
আমাদের বাড়ির পাশে বিক্রমপুরে জন্ম নিয়েছিলেন একজন নাস্তিক ধর্মগুরু, যার বাড়ি এখনও নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মগুরু অতীশ দীপঙ্কর। এই ভারতীয় ভূমি থেকে জন্ম নেওয়া দর্শন এবং এখানেই বিকশিত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম। বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহার এ অঞ্চলেরই। মাটি খুড়লে এখনও বেড়িয়ে আসে প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি। এ অঞ্চলেই ছিল বৌদ্ধদের পাল শাসন। মোটা দাগে এই বাংলা ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখায় আমরা পাই বৌদ্ধদের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। যেখানে বৌদ্ধরা চতুর্দশ শতাব্দীতে হারিয়ে গেলেও এর শুরু হয়েছিল বুদ্ধের মৃত্যুর পর থেকে, কুশান রাজ বংশের শাসনামলে যখন প্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়। তখন থেকে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে হিন্দু রীতিনীতির যোগ হতে থাকে। রক্তমাংসের মানুষ বুদ্ধ হয়ে উঠেন ঈশ্বর, শুরু হয় বুদ্ধের পূজা। অথচ বুদ্ধ রক্ত মাংসের মানুষ বৈকি আর কিছুই নন। বুদ্ধের মৃত্যুর আড়াইশো বছর পর রচিত হয় বুদ্ধের বাণী সংবলিত ত্রিপিটক। বৌদ্ধ ধর্মে স্বর্গ-নরক থেকে শুরু করে মহাজন এবং তন্ত্রজান বুদ্ধ ধর্মের ধারনি,গুহ্য সমাজ,চক্র সংবর, মঞ্জুশ্রী মূল কল্প, তৎকালীন ব্রত শ্চারন, বলি পূজা, পুরশ্চরন ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা হলো। স্তবিরবাদ এবং মহাসঙ্ঘবাদের আবির্ভাব হলো।
যদি বুদ্ধকে পাও তবে তাকে হত্যা করো। অথচ বুদ্ধকে হত্যা করা গেল না। বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধই ঈশ্বর হয়ে উঠলেন। হিন্দু ধর্মের বাতাবরণ বৌদ্ধ ধর্মের স্বকিয়তাকে নষ্ট করে করে দিলো। মৌর্যরা নির্মাণ করেছিলো হাজার হাজার স্তুপ, যেই স্তুপ থেকে সৃষ্টি হয় তীর্থ যাত্রার। দ্বিতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যে বড় পরিবর্তন সাধনের ফলে অব্রাহ্মণ ধর্মকে খারাপ চোখে দেখা শুরু হলো৷ ব্রাহ্মণবাদের প্রভাবে বৌদ্ধ জনপদে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার বৌদ্ধরা তাদের মূল জনপদ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলো।
সেন শাসনামলে শুধু বৌদ্ধরা নয়, ক্ষুদ্র বর্ণের হিন্দুরাও পড়েছিল চরম বিপাকে। শোষণে বিদ্রোহী হয়ে উঠে কখনও অন্তজেরা, কখনও বৌদ্ধেরা।
প্রদোষে প্রাকৃতজন গ্রন্থের প্রারম্ভে শওকত আলী বলছেন, "উপন্যাসটি লেখার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা ছিল আমার একটা প্রশ্ন। মুসলমান যারা দিগ্বিজয় করতে এসেছে তারা তো ওইদিক দিয়ে এসেছে। তারপর মোগল-পাঠানরাও ওইদিক দিয়ে এসেছে। এটা কিন্তু অবাস্তব কৌতূহলের কিছু নয়। একসময় মুসলমানরা এখানে আধিপত্য করছে, তারা শাসন করেছে ৪০০ বছর। তারা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ওইসব অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। এখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এ সম্পর্কে আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, বইপত্র পড়েছি। একসময় শেখ শুভদয়া নামে একটি সংস্কৃত বই হাতে আসে। কেউ বলেছে সেন রাজত্বের পরপরই ওটা লেখা হয়েছিল। শেখের শুভ উদয়_এই অর্থে। শেখ মানে মুসলমান। ওই বইয়ের মধ্যে কিছু কিছু গল্পের মতো পেয়েছি। যেমন একটা দৃশ্য ওখানে পেয়েছি যে অশ্ব বিক্রেতারা নৌকায় চড়ে অশ্ব বিক্রি করতে এসেছে। অশ্ব বিক্রি হয়ে গেছে। সন্ধ্যা সমাগত। তখন ছয়-সাতজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তিনি উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে মানে সূর্য অস্তের দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কাকে যেন ডাকছেন। তারপর এক জায়গায় গোল হয়ে বসে প্রভু-ভৃত্য সবাই আহার গ্রহণ করছেন এক পাত্র থেকে। আহার শেষে একজন সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছেন, তারপর উবু হয়ে থাকছেন, অবশেষে প্রণাম করছেন, তিনি যা যা করছেন পেছনের সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। সামনে যিনি ছিলেন তিনি কিন্তু প্রভু নন; ভৃত্য। তবু সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। আমি এই দৃশ্যটা আমার প্রদোষে প্রাকৃতজন'র মধ্যে ইচ্ছে করেই দিয়েছি। এ ঘটনাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল এ উপাদানগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়। এ রকম একটা দৃশ্য যদি দেখে সাধারণ মানুষ, যে মন্দিরের ছায়ায় অচ্ছুত নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের পা যেন না পড়ে সে জন্য সকালে মন্দিরের পশ্চিম পাশের এবং বিকালে মন্দিরের পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষের চলাচল বন্ধ, তাহলে তাদের মনে প্রতিক্রিয়া কী হবে? এ রকম একটা অবস্থা সেখানে ছিল। এরপর যখন যবনরা এল, তারা একসঙ্গে বসে, একসঙ্গে ওঠে, একসঙ্গে খায়, প্রভুর উপাসনা করে। আমার নিজের মনের থেকে ধারণা হলো এ অঞ্চলে নিম্নবর্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ছিল এবং এখানে সবাই যবন ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এর কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমি দিতে পারব না। এটা আমার অনুমান। এই ভিত্তিতে আমি উপন্যাসে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেছি।"
সেন শাসনামলে যখন প্রদোষকাল চলছিল, তখন মহামতি বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণ করেন। আমরা তো সেই বাবার কথা জানি, ছেলের আকিকার জন্য গরু কাটার কারণে যার হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল। বাংলায় যখন প্রদোষকাল চলছিল, তখন আবিভার্ব হয়ে প্রাকৃজনের; শুরু হলো মুসলমানদের শাসন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেননি করেছেন বিজয় সেন। প্রাচীন লিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে 'Decline of the University of Vikramsila' প্রবন্ধে একথা স্পষ্ট জানিয়েছেন রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী।
যদিও পারস্যের ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাবাকাতের নাসিরি গ্রন্থে খলজি কর্তৃক নালন্দা ধ্বংসের কথা রয়েছে, কিন্তু ইতিহাসবিদেরা এটাকে উদন্তপুরী মঠ বলে উল্লেখ করেছেন। বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ হয় না, বিজয়ে রক্তের প্রয়োজন। ইতিহাস সরল নয়, এর জন্য চাই আরো গবেষণা।
অথচ বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের বইয়ে সেন শাসনকে মহান করে খিলজির শাসনকে ছোট করা হয়েছে। বাংলাদেশি হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ ও শতবর্ষী শয়তানী এজেন্ডা বাস্তবায়নের চক্রান্ত চলছে। কেননা আমরা দেখেছি শিশুদের পাঠ্যবইয়ে সমকামিতাকে সহজ করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ এই অন্যায় শিক্ষা ও ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদ করুন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৫:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



