অযথাই নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা এই মানব জাতির। আমরা এই বাংলার সন্তান যদি আমাদের অস্তিত্বের (ভুমি, ভাযা, সংস্কৃতি ও ধর্ম) উৎস জানতাম! এই ভুমিতে কতশত জনপদের সংকর আমি, কত ভাষার বিলীনের ফসল এই আমার ভাষা, কত হারিয়ে ফেলা বিশ্বাস আর আচারের সমষ্টি গড়েছে আমার ধর্ম। জানলে হয়ত মানুষ হিসেবে আমাদের সহনশীলতা বাড়ত।
সেই ভেড্ডাপ্রতিম জনপদের সাথে হাজারো আর্য জনধারা মিশে একাকার হয়ে আজ আমরা বাঙ্গালী। সেই অস্ট্রিক, দ্রবিড় থেকে অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে নতুন রুপে আমাদের এই ভাষা। আর ভয়, মৃত্যু, ও অসহায়ত্ব থেকে জন্ম নেয়া হাজারো বিশ্বাস টিকিয়ে রেখেছিল শতশত ধর্ম। আমরা কেন ভুলে যাই, আমাদের এই ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মই একসময়ের অন্যন্য দাপুটে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে গিলে খেয়েছে নিজেকে নতুন রুপে সর্বজনীন করে তোলার জন্য। সংস্কৃতি মাত্রই জীবন্ত থাকে ততদিন, যতদিন কালের সাথে ধার করা উপাদানে নিজেকে বলিষ্ঠ ও ব্যবহারিক রাখে। পরিবর্তনশীল ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মই সর্বজনীন তাই কিছুকাল টিকে থাকার প্রয়াস পায়। হারিয়ে যায় জোর করে টিকিয়ে রাখার সমস্ত উপাদান। যে উপাদান পরিবর্তনশীল তাকে কেন বেঁধে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা আমাদের। নতুনকে গ্রহন কর আর না কর আজকের তুমি-আমি হারিয়ে যাবই কারণ তোমার-আমার ম্লানের মাঝেই নতুনের সৃষ্টি।
কেন বাংলা সংস্কৃতির সকল উপাদান একে একে হিন্দি আর পশ্চিমা সংস্কৃতির ভেতর বিলীন হবে না? টেলিভিশনে টকশো করে, উপদেশ দিয়ে এবং অন্য সংস্কৃতির প্রতি নাক সিটকিয়ে কি নিজেদের সংস্কৃতির মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব না। কারণ আমাদের সংস্কৃতির ধনদৌলত কমে যাচ্ছে অথবা ধনদৌলত তৈরীর কারখানা নাই। একটা সংস্কৃতির ধনদৌলত হল তাই যা ঐ সংস্কৃতির বাহকের চাহিদা মেটাতে পারে। আমাদের সংস্কৃতি কি আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে? যদি না পারে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা নিজেরাই নিজেদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ না করে অন্যদের প্রতি ঝুঁকে পড়ছি। এটাই শুরু আর শেষ হল হারিয়ে যাওয়ার ভেতর। হিন্দি আর পশ্চিমা সংস্কৃতি নিজের ভৌগোলিক গন্ডি ছাপিয়ে আরও অনেককেই প্রভাবিত করছে কারণ তারা নিজেদের চাহিদা সৃষ্টি করছে। তাহলে আমরা কেন পারছি না? কারন আমাদের চাহিদা সৃষ্টির কোন কারখানা নাই।
এখন আমরা একটু ভাবি, আমাদের কি এমন আছে যা অন্যরা গ্রহন করবে? আমাদের কি Oxford, Harvard, MIT, Hollywood, অথবা IIT, Bollywood এর সমমানের কিছু আছে? দলে দলে কি পৃথীবির মানুষ আমাদের দেশে আসে উচ্চশিক্ষার জন্য? আমরা কি জ্ঞান সৃষ্টি করি? পৃথিবীর সকল নামীদামী বই কি বাংলা ভাষায় লেখা ও পড়া হয়? আমরা কি পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছি? থাই, ইটালিয়ান, অথবা ম্যক্সিকান খাবার এর মত কি আমারা আমাদের খাবারকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি? আমরা কি চাইনিজদের মত টেকনোলোজিক্যাল রেভুলুশন ঘটিয়েছি? আমাদের কি Sony, Toyota, Mitsubishi, LG, Samsung, Hyundai, Mercedes-Benz, BMW, Ford, Tata etc এর মত কিছু আছে। আমরা কি কখনও কোন দেশ কলোনাইজ করেছি, যেখানে সংস্কৃতির বীজ বপন করে এসেছি? আমরা কি অষ্ট্রেলিয়ার মত একটা স্পোর্টিং ন্যাশন হতে পেরেছি? আমাদের কি এমন কিছু আছে যা নেয়ার জন্য পৃথিবীর মানুষ মুখিয়ে আছে, যার মাধ্যমে সংস্কৃতির স্থানান্তরণ এবং প্রসার হবে? খুব হতাশার তাই না।
তারপরও আমি মনে করি, আমাদের এমন একটা জিনিস আছে যা অনেকের নাই। মানব সম্পদ, মানুষেরাই হল সংস্কৃতির বাহক। এখন দেখার বিষয়, আমারা বাংলাদেশিরা; Indian অথাবা Chinese দের মত কি যেখানে যাচ্ছি সেখানে "Little India" অথবা "China town" এর মত "Little Bd" কিছু বানিয়ে ফেলছি? নাকি আমরা নিজেরাই ওদের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছি। আমরা যদি ওদের ভেতর হারাতে থাকি, আমাদের সাথে সাথে আমাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাবে। আর এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, দাপুটে সংস্কৃতি ছোট ছোট দেশ ও জাতির উপাদান গুলি গিলে খাবে এবং নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আমাদের ভাষা, ধর্ম, খাবার, পোষাক সবকিছুই একদিন অন্যের হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ৭:৩১