somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালিদাস এবং ... - ২

২৯ শে জুন, ২০০৯ ভোর ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
কালিদাস এবং ... - ১



প্রাককথনঃ
মেঘদূত একটি চমৎকার প্রেমের কবিতা। এক যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে বার্তা পাঠায়, যে কিনা এক বছরের জন্য তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রেয়সীর বাস অলকা-নগরীতে। অলকার অবস্থান ছিল সুয়চ্চ হিমালয়ে, গঙ্গার উৎপত্তিস্থল মানস সরোবরের পাশে। প্রাচীন ভারতের যক্ষদের নিয়ে নানান কাহিনী চালু আছে। যক্ষ সম্প্রদায়ের লোকদের কুবের নামে জানা হয়। যক্ষদের নিয়ে অগুণিত পৌরাণিক কাহিনীর একটি হচ্ছে – তারা অত্যন্ত ধনী ছিল। যক্ষের ধনের কথা কে না শুনে থাকবে? সংস্কৃতে কুবের শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ কু (কুৎসিত বা খারাপ) + বের (শরীর) বা কুশ্রী মুখায়ব। রামায়ণ থেকে জানা যায়, মূলত তারা লঙ্কা (অধুনা শ্রীলঙ্কা)-র অধিবাসী ছিল। আদি কুবের ছিল Bisraba এবং Debabarnini-র পুত্র এবং তার নাম ছিল Baisrabana। সে সকল দেব-দেবীর সম্পদ দেখাশোনা করত। সীতাকে অপহরণকারী রাবণের সে ছিল সৎ ভাই। রাম এবং রাবণের মধ্যেকার যুদ্ধের কারণে কুবের তার আদিভূমি ছেড়ে মূলভুমির গভীরে চলে আসে। সুয়চ্চ হিমালয়ের এক জায়গায় সে বসতি গাড়ে। তার বংশধররা প্রাচীন ভারতের সবচে সুন্দর এবং আভিজাত্য মোড়ানো শহর অলকা বা অলকাধামে বাস করতো। অলকার নারীরা তাদের শারীরিক সৌন্দর্য এবং মাধুর্যের জন্য ভূবনবিদিত ছিল। রুপকথার এই শহরের উদ্যানের সৌন্দর্যও অনেক কবির মনযোগ আকর্ষণ করে।

মেঘদূতের বর্ণনাকারী হচ্ছে এক তরুণ কুবের যাকে যক্ষ নামে উপস্থাপন করা হয়। পুরাকথা অনুযায়ী, তরুণ এই যক্ষকে অলাকার অনেক সুন্দর উদ্যানের একটিতে প্রহরীর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সে সম্প্রতি এক অতি সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে করে। দিনের বেলায় যখন তার উদ্যান প্রহরা দেয়ার কথা তখন সে তার প্রিয়ার সাথে মিলিত হবার লোভ সংবরণ করতে পারে না। তার এই নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে প্রেম করার বাসনায় সে কাজে ফাঁকি দেয় এবং তার অনুপস্থিতিতে এক হাতি উদ্যানের কিছু ফুলের গাছ তচনচ করে ফেলে। এই খবর যক্ষের নিয়োগকর্তার কানে পৌছে যায়। বড়রা মিলে তখন সিদ্ধান্ত নেয় যে তরুণ এই যক্ষকে শাস্তিস্বরুপ অলকা থেকে ৬৫০ কি.মি. দূরে রামগিরি পর্বতে (অধুনা রামটেক, উত্তর নাগপুর) এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হবে।

রামগিরি পর্বতে থাকার জন্য যক্ষ এক আশ্রমের সন্ধান পায়। আশ্রমের পাশে একটি লেক ছিল। পুরাকথা অনুযায়ী, সীতা এই লেকের জলে স্নান করে তার জল পুণ্য করে দেয়। ধীরে ধীরে বর্ষাঋতুর আগমনের সময় যক্ষ দেখে যে প্রাসাদোসম এক মেঘের স্তুপ দক্ষিণ থেকে ভেসে ভেসে উত্তরে, যেখানে তার প্রিয়া আছে, সেই অলকার দিকে যাচ্ছে। এই বিশালাকায় বৃষ্টি-মেঘ দেখে হঠাৎ তার মাথায় একটা খেয়াল যায়। সে খুব করে চাইছিল তার প্রিয়ার কাছে কুশলবার্তা পাঠাতে। এখন এই মেঘকে দেখে সে স্থির করে মেঘকে বার্তাবাহক বানানোর। মেঘের কাছে যেয়ে মেঘকে প্রণাম করে আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করে তার বার্তাবাহক হওয়ার জন্য এবং কিভাবে রামগিরি থেকে অলকায় যেতে হবে সে পথ বাতলে দিতে থাকে। এই সমস্ত বর্ণনায় কালিদাসের এই মেঘদূত কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। মেঘকে সে এও বলে দেয় তার প্রিয়ার কাছে পৌছে কি বার্তা দিতে হবে। পুরো ১১৮-টি পংক্তিমালায় প্রাচীন ভারতের নানান ভৌগুলিক স্থানের পুঙ্কানুপুঙ্ক বর্ণনা, লোকজ্ঞান, প্রেমগাথা, বিরহ এবং যক্ষের নির্বাসিত জীবনের নানান আনুষঙ্গিক দিক ফুটে উঠেছে। মেঘদূতের শেষ লাইনে যক্ষ মেঘকে সতর্ক করে দেয় যেন বিদ্যুৎরেখার সাথে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় কারণ প্রিয়ার কাছ থেকে বিচ্ছেদের বেদনা বিরহকাতর যক্ষ ভালো করেই জানে। প্রত্যেকের-ই একজন প্রেয়সী-র প্রয়োজন আছে শিবা-র যেমন পার্বতী তেমনি বজ্রোৎপন্নকারী মেঘেরও আছে বিদ্যুৎ।

বিরহকাতর যক্ষ যখন মেঘদূতকে তার বার্তা দেয়, অলকায় তার প্রেয়সীর কাছে পৌছে দেয়ার জন্য, তখন মেঘকে সে পূর্ণাঙ্গ যাত্রাপথ ও বাতলে দেয়। মেঘ রামগিরি থেকে সোজা উত্তরে যেয়ে অলকায় পৌছাতে পারত, কিন্তু যক্ষ তাকে তা না করে জটিল এক যাত্রাপথের বর্ণনা দেয়। কখনো বা উত্তরে যাওয়ার জন্য বলে, কখনো পূবে আবার কখনো বা উত্তরপূবে। সে চেয়েছিল মেঘ যেন গ্রাম এবং শহরের উপর দিয়ে যায় যাতে লোকজন তাকে দেখতে পারে। সে এও জানত মৌসুমী-বৃষ্টি ছাড়া চাষবাস সম্ভব নয়। মেঘদূত কবিতাটি পূর্ব-মেঘ এবং উত্তর-মেঘ এই দুভাগে বিভক্ত। পূর্ব-মেঘের সম্পূর্ণ ৬৪ স্তবকে মেঘের রামগিরি থেকে সু্যচ্চ হিমালয়ের অলকায় যাওয়ার যাত্রাপথের বর্ণনা আছে। মেঘকে দেয়া কিছু কিছু উপদেশ হাস্যপদ। এক জায়গায় যক্ষ মেঘকে বলে যেন গ্রামবাসীকে ভয় দেখায়। পূর্ব মেঘের স্তবক ১৭, ১৮ এবং ১৯শে আম্রকুট পর্বতের বিশদ বিবরণ আছে। একিভাবে ২৫নং স্তবকে কবি বিদিশা এবং তার রাজধানী দর্শনার বর্ণনা করেন। উত্তাল বেত্রবতী নদীর বিবরণ ও উল্লেখ পাওয়া যায়। স্তবক ২৮ এবং ২৯-এ আমরা প্রাচীন শহর উজ্জয়নী এবং নির্বিন্ধ্যা নদীর বর্ণনা পায়। স্তবক ৩১ থেকে ৩৩ তে কালিদাস রুপকথার শহর অবন্তী-র সুন্দরী রমণীদের প্রাসাদণ আরোপের উপায় বর্ণনা করার সাথে সাথে কিভাবে তাদের দীঘল এবং ঢেউখেলানো চুল সুগন্ধযুক্ত করে তার বর্ণনাও দেন। আমরা শিপ্রা নদীর বর্ণনা ও পায় যার শীতল জল সেইসব রমণীদের প্রশান্তি দেয় যারা তাদের প্রিয়তমের বাহুডোরে রাত্রি যাপন করেছে। অলকা যাওয়ার পথে মেঘদূত যেন দেবগিরি তে শিবা এবং পার্বতীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে না ভুলে যায় যক্ষ সেকথাও মেঘকে বলে দেয়। যক্ষ আরো বলে যে, মেঘ এরপর সিন্ধু নদীর পারে দাসপুরা শহর অতিক্রম করবে। সে কন-খোল পৌছানোর জন্য মহাভারতখ্যাত কুরুক্ষেত্র পার হবে। মেঘদূত নিশ্চিত ভাবে জাহ্নবী-যমুনা যেখানে মিশেছে সেই স্থান অতিক্রম করবে। তার উরন্ত-পথ এরপর তাকে সুয়চ্ছ হিমালয়ের নানান রাজ্যে পৌছানোর আগে নিয়ে যাবে পাহারঘেড়া দেবদারু বনে। সেখানে সে কৈলাস পর্বত এবং মানস সরোবরের আগে ক্রোঞ্ছ পর্বতের দেখা পাবে। মেঘদূত যেন তার শেষ গন্তব্যস্থল অলকায় যাওয়ার আগে মানস সরোবরের পবিত্র জল পান করে তার তৃষ্ণা মেটায়, যক্ষ মেঘকে সেকথাও বলে দেয়।


ছবি ক্রেডিটঃ জনাব জাফর-উল্লাহ্‌

উপরে মেঘের যাত্রাপথের বর্ণনা থেকে একজন ধারণা পায় যে মেঘের যাত্রাটা সোজাসুজি দক্ষিণ থেকে উত্তরে ছিল না। তার আকাঁবাকাঁ পথে, মেঘদূত অনেক রুপকথার শহর পরিভ্রমণ করে। উপরিল্লিখিত মেপে অনেক প্রাচীন শহরের নাম সহজে চিনে নেয়ার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই শহরগুলো এখন বর্তমান ভারতের মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশে। কালিদাস ৬৪ স্তবক লিপিবদ্ধ করেছে মেঘের অদ্ভুত ভ্রমণের বিবরণ দেয়ার জন্য আর বাকী ৫৪ স্তবকে যক্ষের প্রিয়তমার জন্য দেয়া বার্তার বিশদ বিবরণ আছে। এই স্তবকগুলোতে হিমালয়ের শহর অলকার নয়নজুড়ানো সৌন্দর্য, ধণ-সম্পদ, অপরুপা রমণী এবং প্রাসাদের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কপোত-কপোতীদের মিলনের সৌন্দর্যেরও বিশদ বিবরণ আছে। এই বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে যক্ষ তার প্রেয়সী কে যদ্দিন না সে রামগিরি পর্বত থেকে ফিরে না আসছে তদ্দিন ধৈর্য ধরে বাড়িতে থাকতে বলে।

কৃতজ্ঞতাঃ প্রাককথনটি জাফর উল্লাহ্-র মেঘের যাত্রাপাথ নিয়ে লিখিত ইংরেজি প্রবন্ধ থেকে বাংলায় রুপান্তর করা হয়েছে।

কালিদাস এবং ... - ৩
কালিদাস এবং ... - শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১১ ভোর ৬:৫৯
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×