somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফোন হারিয়ে - ২

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

না, ফোনটা সে তার মেয়ের হাতে তুলে দেয়নি, তুলে দিয়েছে তার ছেলের হাতে।
হেটে হেটে কাজে যাচ্ছিলাম, হাড় কাপানো ইউরোপের শীত। পকেট থেকে হাত বের করা যাচ্ছেনা। একটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গিয়েছিল ৭ বছর আগে, কেটেকুটে জোড়া লাগিয়েছিল বিশেষজ্ঞ। বলেছিল 'এই কাজে আমার পারদর্শিতা পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে, ৬ মাসের মধ্যে চাইলে বক্সিং শুরু করতে পারো'। সত্যিই আঙ্গুল সেরে গেছে পুরোপুরি, ভারী সব কাজ করতে পারলেও আজও একটু ঠান্ডা লাগলে টন টন করে। চড়ুই পাখি অট্টালিকায় ঘড় বেধে সুখী হলেও, উট কি আর কোনো মেরুতে শান্তি পাবে? ভাবছি বাংলাদেশে চলে যাব, বৃধ্হাশ্রম বানিয়ে নিজেই তাতে নাম লিখিয়ে কাটিয়ে দেবো জীবনের শেষ সময়গুলো। সবুজ শ্যামল সোনার বাংলা, কিছু মানুষ ছাড়া সব খাটি এখানে। এখানে রমনী গুলো নদীর মত, নদীও নারীর মত কথা কয়। পদ্মার মত দুই নারী এখানে শুধু ভাঙ্গনের কথাই বলে। ৩৩ বছর কাটল, না না ৪৩ বছর কাটল, কেও কথা রাখেনি। না কোনো বিপ্লবী, না কোনো সেনা, না কোনো চরিত্রহীন স্বৈরাচার। পুরো জাতি এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই। অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো, অচেনা ভাষা।
'তোমার নাম রাজীব'?
'হ্যা, কিন্তু আমি খুব বেশি ফ্রেন্চ বলতে পারিনা, তুমি কি ইংরেজি বলো'?
'আমি খুব ভালো পারিনা, তবে আমার স্ত্রী ভালো ইংরেজি বলতে পারে। ও'কে ডেকে দিচ্ছি।'
কিছুক্ষণ নিরবতা, নিরবতার ওপাশে খানিকটা দুরে খুট খাট শব্দ, পুরুষ কন্ঠ - নারী কন্ঠ, কথোপকথন, সব দুর্বোধ্য।
'জনাব রাজীব বলছো'?
'হ্যা, বলছি। তুমি'?
'মনে হচ্ছে মন খারাপ? কিছু হারিয়েছে নাকি'?
'হারিয়েছি তো অনেককিছু জীবনে, কোনটা জানতে চাও'?
জোরে জোরে হাসলো, তারপর বলল, 'বৈদুতিক যন্ত্রপাতি কিছু'?
আমি আমার হারানো ফোনের মডেল সহ বিস্তারিত দিতে শুরু করলাম। ভদ্রমহিলা বললেন 'থামো, থামো, আমি অত কিছু জানিনা। তোমার ফোনটা আমার স্বামী কুড়িয়ে পেয়েছে রাস্তায়। আমার ঠিকানা দিচ্ছি, নিয়ে যাও। আমাদের উদ্ধার কর, আর প্রতিজ্ঞা কর কোনদিন ফোন হারাবে না। ওত বুড়ো ধামরা মানুষ ফোন হারিয়ে ফেল কি করে বলোতো? আর আমার যত যন্ত্রণা'।
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মহিলার কথা। কি বলছে এসব? মা’ না হলেও আমার কোনো খালা-ফুপু হবে নিশ্চিত। আমার দাদা বা নানা কে কবে যৌবন কালে ইউরোপ এসেছিল?
অচেনা সেই ফোন থেকে বার্তা এলো 'এটা আমাদের ঠিকানা, রাত ন'টায় আমরা ঘুমাতে যাই'।
লাল ওয়াইনের বোতল আর লাল কয়েকটা গোলাপ দেখে ভদ্রমহিলা লাল হয়ে গেলেন, 'ওহ, বেখেয়ালী চিত্রগ্রাহক সাহেব দেখি বেশ ভদ্রলোকও বটে'।
'আমি চিত্রগ্রাহক তা তুমি কি করে জানো?'
'ভেতরে এসো, বলছি'।
কামরা উষ্ণ রাখার চুল্লির পাশে বসেছি, হাত সেকে নিচ্ছি। ছোট গেলাসে পানীয় ধরিয়ে দিলেন তার স্বামী। ছোট্ট দু-এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম 'তোমরা আমাকে চেনো কি করে? নাম জানলে কোথায়? ফোটোগ্রাফি করি আমি তাই বা জানতে কি করে'?
ভদ্রলোক শুরু করলেন, 'কাল সকালে তুমি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলে, তোমার খালি করা পার্কিং 'এর জায়গাতে আমি গাড়ি ঢুকাতে গিয়ে মনে হলো কিছু একটা পড়ে আছে ওখানে। উঠিয়ে দেখি এই ফোনটা। ততক্ষণে তুমি সকালের যানজটে হারিয়ে গেছো। তোমার ফোনের ঢাকনার ভেতরে গোজা একটা পার্কিং জরিমানার টিকেট পেলাম। তাতে লেখা আছে গাড়ির নম্বরটি। পুলিশকে ফোন করলাম তারা বলল ওই গাড়ির মালিকের নাম তারা এভাবে দেবার অধিকার রাখে না। আর আমদের হাতে অত সময় নেই যে ফোনের মালিককে খুঁজে বার করব। তোমার সময় থাকলে তুমি খোঁজো না কেন?'
বললাম 'ভালই করেছে, ওই গাড়ি আমার না।' সত্যি, কাজের মালিকের গাড়ি, রেজিস্ট্রেশন করা তার মেয়ের নামে। আমি শুধু একদিন নিজের মেয়েকে নিয়ে এক কিলোমিটার পথ চালিয়েছি।
ভদ্রলোক চালিয়ে গেলেন, 'সে যাই হোক, স্ক্রিন লক করা থাকলেও তোমার ফোন চালু ছিল, ডিসপ্লে'তে তোমার নাম দেখতে পেলাম আর ঠিকানা আর কালো ওই কভারে কালো কলম দিয়ে তোমার নামের একটা সই। জগত জোড়া জালে (www=world wide web) তোমার নামের অনুসন্ধান করলাম। তোমার নাম ঠিকানা মিলিয়ে নিলাম। তোমার পরিচয় জানতে পারলাম। তোমার এবং তোমার তোলা ছবি দেখলাম। জানতে পারলাম তুমি চল্লিশোর্ধ এক বাংলাদেশী চিত্রগ্রাহক। ২০১০ সালে তোমার এক প্রদর্শনীর আয়োজকের ফোন নম্বর যোগার করে তাকে ফোন দিলাম। সে আরো ৫ জনের নম্বর দিয়ে বলল, এদের কারো সাথে রাজিবের যোগাযোগ থাকতে পারে। তাদের একজন তোমার নম্বর দিল আজ বিকালে।'
'সত্যি, তোমার সাধুবাদের প্রশংসা করি। শুধু ধন্যবাদ তোমার জন্য অনেক ছোট একটি শব্দ।'
'আরে, না না', আমাকে থামিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা 'আমরা ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন, ওগুলো সব করেছে আমার ছেলে'। আমার খালা ফুপুদের মতই বিকট চিত্কার করে উঠলেন 'এই জেসন, কোথায় গেলে। রাজীব এসেছে ফোন নিতে।'
ঘুম চোখে জেসন নেমে এলো, আমার বড় মেয়েটির বয়েসী হবে, ১৪, ১৫ কি ১৬। ফর্সা অনেক, হবেই তো। রেশমের মত চুল। কৈশোরের হরমোন এখনো খোলেনি চেহারায়, এখনো নিষ্পাপ বুধ্হিদিপ্ত চেহারা। মিটি মিটি হাসছে। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি অনেক দুষ্টু সে। আমার আদিয়ান'ও কি এমন হবে দেখতে?
বললাম 'দুঃখিত জেসন, ঘুমাচ্ছিলে বোধয়। আমার জন্য অনেক যন্ত্রণা পোহাতে হলো তোমার।'
'না না, তেমন কিছু না। একটু শরীর খারাপ, দু-দিন ইস্কুলে যাইনি। বাবাকে কি আর ফাকি দেয়া যায়। হাজার হোক বাবা তো আমার, নিজেও নিশ্চই ওগুলো করেছে দাদার সাথে। বসে থাকতে দেখলেই কাজ দেয় আমাকে। কাল বিকেলে এই ফোনটা দিয়ে বলল এর মালিক খুঁজে বের করতে পারলে শনিবার বিকালে ম্যাক'ডোনাল্ড।‘
কি বলব আমি। ফোন চুরি যায়নি আমার, বিশ্বাস চুরি গেছে। বললাম 'আমিও ভাবছিলাম তোমার বাবা কি তোমার হাতে ফোন টা তুলে দিবে শেষ মেষ'?
জেসন কিছু বুঝলো না, বলল, 'মানে কি? তুমি কি বাবার বন্ধু? আমার সাথে দুজন মিলে তামাশা করেছ?'
'না জেসন, তোমার বাবা তোমাকে বড় হতে শেখাচ্ছেন। একদিন তুমি অনেক বড় হবে।'
'বাবাকে শুধু বলো আমি ম্যাক'ডোনাল্ড একদম পছন্দ করি না। transformer দেখতে চাই সিনেমা হলে।'
চার চারটা smart ফেরত দিয়েছি তাদের মালিককে। ঈশ্বর আমার একটা ফেরত তো দেবেনই। আগেও বলেছিলাম, আবার বলছি 'মাঝে মাঝে এক টুকরো ঈশ্বর আসেন এই পৃথিবীতে, দেখা দেন মানবকে, জ্বলে পুড়ে সুরমা হয়ে যায় পেছনের বিশাল পাহাড়টি। শুধু মানবকে থাকতে হয় পবিত্র'। কারণ, আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ শুধু সত্য আর সুন্দর।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:২৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×