বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার একবার তার ফেসবুক পোস্টে লেখেছিলেন, ওয়েস্টে স্যাটেল হওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি কেন ওয়েস্টে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেননি। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওয়েস্টে থিতু হয়ে বসলে সাহিত্যের গভীর কাজগুলো আর ঠিক করা হয়ে উঠবে না। হয়তো বিশ্লেষণ কিংবা গবেষণাধর্মী কাজের ক্ষেত্র বাড়বে, কিন্তু বাংলার মাটি থেকে হয়ে উঠা ব্যাপারটা থাকবে না।
যদিও সৈয়দ ওলীউল্লাহ'র মতো সাহিত্যিকেরা জীবনের বড় একটা সময় ওয়েস্টে কাটিয়েছেন। প্রকাশের আগে কাহলিল জিব্রান তার বিখ্যাত কবিতার পান্ডুলিপি 'দ্য প্রফেট' নিয়ে ঘুরেছেন চার চারটি বছর। সে যাইহোক, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল কিংবা মানুষের সাথে না থাকলে বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠা ব্যাপারটা দুষ্কর।
বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার হাজার মাইল দূরের কোন এক অখ্যাত শহরে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে যখন বাউল আব্দুল করিম কিংবা নজরুল শুনি, তখন মনে হয় যেন বড় দূরে সরে এসেছি, দূরে সরে এসেছি আসমুদ্রহিমাচল। সে যাইহোক, মূল আলোচনায় ফিরছি।
অবসর মতো কথা ভাবা যাবে,
ঢের অবসর চাই;
দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই
-লোকেন বোসের জর্নাল, জীবনানন্দ দাশ
সেলিম আল দীন তার স্বর্ণবোয়াল নাটকে লেখেছেন তিরমন মাঝির কথা। তিরমনের দাদা জনম মাঝি এই স্বর্ণবোয়াল ধরতে গিয়ে বেউলা বিলে ডুবে মারা যান। তার বাবা খলিশা মাঝি এই মাছটিকে একবার শুধু দেখতে পান।
বাবার মৃত্যুশয্যা থেকে শক্তি সঞ্চার করে মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে তিরমন স্বর্ণবোয়াল ধরতে বের হন। তিরমন শত চেষ্টায়ও মাছের দেখা পান না। অবশেষে তিরমনের বরশিতে আটকে যায় স্বর্ণবোয়াল, কিন্তু ডাঙায় এসেই আবার লাফ দিয়ে ফিরে যায় জলে। সারারাতের ক্লান্তি শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন তিরমন, অথচ তিরমনের মনে কোন দু:খ নেই, তার মুখে লেগে আছে আনন্দের ছাপ। যে মাছের জন্য তার দাদা প্রাণ দিয়েছেন, সেই মাছকে তিনি অন্তত বরশিতে আটকে ডাঙায় তুলে এনেছেন। মাছটিকে ধরে আনতে পারেন বা না-ই পারেন, তাতে তার কিছু যায় আসে না। এই যে বরশিতে আটকে ডাঙায় তোলা, এতেই তার আনন্দ।
জীবনে পাওয়া না পাওয়ায় অন্ত:সারশূন্য হবার কিছু নেই, এই জীবন ভ্রমণেই আনন্দ; এর নামই বাঙালি জীবন। সেলিম আল দীন এটাকে নাম দিয়েছেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব।
অন্যদিকে পাশ্চাত্যে আমরা প্রেমের সমাধিতে ট্রয় নগরীর ধ্বংসের ইতিহাস শুনি। হেমিংওয়ে লেখেন ওন্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি। যার মধ্যে বৃদ্ধ লোকটি বিশালাকার মাছটিকে পরাজিত করেন, এখানে জয়ী হওয়াই মূল উদ্দেশ্য। আর এই দর্শনটি প্রকাশিত হয় এক্সিস্টেনশিয়ালিজম নামে।
আলবেয়ার ক্যামু তার দি আউটসাইডার উপন্যাসে লেখেন, ''মা মারা গেলেন। আজ কিংবা গতকাল, আমি ঠিক জানিনা।'' আর এভাবেই রচিত হয় এ্যাবসার্ডিজম।
রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাশি বাজাচ্ছিল। যদিও ইতিহাস বলে কথাটি মিথ্যা। নিরো কী করছিল তার কথা না জানা গেলেও, টাইটানিক মুভিতে একদল ভায়োলিনবাদক কিন্তু জাহাজ ডুবার সময় বাঁচার চেষ্টা করেনি, ভায়োলিনে সে এক করুণ সুর তুলেছিল।
পাশ্চাত্য ও বাঙালি সমাজের পার্থক্য কোথায়?
সেদিন কোথাও নিন্মোক্ত ঘটিনাটি শুনেছিলাম। একটি ছেলে বড় হওয়ার পর তার মা একটি গ্যাস স্টেশনের নিকট ছেলেটিকে রেখে চলে যান। বাড়ি ফিরে ছেলেটি দেখতে পায়, তার সমস্ত জিনিসপত্র বাড়ির বাইরে রাখা৷ শত চেষ্টা করেও ছেলেটি বাড়িতে ঢুকতে পারে না। অবশেষে ছেলেটি তার জিনিসপত্র নিয়ে ওর বাবার কাছে উঠে এবং একটু একটু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। অনেকদিন পর ছেলেটির নাম্বারে একটি কল আসে। ছেলেটির মা জানতে চায়, সে কেমন আছে। ছেলেটি উওর দেয়, আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন, আপনার ছেলেকে হয়তো গ্যাস স্টেশনের আশেপাশে পাবেন, যেখানে তাকে রেখে এসেছিলেন।
জার্মানিতে ওল্ড হোম জনপ্রিয় কনসেপ্ট হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে নয়। ভালোবাসার জন্য প্রাণ দেওয়া নরনারীর সংখ্যা ভারতে সর্বোচ্চ৷ অথচ ওয়েস্টে শক্তিশালী পরিবারগুলোও আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে, ঠিক যেমনি বাংলাদেশে আর একান্নবর্তী পরিবার নেই বললেই চলে। যদিও পুৃঁজিবাদের বর্তমান পৃথিবীকে আমরা নাম দিয়েছি গ্লোবাল ভিলেজ। সহস্র মাইল দূরের ক্লায়েন্টের সাথে নিমিষেই যোগাযোগ হলেও পাশের বাড়ির বৃদ্ধ মারা গিয়ে পচে গন্ধ বেরুবার আগ পর্যন্ত তার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায় না।
এর বিপরীতটা যে নেই, তা নয়। দূর্ঘটনায় হাত ভেঙে যাওয়ার দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। তখন সপ্তাখানেক ফাইফা নামের এক বয়স্ক লোক আমার পাশের সিটে থাকতেন, যিনি ঠিকঠাক কথাও বলতে পারতেন না। উনার স্ত্রী ফ্রাও ফাইফা প্রতিদিন সকালে উনাকে দেখতে আসতেন এবং দিনশেষে বাসায় ফিরতেন। হাসপাতালের রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করা নেপালী একটি মেয়ে ওদের নিয়ে বলেছিল, দেখো জার্মানিতে কিন্তু এই ব্যাপারটা অপ্রতুল। তুমি খুব কম এরকম বয়স্ক কাপল দেখবে।
আমাদের অফিস আর কারখানার ক্লান্তিগুলো দূর করতে আমরা গ্রামে কিংবা পাহাড়ের গহীনে চলে যাই। অথচ নিরবে উল্টেপাল্টে দেই পাহাড়ের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো, গ্রামের মানুষের মনেও ঢুকে যায় আরো চাই মনোভাব। জার্মানিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, টাইম ইজ মানি। শীতকালীন আবহাওয়ার ব্যপ্তির কারনে জার্মানিতে মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও ফোকাসড। তাই কোন পাবলিক পরিবহনে জার্মানরা নিজেদের সাথেও তেমন কথা বলেন না৷ আমরা নিজেরা কিংবা অন্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে বিভিন্ন আলোচনায় যুক্ত হলে হলে অনেক জার্মান একপ্রকার বিরক্ত হন। ওয়েস্টের সাথে বাঙালি জীবনের পার্থক্য আছে, কিন্তু তা ধীরে ধীরে কমে আসছে, যেমনি কমে আসছে শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সপ্তাহান্তে উষ্ণ মদের গন্ধ, বড় শহরে ক্যাসিনোগুলোতে ভীষণ ভীড়। যেমনটা জীবনানন্দ লেখেছেন, ''এখনি টেনিসে যেতে হবে, ফিরে এসে রাতে ক্লাবে; কখন সময় হবে।''
নুইয়র্ক কিংবা ঢাকা, কোথাও ঠিক ভাববার অবসর নেই।
আলবেয়ার ক্যামু তার নোটবুকে লেখেছিলেন, "সবকিছু জেনে গেলে মানুষ আত্নহত্যা করবে।" আসলেই কী তাই? ভাবুন তো।
ইস্ট কিংবা ওয়েস্ট, দিনশেষে মুখোমুখি মুখোশ উন্মোচন করে তবু নিজেরেই দেখি।
১৯ শে এপ্রিল, ২০২৩
জিগেন, জার্মানি
অন্যান্য পর্বসমূহ:
চৌদ্দ: ডয়েচল্যান্ডের কড়চা: আমাদের ক্ষমা চাইবার ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাঁচফোড়ন।
বিশ: ডয়েচল্যান্ডের কড়চা: কলা যুদ্ধ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:৩৩