিত লোকজন রুমে ঢুকে পড়ে আবার। - ‘ভর্তি দিবো না মানে?’.. ‘অক্ষণ ভর্তি কর।’ ‘অর বাপের হাসপাতাল নাকি? ভর্তি করলে অর বাপের ট্যাকা যাইবো?’.. ‘সরকারী হাসপাতাল, এইখানে ভর্তি করবো না কেন?’.. ‘আমরা কইতাছি তাই ভর্তি করবি।’.. ‘এইখানে ডাকতরি করতে চাইলে আমগো কথামতোন উঠতে-বসতে হইবো। নইলে চাকরী করতে পারবি না।’ - মারমুখী হয়ে ওঠে লোকজন।
তুই - তোকারী শুনে মাথার ভেতর ক্রোধ বলকে বলকে ওঠে মেহেদীর। চাকরী করতে পারবে না মানে? চাকরী কি এরা দিয়েছে তাকে? এদের কথামতো উঠতে-বসতে হবে?
মেহেদী কিছু বলার আগেই রাশেদ বলে ওঠে -‘আরে ভর্তি করবো না বলি নাই তো আমরা। ভর্তি থাকতে চাইলে থাকবেন। ভর্তি লিখা দিতাছি। আপনেরা থামেন। বাইরে যান।’
অবাক দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকায় মেহেদী। রাশেদ তার হাত চেপে ধরে বলে- ‘স্যার, ভর্তি রেখে দেন। নইলে এখন সমস্যা হয়ে যাবে।’
খালেক লোকজন বের করতে থাকে। বলে -‘আসেন, রোগী নিয়ে ওয়ার্ডে আসেন। আমি পরে ভর্তির কাগজ নিয়ে আসতেছি।’
রোগী নিয়ে অধিকাংশ লোকজন দোতলায় ওয়ার্ডের দিকে চলে যায়। কয়েকজন তবু রয়ে যায়। রাশেদ তাদেরকে যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়- ‘যান যান, আপনারা উপরে যান। ওষুধ লিখে পাঠায়া দিচ্ছি।’
‘বড় আইছে ডাক্তারগিরি দেখাইতে। আমগো কথা শুনবো না। চাকরি খায়া ফেলামু না! ’ গজ গজ করতে করতে বের হয় লোকগুলো।
চাকরী খাওয়ার কথা শুনে আবার মাথায় আগুন ধরে মেহেদীর। সে-ও উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে যায়। বুঝতে পেরে আবার হাত চেপে ধরে রাশেদ। নিচু স্বরে বলে - ‘স্যার, কিছু বইলেন না। এখানকার লোকজন এমন-ই। কিছু বললে আপনের উপর হাত উঠাইতেও বাধবে না এদের। ভর্তি থাকুক। কালকে আরএমও স্যার আইসা দেখবো।’
ভর্তির কাগজে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অর্ডার লিখে রুমে চলে আসে মেহেদী। কিন্তু শরীর জুড়ে জ্বালা করতে থাকে তার। কি দোষ ছিল তার, যে এমন তরো কথা শুনতে হবে তাকে? অপমানে কান্না পায়, চোখে ঘুম আসে না আর।
এক ঘন্টা পর আবার ফোন আসে রাশেদের - ‘স্যার আরেকটা অ্যাসল্ট কেস আসছে। আগেরটার অপজিট পার্টি। এরেও কিন্তু স্যার ভর্তি রাখা লাগবে।’ শেষ কথাটা নিচু স্বরে এবং বিনীতভাবেই বলে সে। কিন্তু কথাটা মেহেদীর আঁতে ঘা লাগায়। রোগী ভর্তি করা না করার সিদ্ধান্ত কি সে নিতে পারবে না? কেন?
রোগী দেখার আগেই সাথের লোকজন বলে-‘ভর্তি করেন।’
কিছুটা বিরক্ত স্বরেই মেহেদী বলে-‘আগে দেখতে দেন রোগী। তারপরে না ভর্তি।’
‘দেখেন দেখেন’ - অবহেলার স্বরে বলে কমবয়সী এক তরুণ। - ‘ভালা করে নোট লিখে রাখেন। ছাব্বিশের সার্টিফিকেট লাগবো।’
‘ছাব্বিশের সার্টিফিকেট’ কি জিনিস জানে না মেহেদী। তবে তা নিয়ে মাথাও ঘামায় না। রোগী দেখে। রোগীর গায়ে দৃশ্যমান কোন ক্ষত চিহ্ন নেই। কোন কাটা না, কোন ফোলা না। রোগী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ট্রলির উপর। মাঝে মাঝে মাথায় হাত দিয়ে কাতরে উঠছে।
‘গায়ে তো কোন আঘাত নাই’ - বলে মেহেদী।
ঐ তরুণটিই বলে- ‘চোরা মাইর মারছে, তাই দাগ নাই। দেখেন না রোগী ব্যথায় মরতাছে। অত কথা না কইয়া ভর্তি দেন আর ওষুধ দেন।’
‘মাথায় লাগছে?’ জিজ্ঞেস করে মেহেদী।
‘হ। মাথায় মোটা লাঠি দিয়া বাইড়াইছে।’- আরেকজন বলে। রোগীও মাথা ঝাঁকায়।
‘বমি করছে না কি রোগী?’
‘না, বমি করে নাই।’ বলে একজন। পাশ থেকে আরেকজন বলে - ‘বমি বমি ভাব করতেছিল।’
আরেকজন যোগ করে - ‘আরে না, বমি করছে তো।’
‘বমি করলে কিন্তু কেস সিরিয়াস। ব্রেনের ভিতরে ক্ষতি হইতে পারে। তাহলে সিটি স্ক্যান করাতে হবে। এই হাসপাতালে তো সিটি স্ক্যান মেশিন নাই, বাইরের কোন ক্লিনিকেও নাই। রোগীরে তো সদর হাসপাতালে নিতে হবে।’
এবার সমস্বরে একমত হয় সবাই - ‘না না বমি করে নাই। সদরে নিতে হইবো না। এইখানেই ভর্তি রাখেন। এইখানেই ভালো হইবো।’ সঙ্গে যোগ করে একজন -‘ওদের লোক ভর্তি রাখছেন। আমাদের রাখবেন না কেন? ওরা দিছে কত, কন? আমরা তার চেয়ে বেশীই দিমু।’
কোথাও কোন আঘাত নেই - বুঝতে পারে মেহেদী। থাকলেও গুরুতর তো নয়-ই। একে ভর্তি রাখতে ইচ্ছে হয় না তার। কিন্তু এই মুহূর্তে এদের সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। খুব ক্লান্ত লাগে মেহেদীর। কিছুটা ঘুমও তো দরকার। কাল সকাল থেকে আবার বসতে হবে আউটডোরে। সব রোগী সামলাতে হবে একাই। রাশেদও পাশ থেকে বলে - ‘স্যার, রেখে দেন।’
ভর্তি লিখে দেয় মেহেদী।
ফিরে এসে যখন বিছানায় যায় ফজরের আযান ভেসে আসে কানে। ..
ঘুম ভাঙার কথা অ্যালার্মের শব্দে, কিন্তু ভাঙে মোবাইল ফোনের রিং টোনে। রাশেদ করেছে ফোন -‘স্যার, বাবলু সাহেব আপনের সাথে দেখা করতে চায়, কালকের মারামারির রোগীর ব্যাপারে।’
‘এখন? আমি অফিসে আসলে আসতে বলেন।’ ঘুম-জড়িত কন্ঠে বলে মেহেদী।
‘স্যার, এখনি আসলে ভাল হয়।’- নিচু অথচ জরুরী স্বরে বলে রাশেদ।
‘বাবলু সাহেবটা কে?’
‘স্যার, উনি এইখানকার নেতা।’
‘আচ্ছা আসতেছি।’ - বলে ফোন কাটে মেহেদী। ঘড়িতে দেখে, সাড়ে সাতটা বাজে। অ্যালার্ম দেয়া আটটায়। আটটায় অফিস টাইম হলেও ওই সময় হাসপাতালে যাওয়া লাগে না। প্রথম দুদিন গিয়ে দেখেছে মেহেদী, জরুরী বিভাগ ছাড়া বাকী সব রুম বন্ধ। নয়টা-সাড়ে নয়টার আগে অফিস আর আউটডোরের কোন কর্মচারীই আসে না। দশটার আগে আউটডোরে রোগীই আসে না। এর আগে কখনো কখনো জরুরী রোগী আসে। তেমন ক্ষেত্রে মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্টরা সামলায়, প্রয়োজন বুঝে তাকে বা আরএমও-কে ডাক দেয়। তাই, এখন সে-ও হাসপাতালে যায় নয়টার পরে। আরএমও-ও কখনো আগে আসার ব্যাপারে তাগাদা দেয় না তাকে। আজ আরএমও নেই বলে আরেকটু আগে উঠতে চেয়েছিল সে, কখন কোন সমস্যা হয় ভেবে আগেই তৈরী থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু উঠতে হলো তার পূর্ব-নির্ধারিত সময়েরও আগে।
দাঁতটা ব্রাশ করে কাপড় পরে হাসপাতালে যায় মেহেদী। জরুরী বিভাগে পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে বসে আছে লোকটা। রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে। ও দুটো চেয়ারে ডাক্তার আর মেডিকেল অ্যাসিসটেন্টরা বসে। টেবিলের সামনে রোগী ও অন্যান্যদের বসার জন্য দুটো চেয়ার রাখা আছে। ওখানে বসে নেই কেউ।
রাশেদ মেহেদীকে দেখে বলে- ‘স্যার আসছেন।’
লোকটা বসে থেকেই হাত বাড়ায় - ‘স্লামালিকুম, ডাক্তার সাহেব। বসেন।’
লোকটার বসা আর কথা বলার ভঙ্গিতেই পিত্তি জ্বলে যায় মেহেদীর। ইচ্ছে হয়, ঝাড়ি মেরে লোকটাকে চেয়ার ছেড়ে উঠতে বলে। কিন্তু রাশেদই যেখানে কিছু বলেনি, সেখানে ঝাড়ি মারাটা ঠিক হবে কি না ভাবে মেহেদী। লোকটার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে সামনের চেয়ার দুটো দেখিয়ে শান্ত গলায় বলে - ‘সামনে বসেন।’
লোকটা কথাটার মর্মার্থ বোঝে না অথবা বুঝলেও এড়িয়ে যায়। - ‘নাহ , ঠিক আছে, অসুবিধা নাই। আপনে বোধহয় নতুন আসছেন। আপনের সাথে পরিচয় হয় নাই। আমার নাম বাবলু। আমি এলাকারই ছেলে। সবাই বাবলু নেতা বলেই ডাকে। সভাপতি সাহেবের ছোট ভাইয়ের সাথে চলি। সভাপতি সাহেবের খুবই কাছের লোক। একদম ঘরের ছেলের মতোন। আপনার নাম কি?’
‘ডাঃ মায়েদুল হাসান মেহেদী।’
‘ও। তা বাড়ি কই?’
লোকটা আলাপের আমেজে থাকলেও মেহেদীর আলাপচারিতায় কোন আগ্রহ নেই। এমনিতেই ঘুম হয়নি রাতে। এখন উঠতে হয়েছে আগে, তার উপর গোসলটাও করা হয়নি। সকালবেলা গোসল না করলে সবকিছু অসহ্য লাগে তার। এখন অসহ্য লাগছে লোকটাকে। তাই উত্তর দেয় না সে। উল্টো প্রশ্ন করে- ‘জরুরী কোন কাজে আসছেন, নাকি ¯্রফে গল্প করতে?’
লোকটা একটু থমকায়। তারপর মুখে হাসি টেনে বলে - ‘সকাল সকাল ঘুম ভাঙাইছি বইলা রাগ করছেন মনে হয়। আচ্ছা যাই হোক, আমি আসছি কালকে রাত্রের রোগীটার ব্যাপারে। মানিক। আমাদের খাস লোক।’
‘কালকে রাত্রে তো দুটা রোগী ভর্তি হইছে?’
‘হ্যা, ঐ যে, যেইটার মাথা ফাইটা দুই ভাগ হয়া গেছে।’
বিরক্তিতে ভ্রƒ কুঁচকায় মেহেদী। বুঝতে পারে- যে রোগীর মাথায় সেলাই লেগেছে, তার কথা বলছে লোকটা।-‘হু , বলেন।’
‘ওর জন্যে একটা ইনজুরি সার্টিফিকেট লাগবে। কড়া সার্টিফিকেট।’
‘হুম। সার্টিফিকেট পাবে। মামলা করুক। পুলিশ রিক্যুইজিশন পাঠালেই আমরা সার্টিফিকেট দিয়ে দেব।’
‘না না, আপনে বুঝেন নাই। সার্টিফিকেট আজকেই লাগবো। এলাকায় আমরা সালিশ ডাকছি আজকে বিকালে। আপনে এখন সার্টিফিকেট লিখা দেন।’
‘সার্টিফিকেট তো এমনে হয় না। মামলা তো করা লাগবে আগে। আপনি যেহেতু এলাকার নেতা, নিশ্চয়ই জানেন, সার্টিফিকেট কখন দেয়।’ শান্ত গলায় খোঁচা দেয়ার চেষ্টা করে মেহেদী।
খানিকটা চেতে ওঠে লোকটা - ‘সার্টিফিকেট কেমনে হয়, সেটা আমারে শিখাইতে হবে না। আমি জানি, সার্টিফিকেট কেমনে হয়। আপনে দিবেন কি না বলেন, না দিলে কেমনে নিতে হয়, সেটাও আমরা জানি।’
এবার অন্য পথ ধরে মেহেদী -‘দেখেন সার্টিফিকেট তো আমি দেই না। দেয় আরএমও দাদা। তিনি আসুক।’
‘সে কখন আসবে?’
‘তাঁর তো আজকে সদরে মিটিং। রাত্রে কিংবা কালকে সকালে আসবেন।’
‘না না, অতক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। আপনেই দেন। আপনেই পারবেন।’
বিরক্ত লাগে মেহেদীর। স্বর কড়া হয় কিছুটা - ‘দেখেন, আমি সার্টিফিকেট দিতে পারবো না। আপনি কাল আসেন।’
‘ঠিক আছে’ - উঠে দাঁড়ায় লোকটা। ‘সার্টিফিকেট কেমনে নিতে হয়, জানা আছে আমাদের।’
চলে যায় লোকটা। রাশেদের দিকে তাকায় মেহেদী - ‘কে লোকটা?’
মশা তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায় রাশেদ- ‘পাতি নেতা। নেতাদের চ্যালা থাকে না ? - ঐ রকম। সরকারী দলের এই উপজেলার সভাপতির ছোট ভাই মিঠুনের সাথে চলে। দলের কোন পোস্টে নাই।’
‘ঘটনা কি?’
‘যে দুই জন ভর্তি হইছে কালকে, ওরা দুইজন চাচাতো ভাই। জমি-জমা নিয়া ঝামেলা। দুই ভাইয়ে মারামারি করছে কাল রাতে। এখন দুই ভাইরে দুই গ্রুপ সাপোর্ট দিতেছে। দুই গ্রুপই আবার সরকারী দলের। আসল ঘটনা পলিটিকাল কিছু না।’
‘আবার তো আসবে মনে হয়। সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা কি করি? মামলা ছাড়া সার্টিফিকেট হয় না কি?’
‘ফোনে আরএমও স্যারের সাথে আলাপ করেন। মামলা করা ছাড়া আপনে সার্টিফিকেট দিতে যাইয়েন না। ফ্যাসাদে পড়বেন। আরএমও স্যার দেয় মাঝেমধ্যে - কিন্তু অবস্থা বুইঝা। ঝামেলাও হয়। মানুষ বহুত খারাপ এখানকার। আরএমও স্যার এইখানকার বইলা মিটায়া নেয়। আপনে তো বাইরের। সার্টিফিকেটের ঝামেলাতেই যায়েন না। এখন যান। রেস্ট করেন। খাওয়া-দাওয়া কইরা আসেন।’
মেহেদী ঝামেলায় যেতে না চাইলেও ঝামেলা নিজ থেকেই চলে আসে তার কাছে। প্রথমে আসে ফোনে। রুমে ফিরে গোসলখানায় ঢুকতে যাবে, এ সময় ফোন - ‘ডাক্তার সাহেব?’
‘জ্বি বলছি। কে?’
‘আমাকে হয়তো চিনবেন না। পরিচয় হয় নাই। আপনে নতুন আসছেন তো। আমার নাম মিঠুন সিদ্দিকী। সভাপতি সাহেবের ছোট ভাই আমি।’
‘আচ্ছা। নাম শুনেছি আপনার।’
‘ও, তাহলে তো ভালই। আমার লোক গেছিল কিছুক্ষণ আগে আপনের কাছে। আপনে নাকি সার্টিফিকেটের জন্যে দশ হাজার টাকা চাইছেন?’
মেজাজ চড়ে যায় মেহেদীর। কিন্তু শান্ত থাকার চেষ্টা করে - ‘মিথ্যা কথা। আপনার লোক আসছিল। কিন্তু টাকা-পয়সা নিয়া কোন আলাপ হয় নাই।’
‘অসুবিধা নাই। আলাপ না হইলে এখন করতে পারেন। কত চান?’
‘দেখেন, আপনারা মামলা করেন আগে, পুলিশ চাইলে আমরা এমনি সার্টিফিকেট দিয়া দিব।’
‘মামলা করবো কি করবো না, সেইটা আমাদের ব্যাপার। আপনেরে সার্টিফিকেট দিতে বলছি, আপনে দিবেন। সার্টিফিকেট লিখে রাখেন। এক ঘন্টা পর আমার লোক যাবে নিয়ে আসতে।’
আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না মেহেদী।
‘সার্টিফিকেট আমি দিব না’- বলে লাইন কেটে ফোনটা ছুঁড়ে মারে বিছানায়। ঢুকে যায় বাথরুমে।
গোসল করে ফিরে দেখে এরি মধ্যে ঐ একই নম্বর থেকে ফোন এসেছিল কয়েকবার। আরএমও-কে ফোন দিতে হবে- ভাবে সে। সকালের নাস্তাটা করে এসেই ফোন দেবে।
নাস্তা করতে যেতে হবে বাজারে। সে বাজারও হাসপাতাল থেকে দশ মিনিট হাঁটা পথ। নয়টার আগ পর্যন্ত এ পথে রিক্সা পাওয়াও মুশকিল।
রেডি হয়ে বেরুতেই দেখা হয় এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর সাথে। নাম মাসুদ। উপজেলাতেই বাসা। স্থানীয় একটা ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ। কোম্পানীটির নাম এখানে আসার আগে কখনো শোনেনি মেহেদী। কয়েক দিন ধরে পরিচয় মাসুদের সাথে। মটর সাইকেলে চড়ে সকাল সকালই ভিজিট করতে চলে এসেছে আজ।
‘স্যার কোথায় যান?’ জিজ্ঞেস করে মাসুদ।
‘নাস্তা করতে যাব, বাজারে।’
‘চলেন স্যার, মটর সাইকেলে ওঠেন।’
‘না না, অসুবিধা নাই। আমি যেতে পারবো।’
‘রিক্সা পাবেন না স্যার এখন। ওঠেন। আমি পৌঁছায়া দিয়া যাব।’
মটর সাইকেলে ওঠে মেহেদী। বাজারে এসে ঢোকে এক হোটেলে। অপরিচ্ছন্ন, ঘিঞ্জি হোটেল। কিন্তু কিছু করার নেই। এসব হোটেলেই খেতে হচ্ছে। এখনো রান্নার জন্য বুয়ার যোগাড় হয়নি। খালেককে বলে রেখেছে মেহেদী। কিছুদিনের মধ্যে যোগাড় করে দেবে- আশ্বাস দিয়েছে খালেক।
পরোটা-ডিম ভাজি অর্ডার করে মেহেদী। মাসুদ নাস্তা করেছে কি না জিজ্ঞাসা করে। মাসুদ বলে- ‘আমি নাস্তা করছি স্যার , আপনি খান। আমি একটু অর্ডার কেটে আসি সামনের ফার্মেসী থেকে। দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবো।’
‘অসুবিধা নাই। আপনে আপনের কাজ করেন। আমি চলে যেতে পারবো।’
‘না না স্যার। আমিই পৌঁছায়া দিব। এই, স্যারের বিল আমি দিব।’ ক্যাশে বসা লোকটির উদ্দেশ্যে শেষ বাক্যটি বলে চলে যায় মাসুদ।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে হোটেলে ঢোকে বাবলু। সাথে আরও চারজন। বসে মাসুদের সামনের বেঞ্চিটাতে। পাঁচজনের মধ্যে নেতাগোছের লোকটা মেহেদীর উদ্দেশ্যে বলে - ‘কি ডাক্তার সাব , খাইতে আসছেন?’
মাথা উপর-নিচে করে মেহেদী। কন্ঠ শুনে আন্দাজ করতে পারে, লোকটা কে। বিপদের গন্ধ পায়।
‘এই, ডাক্তারের জন্য ভালো কইরা পরোটা বানা। বিল আমি দিব।’ পরোটা বানাতে থাকা লোকটার দিকে চেয়ে বলে নেতা। তারপর মেহেদীর দিকে ফিরে বলে - ‘আমারে চিনতে পারেন নাই বোধহয়। একটু আগে ফোনে কথা হইছিল। আমার নাম মিঠুন। আপনি তো ফোনটা কাইটাই দিলেন। এরপর এতবার ফোন দিলাম। ধরলেনই না।’
চোয়াল শক্ত হয় মেহেদীর। জবাব দেয় না কোন। কিছুক্ষণ কাটে নিরবতায়। নিরবতা ভাঙে মিঠুনই - ‘নতুন আসছেন, এলাকার কায়দাকানুন বোধহয় ঠিকমতো জানেন না এখনও। অসুবিধা নাই, শিখা যাবেন শীগগিরই। এখন সার্টিফিকেটটা লেখেন।’
পাশ থেকে একজন সাদা কাগজ এগিয়ে দেয়। কলমও।
এদের সাহস দেখে স্তম্ভিত হয় মেহেদী। তবে কন্ঠে নির্বিকার ভাব বজায় রাখে- ‘আমি তো সার্টিফিকেট দেই না। আরএমও দেন। উনার সাথে কথা বলতে হবে।’
‘লিয়াকত দাদা তো? দেন, ফোন দেন। উনি আমাকে ভালো করেই চিনেন। কত সার্টিফিকেট নিছি উনার কাছ থেকে। আচ্ছা, আমিই ফোন দেই ওনারে।’ বলে মিঠুন নিজেই মোবাইলে ডায়াল করতে থাকে।
‘ফোন তো বাজে না দাদার। বন্ধ।’ শুনে ধ্বক করে ওঠে মেহেদীর বুকের ভেতরটায়। দ্রুত নিজের ফোন দিয়ে চেষ্টা করে। আসলেই ফোন বন্ধ আরএমও-এর। কি করবে এখন সে?
‘তাহলে আরএমও দাদা আসুক। তারপর নিয়েন।’
‘অতো সময় থাকলে তো আর আপনেরে ডিস্টার্ব করতাম না। আজকে বিকালেই সালিশ। এখনি সার্টিফিকেট লাগবো।’- মুখে হাসি ধরে রাখে মিঠুন। কিন্তু দৃষ্টিতে নিষ্ঠুর শীতলতা।
ঐ দৃষ্টির নিষ্ঠুরতা ভেতরে ভয়ের কাঁপন জাগায়। তবু মেহেদী নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চায় - ‘সার্টিফিকেট কেমনে লিখতে হয়, এটাতো আমি জানি না, লিখি নাই কখনো।’
‘অসুবিধা নাই। আমি শিখায়া দিব কেমনে লেখতে হয়। আপনে শুরু করেন।’
যে করেই হোক হাসপাতালে যেতে হবে - ভাবে মেহেদী। আজ নাস্তা করতে বাইরে আসাটাই ভুল হয়েছে। হাসপাতালের ভেতর নিশ্চয়ই এতটা সাহস পাবে না এরা। ওখানে অন্য কর্মচারীরা থাকবে। তেমন দরকার পড়লে পুলিশও ডাকা যাবে। বলে - ‘আমাকে তো রেজিস্টার খাতা দেখতে হবে। হাসপাতালে চলেন।’
‘কোন খাতা-ফাতা দেখার দরকার নাই। নাম ঠিকানা আমার কাছে আছে, নেন।’ - বলে একটা ছোট কাগজ এগিয়ে দেয় মিঠুন। ওতে আহতের নাম-ঠিকানা লেখা।
‘কিন্তু রেজিস্ট্রেশন নম্বর?’
কন্ঠে অসহিষ্ণুতা মিঠুনের - ‘অতো তাফালিং কইরেন না। বাকীটুক লেখেন। বাবলু, তুই যা। ইমারজেন্সী থেইকা খাতাটা নিয়া আয়। না দিতে চাইলে আমারে ফোন দিবি।’
ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো লাগে নিজেকে মেহেদীর। তবু চেষ্টা চালায় - ‘রোগীর কোথায় আঘাত এটা তো মনে নাই। রোগী দেখতে হবে।’
এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মিঠুন - ‘কোন দরকার নাই। মাথার ডান পাশে এইখানে কাটছে।’- বলে মেহেদীর মাথার ডান দিকে হাত দিয়ে জোরে চাপ দেয় মিঠুন। অপমানে গা রি রি করে মেহেদীর।
‘সীল তো লাগবে...’
‘রেজিস্টার খাতা যদি আনতে পারি, সীলটা যোগাড় করতে পারবো না? লেখেন, চার ইঞ্চি লম্বা কাটা, হাড্ডি পর্যন্ত গভীর। ধারালো অস্ত্র।’
বড়জোর আধ ইঞ্চি লম্বা ছিল কাটাটা, মনে আছে মেহেদীর। গভীর ছিল না মোটেও। ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন নেই, লাঠি বা বাঁশের আঘাতে হতে পারে ও ধরণের ক্ষত।
‘কিন্তু....’ বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায় মেহেদী।
মিঠুনের হাতে দেখা যাচ্ছে কালো চকচকে একটা পিস্তল। প্যান্টের পকেট থেকে বের করেছে সে ওটা। পিস্তলের নল তাক করা মেহেদীর বুক বরাবর।
অবস্থা বুঝতে পেরে একে একে কেটে পড়ছে হোস্টেলের কাস্টমাররা।
মেহেদী বুঝতে পারছে, তার কিছু করার নেই এখন আর। কথামতো না চললে গুলী করতে দ্বিধা করবে না এরা।
শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণই করতে হয় তাকে। মিঠুনের চাহিদামতো সার্টিফিকেট লিখে দেয় মেহেদী।
মাসুদ ফেরে না আর। হয়তো এসে অবস্থা দেখে ফিরে গেছে। অথবা হয়তো সে-ও ছিল এই পরিকল্পনার অংশ। কে জানে? রিক্সা ডেকে হাসপাতালের পথে রওয়ানা দেয় মেহেদী।
হাসপাতালে এসে রাশেদকে ডেকে ঘটনাটা জানায় মেহেদী। আরএমও-কে ফোন দেয়ার চেষ্টা করে। ফোন তখনো বন্ধ তার। অপমানের জ্বালা আর উৎকন্ঠায় সময় কাটে মেহেদীর। এর মাঝেই রোগী দেখতে হয় তাকে। আউটডোরে আজ রোগীর চাপ অনেক। সোনিয়াও আসেনি। যদিও সে আসবে বলে গিয়েছিল গতকাল, তবু এ কদিনে মেহেদী বুঝে গেছে, তার কথার উপর ভরসা করা নেহায়তই বোকামী। দেখতে হয় ইনডোরের রোগীগুলোও। জরুরী বিভাগেও আজ যেন রোগীর ভিড় বেশী। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসে কয়েকজন। আসে মারামারির রোগীও। সব মিলিয়ে দিশেহারা বোধ করে মেহেদী।
দুপুর বেলা ঘটে আরেক ঘটনা। রোগীর ভিড় তখনো মেহেদীর টেবিলের চারদিকে। ওর জন্য আলাদা কোন পিয়ন নেই এখানে। রোগীদের সিরিয়াল ধরারও কোন বালাই নেই। পঁচিশ-ত্রিশ জন তখনো মেহেদীর সামনে টেবিলের চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ গল্প করছে, কয়েক মহিলা হল্লা করছে, বাচ্চারা কাঁদছে, কেউ থুথু ফেলছে - নাক ঝাড়ছে মেহেদীর চেয়ারের পাশেই। এরই মধ্যে রোগীর কথা শুনছে আর দ্রুত স্লিপে ওষুধ লিখে দিচ্ছে মেহেদী। এ সময় এক দল লোক ঢোকে রুমের ভেতর। ওরা বাকী রোগীদের জোর করে বের করে দেয় রুম থেকে।
‘কারা আপনারা? কি করছেন? কি চান?’- প্রশ্নের জবাব পায় না মেহেদী।
সবাইকে বের করে দেয়ার পর মুরব্বী গোছের এক লোক মোবাইল ফোনে ডায়াল করে তার সামনে দাঁড়িয়েই। ওপাশ থেকে ধরার পর- ‘ডাক্তারের কাছে ফোন দিতাছি’- বলে সে মেহেদীর দিকে মোবাইল সেট এগিয়ে দেয়- ‘কথা বলেন।’
ফোন হাতে নেয় না মেহেদী। প্রশ্ন করে - ‘কে? কার সাথে কথা বলবো?’
অসহিষ্ণু স্বরে লোকটি বলে- ‘আগে ফোন ধরেন, কথা বলেন, বললেই বুঝবেন কে?’
সাথে আসা অন্যেরাও মারমুখী ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে।
তাদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ফোনটা হাতে নেয় মেহেদী। কানের কাছে ধরে - ‘কে বলছেন?’
‘ডাক্তার সাহেব? আমি উপজেলা চেয়ারম্যান বলতেছি। কি শুনতেছি এইসব? আপনি নাকি টাকা নিয়া সার্টিফিকেট লেখা শুরু করছেন? দুদিন হইলো না চাকরিতে ঢুকছেন, এখনি এইসব! আপনে এখনি আমার সাথে দেখা করেন।’
কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে যায় ওপাশ থেকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে মেহেদীর।
মুরব্বী গোছের লোকটা বলে- ‘চলেন।’
সে আমতা আমতা করে- ‘রোগীগুলো দেখে নিই। অফিস আওয়ার শেষ হোক, তারপর যাই?’
‘কি? এত্তবড় সাহস! চেয়ারম্যানের আদেশ শোনে না। ধর শালারে।’- বলে সত্যি সত্যি একজন মেহেদীর কলার ধরে দাঁড় করিয়ে ফেলে। আতংকে বিবশ হয়ে যায় মেহেদীর শরীর। পাশ থেকে দুজন এসে তার হাত ধরে টানতে থাকে। চেয়ারে পা বেধে পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নেয় সে।
এ সময় রুমে ঢোকে রাশেদ, খালেকসহ অফিসের আরো কয়েক কর্মচারী। তারা মেহেদীকে ছাড়ায় উত্তেজিত লোকজনের হাত থেকে। মুরব্বী গোছের লোকটা চিৎকার করতে থাকে- ‘চেয়ারম্যান সাব ডাকছে, এখনি যাইতে হবে ওরে। টাকা খায়া সার্টিফিকেট দেয়, সাহস কত!’
রাশেদ বলে- ‘ঠিক আছে, আমি নিয়া যাইতেছি। আপনারা যান।’
‘আমরা যামু না। আমাদের সাথে ওরে যাইতে হবো।’ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে লোকগুলো। আতংকে নীল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেহেদীও।
ওখানে দাঁড়িয়েই রাশেদ ফোন দেয় আরএমওকে। এবার আরএমও-এর ফোন খোলা পাওয়া যায়। রাশেদ সংক্ষেপে ঘটনাটা জানায় আরএমও-কে। চেয়ারম্যান যে এখনি ডেকেছে মেহেদীকে সে কথাও জানায়।
কথা শেষ করে রাশেদ উপস্থিত লোকদের বলে - ‘আরএমও স্যারের সাথে কথা হইছে। উনি চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন দেবেন। যা হওয়ার আরএমও স্যার ফিরলে হবে। আপনারা এখন যান।’
তবুও দাঁড়িয়েই থাকে লোকগুলো। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যানের ফোন আসে মুরব্বী গোছের লোকটার কাছে। কথা শেষ করে লোকটা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে- ‘চলো সবাই, চেয়ারম্যান সাব যাইতে বলছেন। এরে পরে দেখবো।’
হৈ চৈ করতে করতে চলে যায় লোকগুলো। কিন্তু মেহেদীর আতংক কাটে না। ভয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাশেদ বলে -‘স্যার বসেন, ভয় নাই। আরএমও স্যার ম্যানেজ করবে।’
তবু কিছু বলে না মেহেদী। কতটা নিরাপত্তাহীন সে এখানে- ভাবতেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। খালেক পানি নিয়ে আসে - ‘স্যার পানি খান।’
ঢক ঢক করে পানি গলায় ঢালে মেহেদী। বুকের ভেতরটা তবু শুকনো রয়ে যায় যেন।
আরএমও-এর ফোন আসে মেহেদীর মোবাইলে। ফোন রিসিভ করেই আর স্থির থাকতে পারে না মেহেদী। স্থান-কাল ভুলে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রাশেদ এসে তাকে ধরে।
আরএমও জিজ্ঞেস করে- ‘কি হইছিলো? টাকা নিছো তুমি?’
কান্নার দমকে কথা ভেঙে ভেঙে যায় মেহেদীর - ‘না দাদা, ওরা পিস্তল বের করছিল।....’ কথা শেষ করতে পারে না সে।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি দেখতেছি।’
‘দাদা, আমি ঢাকা চলে যাব এখন।’ কান্না-জড়ানো স্বরে বলে মেহেদী। এই মুহূর্তে পরিবারের, আপনজনদের মাঝে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মনটা আকুল হয়ে আছে তার।
‘আরে না না, এই মুহূর্তে ঢাকা যাইও না। আগে আমি আসি। তবে, আজকে আর ওখানে থাকার দরকার নাই। আমি ফেরার পর তুমি সদরে চইলা আইসো। কিন্তু এখনি ঢাকায় যাইও না। তোমারে দরকার পড়তে পারে। ঝামেলাটা মিটুক। তারপর ঢাকা ঘুইরা আইসো।’
ভয়ে ভয়ে বাকীটা সময় হাসপাতালেই বসে থাকে মেহেদী। রুমে যায় না। আর কিছু না হোক, হাসপাতালে কয়েকজন কর্মচারী হলেও আছে। বাসায় তো কেউই নাই। ওখানে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারবে বিনা বাধায়। কেউ টেরই পাবে না। দুুপুরে খেতেও যায় না সে।
তিনটার দিকে চলে আসেন আরএমও। ঘটনা বিস্তারিত শোনেন মেহেদীর কাছ থেকে। বলেন - ‘ঠিক আছে, আমি দেখি কতদূর কি করা যায়। চেয়ারম্যান আর সরকারী দলের সভাপতি দুই গ্রুপের তো, এই জন্যে ভেজালটা বেশী। তুমি আপাতত সদরে চলে যাও। কারো বাসায় বা হোটেলে থাক। কালকে সকাল সকাল চইলা আইসো। এই সময় ঢাকা গেলে কিন্তু বড় বিপদে পড়বা। খবর বোধহয় এমপি পর্যন্তও গেছে।’
রুমে ফিরে ব্যাগ গোছায় মেহেদী। জেলা সদর এখান থেকে বাসে প্রায় দেড় ঘন্টার পথ। জেলা সদরে ওদের মেডিক্যালের এক বড় ভাইয়ের পোস্টিং। আগের বিসিএসে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। থাকেন সদর হাসপাতালের ডক্টরস কোয়ার্টারে। তাকে ফোন করে মেহেদী।
ফোন করে সরকারী দল সমর্থক চিকিৎসক সংগঠনের সাথে জড়িত ওর এক সহপাঠীকেও। যে করেই হোক এই উপজেলা থেকে বদলী হতে হবে তাকে। যাকে ধরা লাগে ধরবে সে, ঘুষ লাগলে তা-ও দেবে। তবু এই এলাকায় আর নয়।
...............................................
‘শব্দঘর’ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:৩৯