প্রিয় মেমসাহেব,
তোমায় লেখা এই চিঠি কখনো কি
তুমি পড়বে?তুমি কতদূরে থাকো?
কোথায় তোমার বাড়িঘর?
বাংলাদেশের কোনো মফস্বলের
গলিতে বসে অপেক্ষারত কোনো
তরুণের চিঠি তোমার বাড়ির
ডাকবাক্স পেরুবে সে আশা করিনে।
তবুও মধ্যবিত্ত ঘরের যুবকদের দৌঁড়টা
তো ওই আকাশের ঠিকানায় চিঠি
লিখো পর্যন্তই।আমিও বা ব্যাতিক্রম
কই?
জানো মেমসাহেব কিশোর বয়সের
প্রেমগুলো না কেমন খাঁপছাড়া।
কোনো ব্যাকরণ মেনে আসেনা।হুট
করে হয়ে যায়।প্রেমে পড়ব না পড়ব
না করেও কেমন করে যেন হোঁচট
খেতে হয়।নির্লিপ্ততার মুখোশ ধরে
একদিন দেখি সব খুইয়ে বসে আছি।
মেমসাহেব,তুমি তো মেম
ছিলেনা।আর দশটা সাধারন
বাঙালী ঘরের সিঁথপাটি করা
মেয়ে ছিলে।যার ভীরু পদক্ষেপে
রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা যুবকদের
বুকে কাঁপন ধরাত।অস্বীকার করিনা
সে প্রেমে আমিও পড়েছিলাম।নাক
মুখ ডুবিয়েই পড়েছিলাম।সে প্রেম
তোমার দৃষ্টিগোচর করার সাহস হয়ত
মধ্যবিত্ত আটপ্রৌঢ়ে কিশোরটির
ছিলনা। প্রেমের সাক্ষী ছিল কেবল
বিছানা,বালিশ,পাশবালিশ,আর
সারা রাতের ছটফটানি।একে তুমি
প্রেম বল আর নাই বল।
হাসছো নাকি?হেসে নাও।প্রথম
প্রথম তোমায় দেখতাম দূর থেকে।
রোজ একবেণী করে কেমন ভয়ে জড়সর
হয়ে প্রাইভেট পড়তে আসতে তুমি।
ছেলে মেয়ের বসার ব্যাবস্থা ছিল
আলাদা।তবুও সবার দৃষ্টি বাঁচিয়ে
একদম শেষের দিকে কোণার একটা
জায়গায় বসতে।পাছে কেউ দেখে
ফেলে।আমিও কম যাই না।এর মাথা
ডিঙিয়ে তার ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে
তোমার হাজার বান্ধবীর চোখ
এড়িয়ে আলগোছে ঠিকিই দেখে
নিতাম।সে দেখা তোমার দেখা
হতো না কোনোদিন।
ছুটির পর ঠিক যেভাবে এসেছিলে
সেভাবেই ভীত হরিণীর মত এদিক
ওদিক না তাকিয়ে সোজা বাড়ি।
আহারে যদি তাকাতে হয়ত কোনো
না কোনোদিন চোখে পড়ত
ভাঙাচোরা হিরো সাইকেলে
বহুদূর থেকে বাড়ির পথ এড়িয়ে
কোনো বালক তোমার পিছু নিচ্ছে।
বালকের খেলায় মন নেই,পড়ায় মন
নেই,আড্ডায় মন নেই।তার মন তোমার
বাড়ির চৌরাস্তায় বাঁধা পড়ে
থাকে দিবারাত্র।এ কেমন অনুভূতি!
প্রেম করতে নাকি সাহস লাগে।
আমার তার অভাব ছিল না
কোনোকালেই।এর গাছের আমটা
লিচুটা চুরি করে খাওয়া,তার ছাগল
ধরে রং করা,কিংবা বাজী ধরে
পাড়ার বুড়োটাকে ভয় দেখানো
সেসব বিদ্যে পেট বোঝাই ছিল।শুধু
তোমার ব্যাপারেই কেমন যেন হাড়
হাভাতে।কোনোদিন সামনে
যেয়ে যে অধিকার চেয়ে নেব সে
সুযোগ বা সামর্থ্য কোনোদিনও
হয়নি।মনে আছে একবার কি যেন অসুখ
করল তোমার।তিন দিন পর পর পড়তে
এলেনা।আমার তো ত্রাহী ত্রাহী
অবস্থা।সারাদিন তোমার বাসার
সামনে অযথা হাঁটি।একটাবার যদি
তুমি দাঁড়াও বারান্দাটায়।তুম
ি দাঁড়াওনি।
তিনদিন পর যেদিন এলে সেদিন
চোখ অনেকখানি বসে গেছে কেমন
কালো কালির ছাপ চোখে মুখে।
আমি আর থাকতে পারলাম না।
যাওয়ার সময় পথ আটকালাম
"এতদিন আসোনি কেন?"
তুমি একটাবার শুধু একটাবার কেমন
অদ্ভূত দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকিয়েই
চোখ নামিয়ে নিয়ে বললে-"জ্বর
ছিল।"
বলেই আমাকে হতভম্ব করে ভোঁ দৌঁড়।
বিশ্বাস করো সেদিন রাতে ঘুমুতে
পারিনি একদমি না।খালি এপাশ
ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম।
এরপর সবকিছু জানি কেমন কেমন হয়ে
গেল।তুমি আরো গুটিয়ে গেলে
নিজের মধ্যে।চোখ তুলে হাঁটতেই
না পাছে চোখাচোখি হয়ে যায়।
তোমার বেঞ্চিতে রোজ ছোটছোট
চিরকুট রাখতাম।তুমি পেতেও।
পেয়ে কেমন যেন শিউরে উঠতে।
তারপর তড়িঘড়ি ব্যাগে পুড়তে।
তোমার কপালে অল্প অল্প ঘাম
জমতে দেখতাম।কই কোনোদিনতো
চিরকুটের কোনো জবাব পাইনি।তবু
তোমার আচরণে এ কেমন প্রচ্ছন্ন
আশকারা?
সাইকেলে যখন পিছু নিতাম কই
কোনোদিনতো একবারো ফিরে
তাকাওনি।একদিন বুকের সব সাহস এক
করে রাস্তা আটকে
বলেছিলাম"ভালবাসি"।তুমি ডুকরে
কেঁদে উঠে দৌঁড়ে পালালে।কই
বলোনিতো পথ ছাড়ুন,অসভ্য
কোথাকার।কেন কেঁদেছিলে?
তারপর?তারপর অনেক জল গড়ালো।
তুমি হুট করে পড়তে আসা বন্ধ করে
দিলে।তোমার বাসার সামনে
যেয়ে দাঁড়াব সে জোও নেই।
তোমরা বাসা বদলেছ।নতুন ঠিকানা
জানিনা।কিশোর বয়সের প্রেম
যেমন করে আসে তেমনি নাকি উবে
যায়।আমিও ধীরে ধীরে তোমায়
ভুলছিলাম।খুব সন্তর্পনে।
তারপর আবার আরেকদিন তুমি এলে।
আরেকবার।তবে এবার নতুন অবতারণা।
ছুটির পর আমি নই,তুমি আমার পথ
আটকালে।সেই অবনত মস্তক সেই
চোরা চাউনিতে কেমন করে যেন
বললে-"আমার বিয়ে,ছেলে
কানাডা থাকে।"তোমার সে
বক্তব্যে কি ছিল?নিছক সংবাদ
প্রদান?নাকি আকাঙ্খা?ভালবাসা?
মেমসাহেব,তোমার ওখানে এখন
দিন না রাত?কত অজস্র বসন্ত এরপর
কেটে গেল।কখনো জানা হয়নি তুমি
কোথায় আছো কেমন আছো।ভীরু
মধ্যবিত্ত কিশোর এখন পরিণত যুবক।
অনেক কিছুই সে বোঝে এখন।শুধু
এখনো সে তোমার ওই ভীরু
উচ্চারণের মানে বোঝে না।এখনো
না....
ইতি
আমাকে তো চেনোই!
---------------------------------------------------------
(প্রতিউত্তর)
অচেনা কিশোর,
চিঠি পেয়ে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হলো।প্রথমে থমকে গেলাম,এরপর একটু অবাক হলাম,মন খারাপ হল আবার হয়তো একটু খুশিও হলাম হয়তো বা হইনি।জানিনা আসলে এই অনুভুতি ব্যক্ত করার সঠিক ভাষা আমার নেই। তুমি আমাকে মনে রাখবে ভাবিনি।
কত প্রশ্ন করেছ তুমি।কত কথা বলেছ।কোনটার উত্তর দেব আমি। তুমি কি ভেবেছ আমি কখনো দেখিনি তুমি কি করতে?কত লোক ঘুরত পিছে কিন্তু আমার চোখ দেখত শুধু তোমায়!
অবাক হচ্ছো?ভাবছো এ আমি কি বলছি!!এখনই অচেনা কিশোর বলে সম্বোধন করলাম আর এখন এসব বলছি কেন তাই ভাবছ?
তুমি বড্ড বোকা।আসলে ছেলেরা একটু বোকাই হয়।তারা জানেনা মেয়েরা সব বুঝে। হাজার লোকের ভিড়েও সে চোখ খুঁজে নেয় যে চোখে থাকে অকৃত্তিম ভালোবাসা।যেদিন তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে কেন আসিনি সেদিন তোমার চোখে এক অদ্ভুত মায়া দেখেছিলাম আমার জন্যে।সেদিনই তোমার প্রেমে একটু একটু করে পড়তে শুরু করলাম।
তুমি খুব আক্ষেপ ভরে লিখেছ আমি কখনো তোমার চেষ্টাগুলো দেখিনি।কিন্তু জানো আমি সব জানতাম,সব দেখতাম।আড়চোখে দেখতাম আমার পিছু পিছু তোমার হেটে আসা,আমার বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি, আমাকে একবার দেখতে কি না ছটফট করতে। আমি জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতাম।বারান্দায় আসার সাহস হত না।এই বাউন্ডুলে ছেলেটাকেই আমার ভাল্লাগত।
মনে আছে তুমি সেদিন আমার পথ আটকে বললে ভালোবাসো।আমি কেঁদে দৌড়ে পালালাম।সেদিন খুব কেঁদেছিলাম জানো।কেন তা জানিনা! প্রথম প্রেমের প্রথম প্রস্তাবের সুখ কি আর হাসিতে সয়।চোখের জলেই সব আবেগের প্রকাশ ঘটে।
আমি বলতে পারিনি তোমায় কৈশোরের প্রথম প্রেম তোমাকেই নয় আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল।জানো কৈশোরের প্রেমের বিশেষত্ব কি?এতে হয়ত বাস্তবতার ছোঁয়া থাকেনা কিন্তু এতে থাকে পবিত্রতা।এই প্রেমে কোন আকর্ষণ তত্ব থাকে না।এই প্রেমে কোন চাওয়া পাওয়ার হিসেব থাকে না।বড় হতে হতে হয়ত এই মোহ কেটে যায়। "ক্রাশ" শব্দের আড়ালে ভালোবাসাটা চাপা পড়ে যায়।কিন্তু প্রথম ভালোবাসার পবিত্রতা আজীবন রয়ে যায়।
তুমি নিজেকে অনেক অসহায় ভেবেছ,আমাকে মেমসাহেব ডেকেছ।কিন্তু তুমি যদি জানতে আমি কোন মেমসাহেব ছিলাম না।অসহায় ছিলাম আমি যে কখনো বলতে পারিনি।ভেবছিলাম তুমি বুঝবে আমার না বলা ভালোবাসার কথা।আচ্ছা এত বোকা কেন তুমি? কেন পড়তে পারো নি আমার চোখের ভাষা?
নতুন বাসায় একদম ভাল্লাগতো না জানো।মুখচোরা আমিই বারান্দায় দাঁড়াতাম,ভাবতাম যদি কখনো এ রাস্তা দিয়ে তুমি যাও আর আমাকে দেখো!কিন্তু তুমি পাওনি খুঁজে।যেদিন বিয়ের প্রস্তাব আসল সেদিন আবার বুঝলাম কতটুকু ভালোবাসি।ছুটে গেলাম সেই পুরনো গলিতে যেখানে তুমি থাকতে।ভেবেছিলাম তুমি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।কিন্তু কৈশোরের প্রেমের মোহ হয়ত তোমার ততদিনে কেটে গিয়েছিল।তাই তো তুমি আমায় কিছুই বলতে পারো নি।
আমি এখন দূর পরবাসে আছি।এখনো বারান্দায় দাঁড়াই অবসর পেলেই।আমি খারাপ নেই।ভালই আছি।জীবনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে আবেগগুলো অনেকটাই ঘরকুনো হয়ে থাকে।
কি অভদ্র আমি,একবারো তোমার কথা জিজ্ঞাসা করলাম না কেমন আছো।তুমি ভালো আছো তো?
তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো চিঠিটা আমি কিভাবে পেলাম।প্রযুক্তির এত প্রসার আজ।আকাশের ঠিকানায় লেখা চিঠিও তরঙে তরঙে ভেসে এসে যায় হাতে।আমি আজ অনেক খুশি।আর আক্ষেপ নেই কারণ আমার প্রথম প্রেম ব্যার্থ হয় নি,আমরা কেও কাউকে পাই নি,চিঠি দেই নি,হাতে হাত রাখিনি তবুও আমাদের ভালোবাসার পবিত্রতা একটুও কমে নি।জানো,আমার ছোট ছেলেটার চোখ না ঠিক তোমার মত।আর তোমার মতই দুষ্ট আর চঞ্চল।
আমি ভালো আছি।তুমি নেই তার আক্ষেপ অতটা হয়ত নেই কিন্তু হ্যা তুমি থাকলে জীবনটা হয়ত অন্যরকম হত।
তুমিও ভালো থেকো।আমাকে এতগুলো বছর মনের মাঝে আগলে রেখেছ যেভাবে ঠিক সেভাবেই রেখো,পাড়ার ভীত হরিণী চোখের মেয়ে হিসেবেই।কোন মেমসাহেব হিসেবে নয়।
তুমি অনেক অনেক ভালো থেকো।অনেক সুখে থেকো।তোমার ও তোমার প্রিয়তমার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা
ইতি
আমাকেও হয়ত চিনো
*****************************************
( সব চরিত্র এখানে কাল্পনিক।প্রথম চিঠিটা আমার বন্ধু আবরারের লেখা।আর প্রতিউত্তর টা লিখেছি আমি।
চিঠির প্রতি আমার সবসময় ভালোলাগা কাজ করে।তাই ওর চিঠি পড়েই নিজে লিখে ফেললাম আর পোস্ট ও করার তর সইল না। :-)
ভালোথাকুক ভালোবাসারা,ভালো থাকুক ভালোলাগারা