somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্রসফায়ার সমাচার

১০ ই অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৪:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ সম্প্রতি তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত ৯৭ জন লোক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে ৮৩ জন। এরপর ১ অক্টোবর থেকে প্রতিদিনই গড়ে ২/৩ জন করে ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছে। ৫ অক্টোবর ভোর রাত্রে রাজধানীতেই নিহত হয়েছেন ৩ জন। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে গত ৫ বছরে এ ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড় হাজার। যা সত্যিই উদ্বেগজনক। কারণ, আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যা কোন সভ্য সমাজে কাম্য নয়।
উদ্বেগের আরো কারণ আছে, যখন এ ধরনের ঘটনার শিকার হন নিরাপরাধ লোকেরা কিংবা ঘটনা ঘটানো হয় সুপরিকল্পিতভাবে অথবা ক্রসফায়ারের নামে পুলিশই তাদেরকে হত্যা করে। এ ধরনের ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটছে অভিযোগ আসছে।
বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃত সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে উচ্চ মহলের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। এ সময় তারা তাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা প্রচেষ্টার নিদর্শনস্বরূপ অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের ক্রসফায়ার নাটক মঞ্চস্থ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- গত ৪ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার স্বস্তিপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের পুত্র তৌহিদুল ইসলাম তৌহিদকে (২৭) বটতৈল গ্রামের সেনের চাতাল থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ৬ জানুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে বড়িয়া গোরস্তানের কাছে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। নিহত হওয়ার পর পুলিশ জানায়, অপরাধীরা সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে এই সংবাদ পেয়ে ৬ জানুয়ারি রাত ১টার দিকে এসআই আজিজুল হক বড়িয়া গোরস্তানের কাছে পৌঁছলে তৌহিদ ও তার সহযোগীরা পুলিশকে ল্য করে গুলি চালায়। পুলিশও তখন আত্মরার্থে গুলি চালায়। এতে তৌহিদ গুলিবিদ্ধ হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছিল নিহত তৌহিদের নামে হত্যাসহ নানা অভিযোগ ছিল। অথচ তার আত্মীয়-স্বজনরা জানায় তৌহিদের বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা পর্যন্ত ছিল না। পরবর্তীতে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ স্পট অনুসন্ধান করে প্রত্যক্ষদর্শী, আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয় যে, পুলিশের ঐ বক্তব্যটি ছিল সম্পূর্ণ অসত্য। যা অধিকার তার এক রিপোর্টে উল্লেখ করে। (১৪ মে ২০০৯, নয়া দিগন্ত)
এ ধরনেরই আরেকটি ঘটনা ঘটেছে ১ অক্টোবর ভোররাত্রে বাগেরহাটে। ঐ দিন শেখ রেয়াজুল হক মাসুদ নামে একজনকে ক্রসফায়ার নাটক সাজিয়ে হত্যা করে পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য ছিল অন্যান্য ঘটনার মতো একই। “বাগেরহাট পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমানের ভাষ্যমতে, রাতে চরমপন্থীদের অভিযানের খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব বাগেরহাট সদর উপজেলার চুলকাঠি বাজার এলাকায় ছদ্মেবেশে টহল জোরদার করে। এক পর্যায়ে ভোরের দিকে চুলকাঠির নিকলেপুর পালপাড়া এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে চরমন্থীরা পুলিশ ও র্যাবের যৌথ টহলের ওপর গুলি শুরু করে। পুলিশও আত্মরায় গুলি শুরু করে। এক পর্যায়ে চরমপন্থী দলের সদস্যরা পিছু হটে। পুলিশ সকালে ওই পরিত্যক্ত বাড়ির বাগান তালাশি করে মাসুদের লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, নিহত মাসুদ চরমপন্থী জনযুদ্ধের সামরিক শাখার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন।” (২ অক্টোবর ২০০৯, আমার দেশ)
ঘটনাক্রমে নিহত মাসুদ আমার পরিচিত ছিলেন। বাগেরহাটে আমার চাচার বাড়ির পেছনেই তাদের বাড়ি। আমার সাথে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি যে, তিনি এ ধরনের কোন দলের সাথে জড়িত থাকতে পারেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন ঠিকাদার। বিগত জোট সরকারের আমলের ৫টি মামলায় তিনি প্রায় ৭ বছর বিনা বিচারে কারাগারে আটক ছিলেন। মামলাগুলোর কোনটিতেই তার নাম প্রথম দিকে ছিল না। যদিও পুলিশ দাবী করেছে তার নামে ১৫টি মামলা ছিল। যাই হোক, অবশেষে ৫টি মামলায় জামিন পেয়ে ৪ মাস আগে তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে ঠিকাদারী করছিলেন।
ঘটনার আগের দিন দুপুর ১টার দিকে তিনি পেশাগত বিষয়ে বাগেরহাট ডিসি অফিসে একটি কাগজে স্বাক্ষর করে বাসায় ফিরছিলেন। দশানি মোড়ে পৌঁছলে সাদা পোশাকে একদল গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে আটক করে নিয়ে যান। যা স্থানীয় দোকানদার ও লোকজন প্রত্যক্ষ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিষয়টি তার বাসায় জানালে স্বজনরা থানায় যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাকে থানায় না পেয়ে তারা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকদের সহযোগিতায় অনেক খোঁজাখুজির পরে জানা যায় তাকে এসপি অফিসে রাখা হয়েছে। তখন কয়েকজন সাংবাদিক এসপি’র সাথে কথা বলেন এবং তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। সাংবাদিকরা এসপিকে নিশ্চয়তা দেন যে, মাসুদকে তার ভালোভাবেই চেনেন এবং তিনি তাদের সাথেই চলাফেরা করেন। তারা মাসুদের জিম্মাদারী নেয়ারও প্রস্তাব দেন। কিন্তু কোন প্রস্তাবেই কাজ হয়নি।
ঐ দিনই বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, রাতে ২ জনকে ‘ক্রস ফায়ারে’ দেয়া হবে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মাসুদের স্বজনরা। রাত সাড়ে এগারটার দিকে তাদের একজন আমাকে ফোন করে এ কথা জানান। তবে আমি তাকে বলি যেহেতু সাংবাদিকরা বিষয়টি জেনে গেছেন সেহেতু ‘ক্রসফায়ার’ হয়তো করবে না। কিন্তু সকালবেলা টিভিতে ক্রসফায়ারের কথা দেখে আঁতকে উঠি।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়, নিহতের লাশ দাফন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন স্বজনরা। আটক করার সময় যারা দেখেছিল তাদেরকে পুলিশের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে চুপ থাকার জন্য। বর্তমানে আমার জানামতে, সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী এ ঘটনায় প্রশাসনের ওপর চরম বিক্ষুব্ধ।
যাই হোক এতো মাত্র দুটি ঘটনার কথা বললাম। অন্যান্য ক্রসফায়ারগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে হয়তো এ ধরনের আরো অনেক তথ্য বের হয়ে আসবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ বলেছিলেন “জোট সরকারের আমলে একটি রাজনৈতিক তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। এ হিটলিস্ট অনুযায়ী মারা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে সময় বলা হতো সন্ত্রাসীকে আটক করে একটি স্পটে যাওয়ার সাথে সাথে তার সহকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করত। এ সময় ক্রসফায়ারে নিরাপদ হেফাজতে থাকা ওই সন্ত্রাসী মারা যেত।” (১৪ মে ২০০৯, নয়া দিগন্ত)
বর্তমান সরকারের আমলে সে অবস্থার আরো এক ধাপ উন্নতি (!) হয়েছে। তখনকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আটক করার কথা অন্তত স্বীকার করত। কিন্তু বর্তমানে আটক করে নিয়ে গিয়ে সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। কিন্তু সে আটকের কথা আদৌ স্বীকারই করছে না পুলিশ।
পরিশেষে বলতে চাই, ক্রসফায়ারের নামে এ ধরনের মানুষ খুন অবিলম্বে বন্ধ করুন। নতুবা সরকার ও প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থার সঙ্কট ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে। যা জাতির জন্য হবে আত্মঘাতি।

[লেখাটি নয়া দিগন্তে ভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত]
লিংক :
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×