১৯৮৪ সালের শীতের শুরু। আমার চুরি বিদ্যার প্রথম প্রয়োগ করেছিলাম নিজের ঘরেই। আব্বা ঘুমাচ্ছিল, আব্বার মোটর সাইকেলের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। চাবি চুরি করে বেরিয়ে গেলাম। এ'গলি ও'গলি ঘুরে অবশেষে একবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভেঙ্গে গেল একটি বাতি। কোনো রকম বাসা পর্যন্ত ফিরে এলাম, যেমন ছিল তেমন আবার রেখে দিলাম জায়গার জিনিস জায়গায়। আব্বার বুঝতে সময় লাগলো না যে ওই কু'কাজটি আমার করা। একমাত্র ছেলে হওয়া সত্তেও আমার প্রতি আব্বার পরমতসহিষ্ণুতা ছিল 'শূন্য'। বলতেন 'একটাই যদি নষ্ট হয়ে যায়, আমার তো সব যাবে।' চুল ধরে উপরে ঘরে নিয়ে এলেন, '১২ বছরে যদি তোমার এই অধপতন হয় ২২ বছরে গিয়ে তুমি কি হবে? আজ তোমার মোটর সাইকেলের ভুত আমি ছাড়িয়ে ছাড়ব, এই কেও একটা বেত দে আমাকে। বদমাইশ ছেলে', ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরে ঢুকতেই দেখি আমার নানু আমার সামনে, আমাকে জড়িয়ে ধরে আব্বাকে বললেন 'কি হয়েছে'?
আব্বার উত্তর শুনে প্রতিউত্তরে শুধু বললেন 'আপনার মালের না হয় সামান্য ক্ষতি হয়েছে, আমার জানের কিছু হয়নি, আল্লাহ'র কাছে শুকরিয়া'। সে যাত্রা আব্বা আর কিছুই বললেন না। আব্বার হাতে জানের ঝুকি না থাকলেও অন্তত ১০ টা বেতের দাগ থেকে সেযাত্রা রেহাই পেলাম।
আজও আমার কোনো আর্থিক ক্ষতি সাধিত হলে ভাবি, হয়ত আরেকবার জান বাঁচলো আমার, আমার পরিবারের কারো। বেচে থাকলো না শুধু নানু। ৮৪'র সেই শীত শেষ হওয়ার আগেই নানু চলে গেলেন চিরবিদায় নিয়ে। ধন্যবাদ তোমাকে নানু, আর তোমার আল্লাহ ।
কিছুদিন আগে একটা ব্যবহৃত গাড়ি কিনেছিলাম। গাড়িটা আমার অনেক প্রিয় থাকলেও যান্ত্রিক এক ত্রুটির কারণে ৯ মাসে ৯০% কমদামে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, এক ফোটা আফসোস হয়নি কোনদিন। ‘জান আর মালের সূত্র’ মনকে বুঝিয়ে এগিয়ে চলেছি। বোঝাতে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছি যে, মাল থেকে জান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের অনেক বিলাস হাতছানি দিয়ে ডাকলেও অপেখ্হা করেছি নিজের সামর্থের হাত ধরে চলতে। ওক' কাঠের প্রাসাদ বা ২৮'তলা বিলাসবহুল কোটি টাকার বাড়ি না হলেও, ছোট্ট এপার্টমেন্টে কোটি কোটি সুখ ছড়ানো ছিল চারিদিকে।
আমার বড় মেয়ে সারা, ১৫ ছুই ছুই করছে। কিশোরী বয়সের বিলাসিতার জীবন ধারণ হাতছানি দেয় তাকে, বুঝতে পারি। কিছুদিন হলো নানা ভঙ্গিতে পরোক্ষভাবে ভাবে বলতে চেষ্টা করছে ‘একটা iPhone – 6 চাই আমার', আমি বুঝতে পারি তার মনের কথা। তার বেখেয়ালী চলাফেরা; ১৫ দিনের মধ্যে ওই যন্ত্রের দাম নামিয়ে আনতে পারে শুন্যতে, আফসোস লাগবে আমার। জান-মালের ওই তত্ত্ব দিয়ে মনকে বোঝানোর মত ধনী আমি নই। কালো বাজারে ওই ফোন পাওয়া যাবে ২৫% দামে, মেয়ের হাতে চুরির ওই ফোন তুলে দিয়ে নিজেকে জীবনের কোনো তত্ত্ব দিয়ে বুঝানোর মত বড় তত্ত্ববিদ'ও আমি এখনো হতে পারিনি। সারা'কে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, করুক। ইতিমধ্যে বিগত কিছুদিনে আমার হাতে পড়েছে ঐরকম ৩/৪ টা ফোন। কেও আমার সামনে রেখে চলে গেল, বা কেও ছিল মাতাল। আরেকটা পেয়েছিলাম পার্কের বেন্চে, বেজেই চলেছে, ফোন উঠাতেই বলল 'ফোন টা কি ফেরত দেবে, নাকি আমি আশা ছেড়ে দিব'?
বললাম 'তোমার ফোনের চার্জ ১২% বাকি আছে, তার আগেই চলে এসো এই ঠিকানায়। তোমার জন্য সারারাত এই পার্কে বসে থাকতে পারব না। আর শোনো, পুলিশ নিয়ে এসো সাথে, অতো দামী ফোনের লোভ যদি শেষ অব্দি সামলাতে না পারি'!
পরীর মত সুন্দরী ভদ্রমহিলা এলেন রাজকীয় একটা গাড়িতে, সামনে পরীর এক ছোট্ট মূর্তি। গাড়ি চালক দরজা খুলে দিলেন, স্বামী-স্ত্রী নামলেন, হাতে ফুলের তোড়া। আমার নাম নিশ্চিত করে ফুলের ছোট্ট তোড়া টি ধরিয়ে দিয়ে বললেন 'নিশ্চিত যে ফোন টি ফেরত দিতে চাও'?
তার ফোন তার হাতে দিয়ে বললাম 'ওটি ফোন ছিল নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম টেলিভিশন! চাইলে তোমার গাড়িটি দিয়ে যেতে পারো'।
ভদ্রলোক বললেন 'বিশ্বাস করো, অনেক বেশি তেল খায় ওই দানবটি, অযথা পয়সা খরচ হবে তোমার।' আরো খানিকক্ষণ হাসি তামাশা করে চলে গেল দম্পতি।
জাহাজের ব্যবসা তাদের। একবার ঘুরে দেখিয়েছে একটা জাহাজ আর খানিকটা সমুদ্র। বিনিময়ে উপহার দিয়েছি একটা গামছা আর একটা লুঙ্গি। লুঙ্গি পরে ভদ্রলোক বললেন 'সেলাই বিহীন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই স্কার্ট'টি পরিধান করা অনেক ঝুকিপূর্ণ, এতে ফিতা সংযুক্ত থাকলে ভালো হত'। মোহিত হয়েছি তাদের রসবোধ, ভদ্রতা আর শালীনতায়। আজও কালে ভদ্রে ফোন করেন তারা, শুধান 'কেমন চলছে তোমার জীবন, সততার বেড়াজালের ভিতর?'
আমি কোনো সততা করিনি সেদিন। ওই ফোন যন্ত্রটি আমার ছিল না কোনদিন। বেজে উঠেছিল আমার কানের পাশে, আমার কর্তব্য ছিল নিজের কর্তব্য পালন করার। নিজেকে নিজের শুধ্তার উজ্জলতা উপভোগ করতে দিয়েছি মাত্র। প্রয়োজনের চেয়ে লোভ বেশি হলেই শুরু হয় পাপ।
আজ সকালে আমি আমার ফোনটি একটু বেখেয়ালে হারিয়ে ফেললাম। অন্য ফোন থেকে ফোন করে দেখলাম ইতিমধ্যে ফোনটি বন্ধ করে দিয়েছে কেও। কি করবে সে ওই ফোন দিয়ে? তার মেয়ের হাতে তুলে দিবে? নাকি তার মেয়ের সাথে কথা বলবে, খোজ নেবে মেয়ের? নাকি বন্ধই ছিল আমার ফোন?
কাল যাব পুলিশের অফিসে, জিজ্ঞাসা করবো কেও কি এমন একটা ফোন দিয়ে গেছে তোমাদের কাছে? দেখি কি হয়, নাকি আমার জান আবার বাচলো মালের উপর দিয়ে।
continued ... ফোন হারিয়ে - ২
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৩৫