এবিএম মুসার মৃত্যুতে বাংলাদেশের এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক নিউজ রুমে মন খারাপ নেমে এসেছে। মুসা ভাই কয়েকদিন আগে আমাদের ছেড়ে যাওয়া খুশওয়ান্ত সিং ঘরানার ডাকসাইটে সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ঢাকায় মুসা ভাইয়ের আড্ডার ভক্ত অনেকেই। কোন রেফারেন্স মনে না পড়লে, মুসা ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবেন। এই যেমন আব্দুল গাফফার চৌধুরী আরেকজন গুরুগৃহ। কোন প্রশ্নের উত্তর নেই মুসা ভাইয়ের কাছে বা গাফফার ভাইয়ের কাছে; এ হবার নয়। আর আমরা সাংবাদিক হয়েছি, কোন প্রশ্নের উত্তর জানিনা। মান রাখতে জুনিয়রদের বলে দিই, গুগল করো বাপু।
মুসা ভাই তখন যুগান্তরের সম্পাদক, আমি এক যুগান্তরের তরুণ সাংবাদিক হারুন-উর-রশিদের টেলিফোন সাক্ষাতকার নিচ্ছি। হঠাত হারুন বলে, সারছে সামনে মুসা ভাই দাঁড়িয়ে; আমিও অপরপ্রান্তে উতস্যুক। সব ভয় ডরের অবসান ঘটিয়ে উনি হারুনকে বললেন, বিশেষজ্ঞ অভিমত দিচ্ছো, বেশ তো, খুব ভালো কথা।
বুঝলাম এ এক শিক্ষক মানুষ, সরকারের অনেক বড় পদে কাজ করেছেন, সাংবাদিকদের নেতা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় আদৃত, দাপুটে কলামিস্ট, ইতিহাসের এক নির্মোহ বিচারক অবশেষে আপাদমস্তক সাংবাদিক।
উনার অনেক টেলিফোন ইন্টারভিউ করে ও সামনাসামনি কিছু কথা বলে আমার মনে হয়েছে অতো ফর্মালিটির বা বিরাটগিরির ধার ধারেন না ভদ্রলোক। দেখে রাগী মনে হয়, কথা বললে খুব সহজ। সেমিনারের বিষয় ভালো হলে টুক করে চলে আসে্ন। কখনো প্রেস ক্লাবের সবুজ উঠোন টার রঙ্গিন ছাতার নীচে বসে মুসা ভাই মুচকি হাসলে কিছুক্ষণের মাঝে খুশীজল ছুটিয়ে দেয় কে যেন; চলতে থাকে ম্যারাথন আড্ডা।
মুসা ভাইয়ের ঐ খুশওয়ান্ত সিং এর মতো ঠোঁট কাটা কথা বার্তা; সঙ্গে রস। এসব চিন্তা রসিকেরা লোকালয় ছেড়ে চলে গেলে থাকে শুধু অষ্টম শ্রেণী থেকে টেনেটুনে বিএ পাস।
মুসা ভাই অল পাকিস্তান সাংবাদিক সংগঠনের প্রধান ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের এই মুসা ভাইয়ের অধীনেই আন্দোলন করতে হয়েছে নানা দাবীতে। বুড়ো বয়সে সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের বিচার চাইতে শোক মিছিলে গিয়ে উনি বললেন, এই মৃত্যু শোকের; এর বিচারের দাবীটি ন্যায় বিচারের ও সাংবাদিক ঐক্যের শেষ সুযোগ।
খুব মনে রাখার মতো কথা। সাংবাদিক ঐক্য ও ন্যায় বিচার।
খুশওয়ান্ত সিং যেমন ইন্দিরা গান্ধী পরিবারের কাছের মানুষ ছিলেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারে তেমন ছিলেন মুসা ভাই। বঙ্গবন্ধু গ্যালিভার চিন্তার মানুষ উনি সাংবাদিকদের গ্যালিভার মুসাকে চিনতেন। পাকিস্তানের আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানও মুসা ভাইয়ের সাংবাদিক আন্দোলনকে ভয় পেতেন। তাই ডেকে হাই টি খাওয়াতে চেষ্টা করতেন। বেরিয়ে এসে মুসা যে মুসা সে মুসাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক ও মেধার সমানুভূতি ছিল মুসা ভাইয়ের।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর সেনা শাসক জিয়া মুসা ভাইকে ডেকে তেল দিয়েছেন। মুসা ভাই মুখের উপরে বলে দিয়েছেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত সেটা মাথায় রেখে তারপর আমাকে কিছু বলুন মি প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক মুসা ভাইয়ের ছাত্র; আর আমরা তাদের ছাত্র। সুতরাং আমরা জানি এইসব নক্ষত্রের টুপ করে ঝরে পড়া মানে, অনেকগুলো প্রজ্ঞা আর সুরুচির বাতি নিভে যাওয়া।
মুসা ভাই একটি টিভি লাইসেন্স চেয়েছিলেন। যে দেশে দর্জি থেকে শেয়ার বাজার চোর টিভি লাইসেন্স পায়, সেইখানে প্রবাদপ্রতিম মুসা লাইসেন্স পাননা। কারণ লিলিপুট সমাজের চিন্তা, উনার তো ট্যাকা নাই।
কিন্তু এবিএম মুসা একটি টিভি লাইসেন্স পেলে অনেক সৎ ব্যবসায়ী ছুটে আসবে উনাকে পুঁজি দিয়ে এগিয়ে দিতে, এরকম কানেকশন উনার আছে; এটা লিলিপুট আবুল-টাবুলদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
এখন যেইখানে পাঁচিল টপকানো চোরের বেটা লাইসেন্স হাতে কালাশনিকভ মিডিয়া হয়ে ঘুরছে ছাগল নাইয়াতে; সেখানে সাংবাদিকতার কিংবদন্তী মুসা লাইসেন্স না পেলে ক্ষিপ্ত হবেনই।
তখন লিলিপুটদের বিরাট জোটটি চিঁ চিঁ করে উঠে, মুসা পাগল। কথা ঠিক, অষ্টম শ্রেণী থেকে টেনে টুনে বিএ পাশের উপরের ডিগ্রীধারী যেসব মানুষ ছাগলনাইয়াতে বসবাস করবে তারা সবাই পাগল। একমাত্র সুস্থ হচ্ছে প্রাডো হাঁকানো লিলিচুলকানিপুট বা রঙ্গভবনের লিলিকচলানিপুটেরা।
লিলিপুটদের এসব চেষ্টা দেখে মানুষ মুখ টিপে হেসেছে। ভন্ড পীর মজিদ আর তার চার্লিরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে কী বুঝবে? এবিএম মুসা এই সব লিলিপুটদের কাদা ছোড়াছুঁড়িতে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। নইলে তার ইনিংসটা আরো লম্বা হতো। ছাগলনাইয়াতে মানুষ হয়ে জন্মানোর অপরাধে হুমায়ূন আজাদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী এদের সবার মৃত্যু ঘটেছে লিলিমুশতাকপুট অধুনা লিলিবদিবাপ্পাপুটদের আঘাত ও অপমানে।
মুসা ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে। এতো গুলো নিউজরুমে এতো ছাত্র মুসা ভাইয়ের আর আমরা লিলিপুট গুলোকে কিছু না বলেই ছেড়ে দেব!
সাগর-রুনি হত্যার বিচার নিশ্চিত করা আর এজন্য প্রয়োজনীয় সাংবাদিকদের শেষ ঐক্যই হচ্ছে মুসা ভাইয়ের অপমান ও অশ্লীল চুলকানি-সমাজের উতপাতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ।
এবিএম মুসারা সাংবাদিক রুচির শেষ চিহ্ন প্রজন্ম
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?
অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।

১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন
১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন
=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?
যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!
যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।