ঘরময় অন্ধকার। অন্ধকার দু’রকমের- একটা হলো ঘুটঘুটে অন্ধকার অন্যটা আবছা অন্ধকার। তবে আমি যে অন্ধকার দেখছি সেটা ঘুটঘুটে অন্ধকারও না আবার আবছা অন্ধকারও না। অন্ধকারের সাথে ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে। এই অন্ধকারের নাম মনে হয় ভোঁ ভোঁ অন্ধকার। আগে জানতাম অন্ধকার দু’রকমের কিন্তু এখন বুঝতে পারছি দুই না, তিন রকমের। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আবছা অন্ধকার এবং ভোঁ ভোঁ অন্ধকার।
ইদানীং রংপুরে খুব লোডশেডিং হচ্ছে। যখন তখন লোডশেডিং। একটু ফুরসত পেলেই কারেন্টের লোকেরা লোডশেডিং দিচ্ছে। লোডশেডিং এর লোড আমাদের দেশের মানুষ সামলে নিয়েছে। অর্থাৎ, লোডশেডিং ব্যাপারটায় দেশের জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এটা এখন আমাদের কাছে ডাল-ভাতের মতোই স্বাভাবিক। লোডশেডিং হলে আমরা আর চমকে উঠি না। বরং লোডশেডিং না হলেই কৌতুহলী হয়ে এদিক ওদিক তাকাই, অনন্ত বিস্ময় নিয়ে ভাবি- আরে! অলো জ্বলতাছে ক্যান?
আমার অন্ধকার দেখার পেছনের রহস্য লোডশেডিং না। অন্ধকার দেখার পেছনে একটা বিশাল ইতিহাস আছে। সেই বিশাল ইতিহাস কেটেকুটে সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।
ভোঁ ভোঁ অন্ধকার দেখার
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ঘন্টি বেজে গেছে। সবাই টিফিন হাতে স্কুলের এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। আমাদের স্কুলের চিরাচরিত নিয়ম- প্রতিদিনের মতোই টিফিন আজও একটা সিঙ্গারা। সিঙ্গারার সাইজ আগে বড় ছিল কিন্তু খেয়াল করছি দিনের সাথে তাল মিলিয়ে সিঙ্গারার সাইজ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। Micro World এর মতো Microসিঙ্গারা। এই সিঙ্গারা না চিবিয়ে ট্যাবলেটের মতো কোৎ করে গিলে ফেলা যায়। আমি সিঙ্গারা কোৎ করে গিলে ফেললাম। Micro সিঙ্গারা জন্য কোৎ করে গিলি নি, কোৎ করে গেলার অন্য একটা কারণ আছে। কারণটা হল- আমি অংকে বরাবরের মতো এবারো ‘ডাক’ মেরেছি! অংকে ডাক মারার কারণে আমার বন্ধু বান্ধবেরা আমাকে নিয়ে সারাণ টিটকারি মারে। তারা আমার একটা নাম দিয়েছে। নামটা হলো - বুড়ার ব্যাটা হাব্লুস। হাব্লুস মানে জানি না। ডিকশনারি খুঁজে দেখেছি। হাব্লুস কোথাও নেই।
আবারো ঘন্টি বাজলো। টিফিন পিরিয়ড শেষ। ভয়ে ভয়ে কাসে ঢুকলাম। একটু পরেই মোস্তফা কামাল স্যারের কাস। তিনি আমাদের অংক শিক। মোস্তফা কামাল স্যারেরও একটা নাম দেয়া হয়েছে। তাকে সবাই আড়ালে মোকা স্যার নামে ডাকে। কখনো কখনো মোকা থেকে স্যার খসে পড়ে। তখন ডাকা হয় শুধু মোকা। মোস্তফা কামালের মাইক্রো নেম- মোকা।
মোকা স্যার কাসে ঢুকলেন। কাসে ঢুকেই হুংকার দিলেন। অংক না বুঝলেও তার হুংকারের কারণ বুঝতে পারলাম এবং যথারীতি দাঁড়িয়ে মোকা স্যারের দিকে বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকালাম।
অংকে কত পেয়েছেন ?
আমি কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললাম, জানি না স্যার।
শূন্য। কয়টা শূন্য জানেন?
জি না স্যার।
তিনটা শূন্য।
স্যারের কথা শুনে বুঝলাম আমার উন্নতি হয়েছে। গতবার পেয়েছিলাম ডাবল শূন্য, এবার এক ধাপ এগিয়ে ট্রিপল শূন্য। ভাবতেই ভালো লাগছে।
কান টানলে মাথা আসে- স্যার এই নীতি অবলম্বন করে আমার কান টেনে মাথা সামনে এগিয়ে নিয়ে আসলেন এবং বুলডোজার সাইজের দুই হাত দিয়ে তালি বাজানোর মতো করে ইয়া ধামড়া একটা চড় কষালেন। ভটাস করে শব্দ হলো এবং আমি ভোঁ ভোঁ অন্ধকার দেখা শুরু করলাম।
অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করল। ভোঁ ভোঁ শব্দও কমে আসছে। একসময় অন্ধকার এবং ভোঁ ভোঁ শব্দ দুটোই কেটে গেল। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পারলে হয়তো জিহ্বা কেলিয়ে হাসত কিন্তু জিহ্বা কেলানোর রেওয়াজ নেই বলেই তা করতে পারছে না।
কান ধর।
কার কান ধরবো এটা বুঝতে পারছি না। মাথা ঝিমঝিম করছে। স্যার আবারো হুংকার দিলেন। এবারে বুঝতে পারলাম। স্যারের হুংকার্নিদেশ (হুংকার+নির্দেশ) সুবোধ বালকের মতো পালন করতে হলো। আমি নিজের কান ধরলাম।
ফারিয়া।
আমাদের কাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে ফারিয়া উঠে দাঁড়াল। স্যার তাকে মধুর ভঙ্গিতে ডাকছেন। মধু মিশ্রিত ডাক। এই মধু দেখা কিংবা চাখা না গেলেও সেখান থেকে মধু চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। ফারিয়াকে কেন ডাকা হলো এটা বুঝতে পারছি না।
অংকে কতো পেয়েছিস, মা?
৯৯ স্যার।
গুড। ভেরি গুড। এখন একটা কাজ কর। এই হাদাটার কান মলে দে।
ফারিয়া স্যারের কথা শুনে উসখুস করছে। ভাবটা এ রকম- এই কাজ আমি করতে পারব না ( যদিও হাদাটার কান ধরতে খুব ইচ্ছে করছে )। স্যার ফারিয়ার উসখুস ভাব বুঝতে পারলেন। তিনি তার নির্দেশ চেঞ্জ করে বললেন, আচ্ছা যা কান মলে দিতে হবে না। হাদাটা কান ধরে ৩০০ বার উঠবোস করবে। তুই দায়িত্ব নিয়ে গুনবি।
ফারিয়া মুচকি মুচকি হাসছে। মনে হয় অফারটা তার পছন্দ হয়েছে। আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে আসলাম এবং কান ধরে ম্যারাথন কান ধরে উঠবোস স্টার্ট করলাম। ফারিয়া গর্বিত ভঙ্গিতে এবং দায়িত্বের সাথে আমার কান ধরে উঠবোস গণনা করছে। আমার উঠবোসের সাথে সাথে তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল সমান তালে উঠছে আর নামছে। আমি ভ্যাবদা মেরে সেই আঙুলের দিকে তাকিয়ে কান ধরে উঠবোস করছি।
স্কুল ছুটির পর বাইরে বের হলাম। বিষণœ চৈত্রের দুপুর। গল্প-সাহিত্যে উদাস দুপুরের কথা পাওয়া যায়। এ দুপুর অনেকটা সে রকম। চারিদিকে ঝাঝা রোদ। মাঝেমধ্যে দমকা বাতাস। সে বাতাসে আচমকা ধূলা উড়ছে। আচমকা ধূলা থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই দৌড় মারছে, কেউ কেউ আবার ধূলার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখেমুখে উদাস ভাব স্পষ্ট। ধূলা উড়লে উড়–ক, ধূলা ওড়ার বেল নাই- এরকম একটা ভাব। আমাদের স্কুলের ঠিক পিছনেই একটা বড় শিমুল গাছ আছে। বেশ পুরোনো গাছ। বসন্তকালে শিমুল গাছে কোনো পাতা থাকে না। এ সময় পাতার জায়গা দখল করে নেয় ফুল। ফুলে ফুলে গাছ ভরে যায় কিন্তু পাতার দেখা নাই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- এই শিমুল গাছে বসন্ত কালে কোনো ফুল দেখা যায় না। যে সময়ে ফুলে ফুলে ভরে ওঠার কথা সে সময়ে এই গাছ থাকে নির্লিপ্ত। অসময়ে সে ফুল ফোটায়। আগুনের মতো লাল লাল ফুল। অসম্ভব সুন্দর লাগে তখন। পাতার কারণে শিমুল গাছের ছায়া পড়েছে। আমি সে ছায়ায় এসে বসলাম। অতি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করলাম। আজ সকালে স্কুলে আসার সময় চিঠিটা পেয়েছি। চিঠি পড়ার সময় পাই নি তাই পড়া হয় নি। আমি চিঠির খাম খুললাম। কে পাঠিয়েছে জানি না। কারণ, খামে শুধু প্রাপকের নাম লেখা আছে প্রেরকের নাম নেই।
প্রিয় নীল,
৩০০ বার কানে ধরে উঠবোস করার পর তোমার অনুভূতি কেমন তা জানতে ইচ্ছে করছে। সাধারণ গণিতে তুমি একটা না, দুইটাও না, তিন তিনটা শূন্য পেয়েছ। ইয়া বড় শূন্য ! কী ভাবছো ? আমি এতকিছু আগে ভাগে জানলাম কী করে ? এটাও একটা প্রশ্ন বটে। কারণ, স্কুলে যাওয়ার পূর্বেই তুমি এই চিঠি পেয়েছ। স্কুলে কী ঘটবে না ঘটবে তা আমার জানার কথা না। কী ভাবছো ? আমার ভবিষ্যৎ বলার মতা আছে ? তুমি এখন কী করছো তাও কিন্তু আমি বলে দিতে পারি ! তুমি এখন শিমুল গাছের নিচে বসে আছ এবং খুব মনোযোগ দিয়ে এই চিঠিটা পড়ছো। কী, হয়েছে ? হা..হা.. এই ফাঁকে তোমাকে চুপিচুপি বলে রাখি- আমার কোনো ইএসপি মতা নেই। ইএসপি’র কথা শুনেছো তো ? ইএসপি হলো- এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপসন যাকে সহজ বাংলায় বলা যায়- অতীন্দ্রিয় মতা। অতীন্দ্রিয় মতা নেই অথচ ভবিষ্যৎ বললাম কী করে ? এটাই তো ম্যাজিক ! আমি ম্যাজিক দেখাতে পছন্দ করি। তবে আমাদের প্রধান বিষয় কিন্তু ম্যাজিক না। অন্যকিছু। এই অন্যকিছুটা আজ তোমাকে জানাচ্ছি না। পরে জানাবো। ততোণে তুমি এই চিঠি রহস্য সমাধান কর।
চিঠি রহস্য সমাধান করতে এখন আর ইচ্ছে করছে না। তাই আমি অফ মেরে গেলাম। চিঠি বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলাম। যিনি আমাকে চিঠি লিখেছেন তিনি ‘ঘাগু মাল’ এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। শিমুল গাছ তলা থেকে সোজা মেসে চলে এলাম। একটু রেস্ট নেয়া দরকার। রেস্ট নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটা এখন মনে নেই। উক্তিফুক্তি মনে রাখার কোনো আগ্রহও আমার নেই। রেস্ট নেওয়া দরকার- এতোটুকুই যথেষ্ট। রেস্টের উপর বিখ্যাত-কুখ্যাত উক্তি পড়ে লাভ কী ?
চলেব.....
আলোচিত ব্লগ
মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়
১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷
চলুন গল্পটা শুনে আসি৷
বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই
রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।
ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!
~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো
রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন