somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ভুল জীবন

০৯ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছেই আমার একটা টিনের ছোট চাউনি ছিল। আমার বয়স তখন প্রায় চল্লিশ কি উনচল্লিশ। আমার পরদাদার বাড়ি দিনাজপুরে। ব্রিটিশদের সময়ে ঢাকা এসেছিলেন, দিনাজপুরে ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। সেই ভিটেমাটির পাঠ চুকিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে এতদূর।

ব্রিটিশদের আমলে উনার অনেক নামডাক। সেই আমলের নামকরা রাজমিস্ত্রী ছিলেন তিনি। তখন কি আর এত পাকাঘর ছিল!! ঢাকা শহরের পুরনো বড় বড় ইমারত আমার পরদাদার হাতেই তৈরি, বাবার মুখে অনেক গল্প শুনেছি।উত্তরাধিকারসূত্রে আমার দাদা- বাবা এখন আমিও সেই পেশাকে ধরে রেখেছি।

ছোটকালে অনেক অভিমান হত। কত শত বড় বড় ঘর বানায়, আমার বাবা, দাদা, পরদাদা। অথছ আমাদের সেই পানিপড়া ছনের ঘর। বড় হয়ে আমি বিশাল ঘর বানাবো, আমাদের ঘর। বড় ঘর আর হল না, ছোট টিনের ছাউনি। বৃষ্টি এলে ঝনঝন শব্দ কানে বাজে, ছোটবেলার অভিমান বেশি বেশি মনে পড়ে তখন। বাবার অসহায় মলিন মুখটা তখন বড্ড মায়াময় লাগে।

পরদাদার পেশা আর ছাড়তে পারিনি। শহরজুড়ে কত বড় বড় বিল্ডিং এখন, কত শত আমার নিজের হাতে গড়া। দিনশেষে আমার সেই ছোট্ট চাউনি। সেখানে আমার ছোট্ট ছেলে আর দুই মেয়ে। ছোট্ট ছেলেটা বড় আদরের। কোহিনূর তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চায়। একটা একটা করে শত অভাবের মাঝেও পয়সা জমায়, আমার সাথে প্রায়ই এনিয়ে ঝগড়া।

মেয়ে দুইটা দেখতে দেখতে ৯ আর ১২ তে পা বাড়ায়। মেয়েগুলাও খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়। ইদানীং আর রাতে ঘুম আসতে চায় না। এত অভাবের মাঝেও কোহিনূর আমার জীবনে কোহিনূর। সংসারে সব কাজ সে একাই সামাল দেয়। প্রতিদিন ভোর ৫ টা বাজে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজটা পড়েই তার কাজ শুরু। সকাল ৯ টা থেকে পালা করে তিন বাড়িতে কাজ। তার বাড়তি আয়ই আমার বেকার সময়ের একমাত্র ভরসা। বর্ষার সময় কাজ থাকে না বললেই চলে।
চাপ আর পরিশ্রমে আমার কোহিনূর খুব তাড়াতাড়িই বুড়িয়ে গেল। শরীরটা তার রোগ-বালাইয়ের ঘর।মাঝে মাঝে ইয়াসিনের দোকান থেকে প্যারাসিট্যামল নিয়ে যাই। ৫ বছর আগে আবুলের জন্মের সময় শেষ ডাক্তারের কাছে যাওয়া। কখনো কোন অভিযোগ নেই তার। তার মলিন মুখখানা বড় পীড়া দেয় আমায়।

চার বছর হল আজকের দিনটা গত হয়ে গেল। এতসব পীড়া কোহিনূরকে দিয়ে আমার প্রস্থান। তাকে এভাবে একা ফেলে যাওয়া আমার ঠিক হয় নি। নিয়তি কহিনূরের সাথে খুবই নির্মম।

এসবের জন্য আমিই দায়ী। কি প্রয়োজন ছিল সেদিন, দুনিয়ার সব নৈতিক বোঝা নিজের মাথায় তুলে নেয়ার! কোহিনুরের কষ্টের জীবনে শুধু কষ্টটাই বাড়িয়ে দিয়ে গেলাম।

২০১৪ সালের কোন এক দুপুর, অকারনে হাটাহাটি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানকার স্থানীয় হওয়ায় অবাধে চলাচল ছিল আমার।

সেইদিন এক নারীকন্ঠের চিতকার কোহিনুরের জীবনকে করেছিল আরো বিভীষীকাময়। কোহিনূর রেগে গেলে প্রায়ই মূর্খ বলত আমায়। আসলেই আমি মূর্খ। কি প্রয়োজন ছিল আমার সেদিন অচেনা-অজানা কারোর আবেদনে ঝাপিয়ে পড়ার!! আজ সেই অচেনা নারীকন্ঠও হয়ত সুখেই আছে। মাঝখান দিয়ে জগতের সকল দু: খের বোঝা কোহিনূর একাই বয়ে চলল। আমার অসহায় পরিবারের ঘানি এখন কোহিনুরের ঘাড়ে। বৃদ্ধ অসহায় বাবা, দুইটা পরী আমার, আর ছোট ছেলে।

আমি উপর থেকে সব দেখি, আর আফসোস করি। সেই দিনের পর আমি যেন হিরো হয়ে যাই। সাংবাদিক আসল গেল কিছুদিন। অনেকেই ছোট-খাট সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার ছোট্ট সংসারে। অল্প কিছুদিন যেতেই মানুষ আমায় ভুলে গেল।ভুলেনি আমার পরিবার।

কোহিনুর এখন তার ভাঙ্গা-চোরা শরীর নিয়ে ৫ টা বাসায় কাজ করে, আমার ছোট্ট পরীগুলোও বড় হচ্ছে। নিয়মিতই আধপেটা খেয়ে থাকে তারা। ছোট ছেলেটা স্কুলের নাম করে মার্বেল খেলে বেড়ায়। সেও সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পেশায় নিয়োজিত হবে কিছুদিন পর। বড় পরীটা গার্মেন্টস এর কাজের চেষ্টায় আছে।

আমি হয়তবা খুব ভাল কিছু দিতে পারিনি আমার পরিবারকে। দুনিয়ার নৈতিক দায় ঘাড়ে না নিলে, কোহিনূরকে এক চিমটি সস্তি দিতে পারতাম। সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×