প্রেস্ক্রিপশন ও বারডেমের ডক্টরের পরামর্ষ অনুযায়ী খোঁজ নিলাম একজন হেমাটোলজিস্টের। খোঁজ নিয়ে জানলাম উনি দেশে নেই এই মাসের শেষে আসবেন। গোল্ড মেডেলিস্ট ডক্টর সাহেবের চেম্বারে তবু আসার প্রথম দিনই দেখা পাবার জন্য নাম দিয়ে রাখলাম। যেদিন দেখা করার কথা সময় পেলাম আমরা সন্ধ্যা ৭ টায়।সময় মতোই আমরা গিয়ে হাজির।৩০ মিনিট পরই দেখা পেলাম ডাক্তার সাহেবের। রিপোর্ট দেখে ও সব শুনে উনি মত দিলেন, এক রিপোর্টের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবেনা, আরও পরীক্ষা করতে চান তিনি, প্রথম টেস্টটা আজকেই, উনি বোন ম্যারোটা টেস্ট করাতে চান। আরেকটা টেস্টও লাগবে, এখানে স্যাম্পল কালেক্ট করে ইন্ডিয়াতে উনি ল্যাব রিপোর্টের জন্য পাঠাতে চান। দ্বিতীয় টেস্টটায় খরচ একটু বেশি, বললেন, প্রিপারেশন না থাকলে আগামি সপ্তাহ খানেক পরে করে দেখা যেতে পারে। ঠিক করলাম, বোন ম্যারো টেস্টটাই করাতে দিবো। এই রিপোর্টেও একি আসলো, লিউকোমিয়া। রিপোর্টের পর যেদিন ডক্টর দেখাতে গেলাম, উনি বললেন, দুইটা উপায় আছে, এখন যেহেতু প্রিলিমিনারি স্টেজে, আপনারা দেড় মাস ওষুধ খেয়ে দেখতে পারেন, কিন্তু এরপর কেমো নিতে হবে, কয়টা কেমো দরকার হবে এখনি বলা যাচ্ছেনা, তবে এটাই এখন একমাত্র চিকিৎসা। মাথায় বাজ পড়ল।
এই ডক্টর সাহেব দেশের মধ্যে এই চিকিৎসায় প্রবীণ এবং অনেক নাম করা। কিন্তু তাঁর যে ব্যস্ততা আর তাঁর চেম্বারের যে নাজুক হাল, এটাই শুধু মনে হচ্ছিলো আব্বু এখানে আসতে লাগলে আর এখানেই চিকিৎসা নিতে হলে হয়তো আরও আসুস্থ হয়ে পড়বে। কোনো কারন জানিনা, কেন জানি বারবার শুধু মন বলছিল এটা আমাদের জন্য সঠিক জায়গা না। যারাই শুনেন আত্মীয় বা যেই, বলেন, দেরি করাটা ঠিক হবেনা, চিকিৎসাটা শুরু করো।
কিন্তু কিভাবে বলবো কাউকে যে, কেমো যে শুরু করাবো, সেই খরচ এই মুহূর্তে দেয়াতো পরে, টেস্টই এখনো একটা করাতে পারিনি। ততদিনে আমি জব ছেড়ে নোটিস পিরিয়ডে কাজ করছি অফিসে।না পারি কাউকে নিজের সত্যিকারের অবস্থাটা বলতে না পারি মনকেও মানাতে। ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পড়ছিলাম ভীষণ। শুধু পারছিলাম না কাউকে বলতে কিছু। মাথার মধ্য শুধু কাজ করছিলো আব্বুর ভিতরে একটা জীবাণু যা একটু একটু করে বাসা বাঁধছে। আর যাই হোক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কিভাবে কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
যারা আত্মীয় স্বজন, আপনজন ছিলেন, জানতে পারলেন, কেউ বললেন, দেরি না করতে, কেউ বললেন, দেশের বাহিরে নিয়ে যেতে, কেউ বললেন, এখানেই সঠিক চিকিৎসা সম্ভব, যা করতে হবে, যেনো করা হয়। কি ভেবে আমি মনে মনে ঠিক করলাম, আরেকজন ডক্টরকে কি দেখাবো?
একটা ব্যপারই শুধু মনে হতো সেই দিনগুলোতে, আর যাই হোক, আমার আব্বুর লিউকমিয়া হতে পারেনা। একদিন রবিবার সম্ভবত, দুপুর বেলা বাসা থেকে বের হলাম কয়টা হসপিটালে যাবো। প্রথমে গেলাম, ল্যাবএইড, পরে পপুলার আর সবশেষে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হসপিটাল। উদ্দেশ্য, ব্লাড ক্যান্সার আর লিউকেমিয়া স্পেশালিষ্ট কোনো ডক্টর খুঁজে বের করা। প্রায় সবখানেই কেউ না কেউ এই অসুখ দেখেন এমন ডাক্তার বসেন। মিরপুরের আহসানিয়া মিশন হাসপাতালে ফ্রন্ট ডেস্কে যখন গেলাম, এটেন্ডেন্টদের যখন বলছিলাম, আমার পাশেই এক মহিলা দাঁড়িয়ে শুনছিলেন আমার কথা। আমার জিগ্যাসা শুনে উনি আমাকে বললেন, ভাইয়া একটা কথা বলি, আমার ছেলের আপনার বাবার মতই একি অসুখ, আপনি কর্নেল এম মনিরুজ্জামান সাহেবকে দেখান, উনি খুব ভালো মানুষ। যত্ন করে সব রোগী দেখেন উনি, আপনি যখন প্রয়োজন বোধ করবেন, উনার সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলতে পারবেন। এইটুকু বলতে পারি, আপনি সঠিক চিকিৎসা পাবেন। যখন উনার কথা শুনছিলাম, মহিলার চোখ ছলছল করছিল কেন জানি মনে হলো। ভালো কোনো মানুষের জন্য যখন দোয়া আসে কারো আর তাঁর কথা যখন বলে কেউ, বোধ করি তাঁর চোখ এমনই ছলছল হয়ে উঠে। আমার মনে শুধু এইটুকুই বললো, আমি আব্বুকে নিয়ে এই ডক্টরের কাছে অবশ্যই যাবো।
ফোন নাম্বার নিয়ে তখনি ডক্টর সাহেবকে ফোন দিলাম, সবশুনে উনি বললেন, পারলে আজকেই চলে আসেন, সন্ধ্যার পর আমি বসবো ধানমণ্ডিতে আনোয়ার খান মরডান হাসপাতালে। সেদিনই গেলাম, ইনিও টেস্ট করাতে দিলেন, কিছু ইবনে সিনায়, আরেকটা টেস্ট পিজি হাসপাতালে। রিপোর্ট দেয়ার পর সিদ্ধান্ত দিবেন বললেন। এইটুকু শুধু বলবো, কোন রিপোর্ট না পেয়েও আব্বুকে এতো সুন্দর করে উনি বুঝালেন, আব্বু, আম্মু আমরা সবাই যেন নতুন করে সাহস পেলাম।
আমাদের দেশের ডক্টররা অনেকেই ভালো, অনেকেই অনেক ফিল্ডে প্রথিতজশা, কিন্তু যারা একটু ভালো করেন, কেউ রোগীদের কথা ভালো করে শুনেন না। হয়তো ব্যস্ততার কারনে তাদের এতো কিছু শুনা বা সাহস দিয়ে দুইটা কথা বলবার মতো সময় হয়না। কিন্তু তারা হয়তো একটা বিষয় ভুলেই যান, মানুষের মনের জোরেই কিন্তু মানুষ এই জীবনটায় চলে, আশা আর সাহস থাকলে অনেক কঠিন বাঁধাও মানুষই পার হতে পারে।
রিপোর্টে আসলো একি। আমাদেরকে সামনে রেখেই ডাক্তার সাহেব ইন্ডিয়াতে তাঁর একজন পরিচিত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দিলেন, কেমো থেরাপিটা নিতেই হবে, সম্ভব হলে আগামি দিন পনের এর মধ্যেই। ঠিক করলাম, আমি যাবোনা। আগে আব্বুর কেমো দেয়া হোক, পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাববো কি করব। আমার কথা শুনে আব্বু বললো, তুমি যাওয়া কেন্সেল করোনা। কিছুতেই তখন আর যাবার কথা ভাবতে পারছিলামনা, যখন সত্যিকারের বুঝতে পারলাম কেমো থেরাপিটা আব্বুকে নিতেই হবে। কখনো নামাজের মধ্যে, কখনো অফিস থেকে বাসায় এসে শুধু কাঁদতাম, আর আল্লাহকে ডাকতাম। যে বাবাকে বড় হবার পর কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখিনাই, যাকে কখনো এক ওয়াক্ত নামাজ ইচ্ছা করে কাযা করতে দেখিনাই, তাকেই কেন এতো কষ্ট পেতে হবে?
এই অসুখ নিয়ে আগে কিছুইত জানতাম না। যখনি পারতাম, ইন্টারনেটে শুধু সার্চ করতাম আর বুঝতে চাইতাম, কেমন লাগছে আব্বুর শরীরের ভিতরটায়। কি বা কোথায় আছে ঠিক চিকিৎসা। ডাক্তার বলেছিলেন সবমিলিয়ে ছয়টার মতো কেমো দেয়া লাগতে পারে। হিসেব করে দেখলাম, আমাদের যা সঞ্চয়, তা দিয়ে বড় জোর একটা কি দুইটা কেমো দেয়া যেতে পারে। এরপরের গুলোর ব্যবস্থা কিভাবে হবে?
কি ভেবে একদিন আব্বুকে বললাম, আমি তখনি যাবো, যখন তুমি কথা দিবা তুমি যা চিকিৎসা লাগে নিবা। আব্বু আমাকে বললো, আমি নিবো, তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে সব কিছু ঠিক করো। ঠিক হোলো আমি যাবার দুইদিন পর আব্বু হাসপাতালে ভর্তি হবে।
ঐ দিনগুলোর কথা আজকে যখন মনে করছি শুধু এইটুকুই মনে পড়ে, নিজেকে পাগল পাগল লাগতো আমার। একবার আম্মুর দিকে তাকাই, একবার ছোট ভাইটার দিকে, মনে হতো কাউকেই মনে সাহস দিতে পারছিনা, মনে হতো শুধু সবাইকে পানির মধ্যে, অজানার মধ্যে, মৃত্যুর মুখে রেখে আমি পালিয়ে যাচ্ছি।
সত্যিই কি পালাচ্ছিলাম তখন আমি? মনে আছে, যাকে যেখানে পেতাম, শেয়ার করতাম আব্বুর অসুখটার কথা। যদি কারো জানা মতে কোন ভালো পরামর্শ থাকে? প্রায় সবার একটাই পরামর্শ, সম্ভব হলে দেশের বাহিরে নিয়ে যাও। কিভাবে বলতাম কাউকে, দেশের বাহিরে রেখে দিনের পর দিন অজানা সময় পর্যন্ত চিকিৎসা করানোর অবস্থা পর্যন্ত আমাদের নেই। সবাই হয়তো বুঝতো না। কিন্তু এইটুকু বুঝতাম, যে যাইই বলতো আন্তরিক ভাবেই পরামর্শ দিত। ঠিক করলাম আমি যাবো, আব্বুর ইমারজেন্সির জন্য ব্যবস্থা করার জন্যই যতো আগে সম্ভব আমার যাওয়াটা আরও জরুরি। দরকার হলে এক/ দুইটা কেমো নেয়ার পর আব্বুকে দেশের বাহিরেও পাঠাবো। জীবন একটাই। আমার শেষ টুকু দিয়ে হলেও চেষ্টা আমরা করবো।
আব্বু, আম্মু, কারোরই তখন পাসপোর্ট আপডেট নেই। ঐ সময়ে পাসপোর্ট করালাম, পাসপোর্ট ইনফরমেশন ঠিক করানোর জন্য বার্থ সার্টিফিকেট ঠিক করালাম, কেউ কেউ বললো বিদেশেই যদি না নিবো, এই শরীরে এই সব কেন করাচ্ছি? কাউকে কোন সঠিক উত্তর দিতে পারতাম না। শুধু বলতাম, জানিনা, আমি শুধু সবগুলো রাস্তা খোলা রাখতে চাই।
এর মধ্যে নিজের টিকেট কনফার্ম করলাম, বাংগালি দেশের বাহিরে যেতে সবার প্রথম যেটা মনে আসে তা হল লাগেজ, দুইটা লাগেজ কিনলাম নিউমার্কেটে গিয়ে একদিন। এসব করি, কাজ শেষে বাসায় আসি আর বালিশে মুখ বুজে শুধু কাঁদি। আম্মুর মুখের দিকে, ছোট ভাইটার মুখের দিকে, অসুস্থ বাবার মুখের দিকে তাকাই আর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে মনে হয় ছিঁড়ে যায়। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারিনা। খুব বেশি ম্যাচিওর বলে নিজেকে কখনো জানতাম না। ঐ সময়টা মনে হয় আমাকে অনেক কিছু বুঝালো। অফিসে একদিন নামাজ পড়ছিলাম, মনে পড়ে মনের অজান্তেই অনবরতো চোখ দিয়ে পানি পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে কখনো খুব স্বার্থপর মনে হতো। একটা কথাই শুধু ভাবতাম তখন, আমার ভিতরে কি হচ্ছে, কেমন লাগছে, সবার কাছে প্রকাশ করবোনা। আর যাই হোক ভেঙ্গে পড়বোনা।
একদিন অফিসে সারোয়ার ভাই (আমার বস) বললেন, আল্লাহ মানুষের সবচেয়ে বেশি দোয়া শুনেন, যা শেষ রাতে করা হয়।তাই করলাম। কানলাম আল্লাহর কাছে। আব্বুর শরীরের কষ্ট গুলো যেন উনি দূর করে দেন, আম্মু আর ছোট ভাইটার মনে যেন সাহস দেন, মনে জোর দেন, আমাকে যেন সঠিক কাজটা করার মন আর তৌফিক দেন।
আমার একার না, আমাদের সবার দোয়া আল্লাহ শুনেছিলেন। আমি মার্চের দুই তারিখ রাতে ফ্লাই করি, আব্বু সাত তারিখ হাসপাতালে ভর্তি হয়, প্রথম কেমো দেয়া হলো, টেস্ট করানো হোলো, রিপোর্টে হোয়াইট ব্লাডসেল লেভেল নরমালে আসলো।
ডাক্তার সাহেব বললেন, প্রতি পনের দিন পরপর উনি টেস্ট করে মনিটর করবেন, ব্লাড লেভেল ঠিক আছে কিনা। সব দেখে সিদ্ধান্ত দিবেন আবার কবে বা কখন কেমো নিতে হবে।
এই লেখার মাধ্যমে আমি মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি ডাক্তার সাহেবসহ আমাদের সব আত্মীয় আর পরিচিত মানুষ ও বন্ধুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। ঐ সময়টায় সবাই আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, হাসপাতালে গিয়ে আব্বু আম্মু আর আমার ছোট ভাইটাকে সাহস দিয়েছেন, কখনো তারা যে একা এইটা বুঝতে দেননি। আল্লাহ নিশ্চয়ই সব ভালো কাজের প্রতিদান দেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সবাইকেও ভালো রাখবেন।
আমি এই দোয়া করি, আমি, আমরা সবাই যেন অন্যের পাশে এভাবে থাকতে পারি, সাহস দিতে পারি বিপদে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:০৫