somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা লাস্ট ডেইজ অফ মিস্টার হাসান (একজন ব্যর্থ মানুষের শেষ জীবন এবং একটি সত্য-কঠিন বাস্তবতা)

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৩:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বারান্দায় ঝকঝকে রোদ।
হাসান সাহেব বেডরুমের বিছানায় বসে বারান্দার ঝকঝকে রোদ দেখছেন। তার প্রচন্ড ইচ্ছে করছে বারান্দায় একটি চেয়ার নিয়ে বসতে। কিন্তু তিনি পারছেন না। না পারাটাই তার জন্য স্বাভাবিক। কারণ ৬০ বছর বয়সী একজন প্রবীণ ব্যক্তির যে শক্তি বা সক্ষমতাটুকু থাকা উচিত, তা তার নেই। বারান্দায় যেতে হলে তার স্ত্রীর সাহায্য প্র‌য়োজন। কিন্তু তার স্ত্রী, পারভিন আক্তার এখন ঘরের বাইরে। বাজার করতে গেছেন।
হাসান সাহেব অসুস্থ। শুধু অসুস্থ বললে কম বলা হয়। তিনি একটু বেশিই অসুস্থ।
তার এই অসুস্থতা নতুন কিছু না। ৪৫ বছর বয়সের পর থেকেই তিনি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য মানসিক দুর্বলতাও এক্ষেত্র অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার একমাত্র ছেলে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নিজ বাবাকে কোন কাজ করতে দেখে নি। জীবিকা অর্জনের কাজ। সে তার বাবার অসুস্থতা দেখেছে। হাজার হাজার টাকার ওষুধ খেতে দেখেছ। ইনহেলার নিতে দেখেছে, নেবুলাইজার নিতে দেখেছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেনও নিতে দেখেছে। তার কাছে বাবার বেডরুমটা ছিল একটা ছোটখাটো হাসপাতাল।

গল্পের এ অংশে হাসান সাহেবের জীবনবৃত্তান্ত সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যেতে পারে।
হাসান সাহেব শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে তার সময়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। তিনি বি এ পাস করেছেন ৬০ এর দশকে। আবার মাদ্রাসার শিক্ষার উপরও তার দখল ছিল। পড়াশোনা শেষ করে নিজ গ্রামের আধা সরকারি হাই স্কুলে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রদের কাছে আতঙ্কজনক অথচ পছন্দনীয় ছিলেন। এজন্য অন্য শিক্ষকেরা তাকে বেশ ঈর্ষা করত।
হাসান সাহেবের বিষয় ছিল ইংরেজী। কিন্তু তিনি বেশি পছন্দ করতেন গণিত। তার একটা বিখ্যাত বাণী ছিল: যে ছেলে অংকে ভাল করতে পারে, সে কখনো পড়াশোনায় খারাপ করতে পারে না।

যাই হোক, বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর তার সৌদি আরবে যাওয়ার সুযোগ এল। তিনি সৌদি আরব যাওয়ার অনেক আগে বিয়ে করলেন পারভিন আক্তারকে। বিয়ে করে বউ আর তিন মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন নতুন ভাগ্যের সন্ধানে। তার যোগ্যতার অভাব ছিল না। তাই সৌদি আরবে গিয়ে সরকারি চাকরি জুটাতে তার সমস্যা হল না। সেখানে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বিলাসী জীবনযাপন শুরু করলেন। দামী সিগারেট খেতেন, পাইপ টানতেন। সিগারেটের ছাই ফেলার জন্য নানা ডিজাইনের ছাইদানি কিনতেন। তার প্রিয় কাজ ছিল ঠোঁটে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট গুঁজে গান শুনতে শুনতে ইংরেজি উপন্যাসের বই পড়া। অসুস্থতার স্বীকার হওয়ার পর তার কাছে সৌদি আরবে গমণ সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। যদিও তা বেশ খানিকটা বিস্ময়কর ছিল। অন্তত তার নিজের জন্য।
সৌদি আরবে থাকার সময় বড় ভাইকে টাকা পাঠালেন নিয়মিত। বিপুল পরিমাণে টাকা। বড় ভাইকে বললেন একটা বাড়ি তৈরি করতে। তার বড় ভাই খুব বেশি কাজ করতেন না। তিনিও সৌদি আরব ছিলেন। কিন্তু টিকতে না পেরে দেশে এসে বেকারত্বের শিকার হন। তাই মেজ ভাইয়ের কথা মতো কাজ করলেন। পাঠানো টাকায় বাড়ি করতে লাগলেন দ্রুত। দুই ইউনিটের তিন তলা বাড়ি। শহরের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় পাঁচতলা দালানও করলেন তিনি। দোকান টোকান ভাড়া দিলেন। হাসান সাহেব সৌদি আরব থেকে বড় ভাইকে পরামর্শ দেন। টাকা পয়সার হিসেব রাখতে বলেন। চিন্তায় তার ঘুম হয় না। চিন্তা বড় ভাইকে নিয়ে। হাসান সাহবের কাছে বড় ভাইয়ের চেয়ে আপন কেউ ছিল না। বড় ভাইয়ের প্রতি তার অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল। যে বিশ্বাসের মূল্য দিতে হয়েছিল চরমভাবে।

নানা সমস্যা আর দুশ্চিন্তার শিকার হাসান সাহেব আর সৌদি আরবে থাকতে পারলেন না। দেশে ফিরে আসলেন। এর মধ্যে বড় ভাইয়ের সাথে সম্পত্তির ভাগ হল। তার বড় ভাই বাড়ির এক ইউনিট, আর কিভাবে কিভাবে জানি পাঁচতলা দালানের তিন ভাগের দুই ভাগ পেলেন। এ নিয়ে হাসান সাহেব দু:খিত হন নি। কিন্তু টাকা পয়সার হিসাব নিয়ে তার ভাইয়ের সাথে তার ঝগড়া হল। মারাত্মক ঝগড়া। তার ছোটভাইয়ের সাথেও তার সম্পর্ক খারাপ হল। হাসান সাহেব ৪৫ বছর বয়স পেরোনোর পর জীবনের নিষ্ঠুর-করুণ-কষ্টকর ঘাত প্রতিঘাতে পড়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়লেন। নিজের প্রিয় মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে তিনি তা সহ্য করতে পারলেন না। তখন তার স্ত্রী তার পাশে না থাকলে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যাওয়াটা বেশ সম্ভব ছিল।
এখন হাসান সাহেব পুরোপুরি অক্ষম একজন মানুষ। তার জীবন তার কাছে ব্যর্থ এক অধ্যায় ছাড়া খুব বেশি কিছু না। তারপরও তিনি মৃত্যুকামী নন। পৃথিবীর প্রতি তার কেমন যেন অযৌক্তিক এক ধরনের মায়া আছে। এ মায়াকে তিনি অতিক্রম করতে পারছেন না। তবে তিনি চেষ্টা করছেন। মায়ার বাঁধন ছিঁড়তে পারলে তিনি মুক্তি পাবেন। নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাবেন।
হাসান সাহেব ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ। তবে তার পাঁচ মেয়ে এবং এক ছেলে-সবাই মোটামুটি ভালোই আছে। পিতামাতার প্রতি তাদের কারোরই কোন অবহেলা নেই। চার মেয়ে বিবাহিত। বড় দুজন শহরের অন্যখানে থাকে। পরের জনের বাস সমুদ্রের ওপাড়ে। তারপরের জন বিবাহিত হলেও এখনো বরপক্ষ তুলে নেয় নি। ছোট মেয়েটা পড়াশোনা করছে। ছেলেটা সবচেয়ে ছোট। বয়স কম। এবছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। হাসান সাহেবের সন্দেহ, এই ছেলেটার জন্য তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না। এজন্য তিনি মনে মনে চিন্তিত।

জীবনবৃত্তান্ত এখানে শেষ। এবার হাসান সাহেবের বেডরুমে ফিরে যাওয়া যাক।

DEATH, to the dead for evermore
A King, a God, the last, the best of friends -
Whene'er this mortal journey ends
Death, like a host, comes smiling to the door...

- Robert Louis Stevenson


চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:০৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×