।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে বন্ধুদের সাথে কক্স'বাজার ভ্রমণটা কারণবশত হাতছাড়া হয়ে গেলো। সবাইকে বিদায় দিলাম ট্রেনের জানালায়। তারপর বেশ কিছুদিন পর চললাম চট্টগ্রাম, আমি আর আমার নিঃসঙ্গতা। অনেক ছোট বেলা থেকেই নিঃসঙ্গতা খুব উপভোগ করতাম। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় অনেক প্রহর কেটেছে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতার সাথে মৌনতারর লেনদেন আজও তাই অনেক উপভোগ্য। সাতদিন ইচ্ছে মতো ঘুরলাম চট্টগ্রাম শহর। ছোট ছোট পাহাড়, পাহাড়ের ফাক ফোকর দিয়ে ছোট বড় রাস্তা, বাটালি হিল, ফয়েস লেক, বায়োজিদ বোস্তামীর মাজার, নিউ মার্কেট, আদালত পাড়া আর যেদিন ফিরে যাবো সেদিন পতেঙ্গা সৈকত। এর আগে কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি, সমুদ্র আমাকে কখনো টানেও না। শহুরে সৈকতে কি আর এমন আবেদন? তবুও প্রথম দিয়েই শুরু করা। এক সময় সূর্য ডুবতে শুরু করলো। শহুরে সৈকত রূপ নিলো এক বীরভোগ্যার। সূর্যাস্তের আকাশ যেন লোহিত লালাভ ঢাকাই শাড়িতে ঢাকা এক অপরূপা রমণীর উদর। সবুজ ঘাসে যে উদরে মাথা এলিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, মৌন। নবীন আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে বয়ে গেলো কল্পনার এক নারীর জন্য বাসনা। অচেনা সে নারী, কল্পনাতে যারে আমি একটু একটু করে ভালোবাসি প্রতিদিন। তারে আমি চিনিনা, জানি তার হাসি। চোখ যায় না সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্তকেও কি গোধূলি বলে? তাকে ছাড়া সৈকতে প্রথম সূর্যাস্ত দেখা অন্যায় হবে। ফিরে চললাম শহরে বোনের বাসায়, রাত ১০:৩০ মিনিটে বাসের টিকিট করা।ঢাকা ফিরতে হবে।
'কিছুক্ষন পর ফিরে যাবি, এই তোর ফেরার সময় হলো? সাত দিন যাবৎ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পাগলের ছবি তুলে বেড়াচ্ছিস! চিটাগং শহর দেখতে এসেছিস, নাকি বোন'কে দেখতে? বাবুজীর কাছে নালিশ করে প্রত্যেকটা কথা বলবো। গতকাল বললি চুল কাটবি, চুল দেখলে মনে হয় কাকের বাসা। এই এক জিনসের প্যান্ট কতদিন ধরে পরে থাকবি?' এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে, গতানুগতিক বাংলাদেশী বড় বোন আরও যা যা বলে সব বললো নাজনীন আপা। সময়কাল; প্রায় আধা ঘন্টা। গোসল করছি বাথরুম থেকে শুনতে পাচ্ছি বলেই চলেছে। কাপড় পড়ছি, সে বলছেই। খাবার টেবিলে, সে বলছেই। অবশেষে দুলাভাই তাকে থামিয়ে বললো 'শোন, তোর সাথে আমার এক কলিগের মেয়ে যাবে ঢাকায়, ওকে নিতে ঢাকায় বাস-স্ট্যান্ডে আসবে ওর মামারা কেও। যদি আসতে দেরিও হয় কিছুক্ষন অপেক্ষা করিস।'
'মেয়ে সুন্দরী হলে জনম জনম অপেক্ষা করতে রাজি আছি দুলাভাই।'
'একটা থাপ্পড় খাবি। আমার এক সিনিয়রের মেয়ে!'
'তাতে আমার কি? মেয়ে আমার জুনিয়র হলেই হলো।'
হাতে ১০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে দিতে দুলাভাই বললো 'বাবুজীর কাছে সব খবর যাবে কিন্তু।'
'ওকে ওকে, আরেক-খানা ওই নোট দাও দেখি।'
বন্দর নগরীর বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছি। দুলা ভাইয়ের সেই সহকর্মী এলেন বাস ছেড়ে যাবার ৫ মিনিট আগে। ভদ্রলোক শুধু তাড়াহুড়োর মধ্যে বললেন 'ওর মামারা কেও আসবে নিতে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করো।'
'জ্বি আচ্ছা।'
বাস ছাড়লো। দুজন পাশাপাশি বসে। কি বলবো? কিছু বলবো কিনা? ১৯৯০ সালের তদানন্তিন সামাজিক জড়তার চেয়েও আমি পিছিয়ে ছিলাম কিছুটা। তবুও সুন্দরী নারীর অদৃশ্য আবেদনের কাছে নিজের অহং'এর জলাঞ্জলি দিতে বাধা নেই। চাঁদের আলোয় সীতাকুন্ডু পাহাড়কে পাশে রেখে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম 'তোমাকে আমি কোথাও দেখেছি আগে?'
'দ্যাখো হাসান, মেয়েদের সাথে লাইন মারার এই পদ্ধতি অনেক পুরানো হয়ে গেছে।'
'তুমি আমার নাম জানলে কি করে'?
'তুমি করে বলছো যে? আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি গত বছর। আর তুমি সবে পরীক্ষা দিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি।'
'তুমি আমার নাম জানলে কি করে'?
'আন্টি ফোনে বলেছে মা'কে। আন্টি মানে তোমার বোন। এখন আমি ঘুমাবো।'
সত্যি চোখ বন্ধ করে ফেললো। জানালার দিকে খানিকটা কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। অপর দিক থেকে আসা যানবাহনের আলোতে মাঝে মাঝে তাকে দেখা যাচ্ছে। আমার কল্পনার সেই নারীর সাথে তাকে মেলাতে পারছি না পারছিনা, তবুও কথা আসছে মনে। ঘুমন্ত নারীর সাথে কি কথা? ঘুমাতে চেষ্টা করি, ক্লান্ত চোখে ঘুম আসেনা। জীবনে প্রথম কোনো নারীর সাথে ঘুমানো; হাস্যকর হলেও ব্যাপারটা তো এমনই। ঘুমটা উপভোগ করা যাক। আধো ঘুম, আধো জাগরণ। ঈগল'স বদলে ইন্দ্রানী সেন; তবুও কাজ হচ্ছে না।
এভাবে কতক্ষন জানিনা, তবে বাস এখন থেমে। সবাই একে একে নামছে, এক ঘন্টা যাত্রা বিরতি। আমিও নেমে হাঁটা ধরলাম সবার সাথে এক বিশাল রেস্টুরেন্টের দিকে। পিছন থেকে বাস কন্ডাক্টর ডাকছে 'ও ভাই, ও ভাই, আপনাদের মধ্যে হাসান ভাই কে?'
আশেপাশে কেও সাড়া দিলোনা সুতরাং আমিই সেই ব্যক্তি।
'আপনারে রিমি আপা ডাকতেসে।'
ফিরে এলাম বাসে। 'তোমার নামটা বাস কন্ডাক্টারের মাধ্যমে জানাতে হলো?'
'আমার কাপড় বদলাতে হবে, অন্ততপক্ষে জামাটা।'
'ওখানে বাথরুম আছে। ওখানে গিয়ে না হয় ... '
'না, জামাটা বদলে নামতে হবে আমাকে। আমি অসুস্থ।'
'বাস তালাবন্ধ করে দেবে ওরা এক ঘন্টার জন্যে। আমার ক্যামেরা ব্যাগে একটা রেইনকোট আছে। ওটা কোমরে প্যেচিয়ে রেস্টুরেন্টে না হয় গিয়ে বসি। পরে লাগেজ বের করার চেষ্টা করছি।'
রেইনকোট কোমরে প্যেচিয়ে রিমি হেটে চলে গেলো রেস্টুরেন্টে, আমি চললাম আশে পাশে একটা ফার্মেসি খুঁজতে। ফার্মেসির পণ্য মনোহারি দোকানে পেয়ে গেলাম। রাত-দুপুরে সেই পণ্যের পুরুষ ক্রেতা দেখেও দোকানির ভাবলেশহীন চেহারায় প্রতিক্রিয়াই বোঝা গেলো না। দোকানির কাছে সব পণ্যই বোধয় শুধু পণ্য। রেস্টুরেন্টে ফেরার পথে কন্ডাক্টারকে বলে রিমির স্যুটকেস নিতে হবে।
বাস চলতে শুরু করেছে। আধো ঘুম, আধো জাগরণে নিঃসঙ্গতা দূর করে আবার আমি আর ইন্দ্রানী 'হে ক্ষনিকের অতিথি, এলে প্রভাতে, কারে চাহিয়া, ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া।' ইন্দ্রানী দেখতে কেমন? তার কন্ঠের মতোই সুন্দরী সে? থাক, জানার কি দরকার? ইন্দ্রানী সুন্দর'ই থাকে আমার মনের প্রথম প্রেম হয়ে। মাঝে মাঝে পাশে তাকিয়ে দেখেছি, রিমি তাকিয়ে থাকে জানালায়। কখনো কখনো চোখে চোখ পরে যায়। পুরো হাসির পাঁচ শতাংশ হাসে রিমি, আমিও চেষ্টা করি তার সমান সমান হাসতে। পনেরো শতাংশের নিচে চাপিয়ে রাখতে পারিনা আমার বিহ্বল হাসি। পুরুষের হাসির আবার কখন কি মানে দাঁড়ায় কে জানে? নারীর চোখে পুরুষ কুকুরের মতো হলে তার হাসি নিশ্চই হায়নার মতোই লাগবে। আমি বহির্প্রকাশ চেপে ধরি দৃঢ়তার বন্ধনে। উনিশ না পেরিয়ে যদিও জানতাম না দৃঢ়তা কি জিনিস, বা পণ্য?
'গান শুনতে চাও?'
'হু, কার গান শোনো তুমি?'
ওয়াকম্যান আর হেডফোন রিমিকে সঁপে দিয়ে আবার ঘুমানো চেষ্টা। রিমি ঘুমাচ্ছে; কখনো আমার দিকে ফিরে আবার কখনো খোলা জানালার দিকে ঘুরে। চোখ বুজে আসে তবুও খোলা রাখতে চেষ্টা করি।তাকিয়ে দেখি, চোখ ফিরিয়ে নিই; এভাবে কতক্ষন জানিনা, তবে বাস এখন আবারো থেমে। সবাই একে একে নামছে, যাত্রার এখানেই সমাপ্তি।
রিমির মামা এখনো আসেনি। 'এই যে তোমার ওয়াকম্যান। ধন্যবাদ, অনেক অসুস্থ বোধ করছিলাম। গান শুনে একটু ভালো অনুভব করেছি। তোমার সাহায্যের জন্যেও ধন্যবাদ। আর দুঃখিত, অসুস্থ্যতার জন্য তোমাকেই বিরক্ত করতে হয়েছে।'
ভাবছিলাম কি বলি? থাক, পরে কোনোদিন। তবুও বললেই ফেললাম 'বার বার অসুস্থতা বলছো কেন রিমি? তুমি সুস্থ্য। তোমাদের শরীর প্রত্যেক মাসে সুস্থ্যতার জানান দেয় বলেই আমরা জীবনের মুখ দেখি। আমিও, অতীতে একদিন, আমাকেও জীবনের মুখ দেখিয়েছে আমার মা।'
সিনেমার ভিলেনের মতো আচমকা রিমির মামা চলে এলো। নাজনীন অপার চেয়েও বেশি বক বক করছে, এক ফাঁকে আমাকে বিদায় দিয়ে আবার বক বক করেই চলেছে। মামা-ভাগিনী গিয়ে গাড়িতে উঠলো। আমি উঠলাম একটা রিক্সায়। কিছুদূর পর আমার রিকশা রোধ করে দাঁড়ালো রিমিদের গাড়ি। রিমি ফিরে এসে বলেছিলো 'আবার দেখা হবে?'
'জানিনা, নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা।'
'ইচ্ছে হলেই তুমি খুঁজে বের করতে পারবে আমাকে।'
নিদ্রাহীন এক রাতের পরও ঢাকার আকাশ সুন্দর লাগে, বয়স প্রায় উনিশ বলেই? নাকি ইন্দ্রানী সেন, না রিমি?
আরো উনিশ বছর পর একদিন উইনচেস্টারে শহরে। গ্রীষ্মের ছুটিতে মাঝরাতে ২৪ ঘন্টা খোলা এক মনোহরী বিপনী দোকানে কাজ করছি। এখানে আমার কাজের আজ শেষদিন, কাল সকালে বৌ-বাচ্চা সমেত গন্তব্য প্যারিসের ডিজনির দেশে। এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন, সাথে এক ভদ্রলোক। পণ্যের দাম পরিশোধ করতে করতে শুধালেন 'আপনি কি বাংলাদেশী?'
দোকানির কাছে সব পণ্যই পণ্য, তাই ভাবলেশহীন উত্তরে বললাম 'জ্বি, আমি বাংলাদেশী।'
'আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে?'
'ছেলেদের সাথে লাইন মারার এই পদ্ধতি অনেক পুরোনো হয়ে গেছে, এমন কি আমার এই ডায়ালগটিও।'
'চুপ করো নির্বোধ, তুমি আর ছেলেটি নও। বুড়ো ভাম, দাড়ি রেখেছো কেন?'
'ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান করেছে বলেই কি বাঙালির সাথেও ইংরেজি কথা বলছো?'
'মাস্টার্স'ও করেছি।'
ভদ্রলোক খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন 'তোমরা একে অপরকে চেনো'?
'ওর সাথে কাটানো এক রাতের একটা গল্প আছে আমার, তোমাকে বলবো পরে। এই তোমার ফোন নম্বরটা দাও দেখি।'
'আমার ফোন আমার সাথে নেই, নম্বরটাও মনে নেই। ইচ্ছে করলে খুঁজে বের করো আমাকে।'
রিমির স্বামী একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, একবার নিজের স্ত্রী'র দিকে।
'ঠিক আছে' বলে রিমি চলে গেলো।
আমার স্ত্রী ফোন করলো আমার মুঠোফোনে 'আমি শুতে যাচ্ছি। তুমি কিন্তু বাসার চাবি ফেলে গেছো। কলিং বেল দিও না, বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। নিচে এলে ফোন দিও, দরজা খুলে দিবো।'
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৫৭