আমার এসএসসি বা এইচএসসি এর পর ভাইয়া আমাকে একটা বই দিয়ে ছিল ত্রয়ী। তাতে একটা গল্প ছিল 'অপত্য' নামে। যার অর্থ সন্তান। সেই নামটা ধার করে নিয়েই গল্পটা শুরু করছি। গল্পটা রাত্রি আর জামানের।
একদমই হঠাৎ করে দুজনের পরিচয়।দুজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পড়ার বিষয় কোনটাই এক না। তবে আগ্রহর জায়গাটা ছিল এক, বই পড়া। সেখান থেকেই শুরু। দুজনের বোঝাপড়াটা হলো খুব ভালো। দু’বছর একজন আরেকজনকে জেনে-বুঝে নিয়ে পারিবারিক সম্মতিতে শুরু হল যুগল চলা। আদর,ভালবাসা,খুনসুটি আর মাঝে মাঝে ঝগড়া করতে করতে কেটে গেল তিন বছর। দু’জনের সংসারটা যখন চার বছরে পা দিবে তখন রাত্রি বুঝতে পারলো ছোট্ট একজোড়া পা আসছে ওদের সাথে পথ চলার জন্য। রাত্রি আর জামানের প্রথম সন্তান। বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সবাই খুশি। এ যে অনেক প্রতীক্ষিত। রাত্রির জন্য জামানের চিন্তার শেষ নেই। কারন ইতিমধ্যে হবু মা’র কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে । তার সাথে আছে সামনের দিনগুলো নির্বিগনে কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের চিন্তা। হাজার হলেও মধ্যবিত্তের সংসার তো। তবু দুজন খুশি কারন ওরা বিশ্বাস করে সবসময়ের মত এবারও দু’জন মিলে সব ঠিক করে ফেলবে।
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল। এ তিন মাসে রাত্রি একটু একটু করে মা হয়ে উঠল। সময় পেলেই অনাগত সন্তানের সাথে কথা বল, বারবার পেটে হাত দিয়ে দেখা কিছু বোঝা যায় কিনা, হার্টবিট শোনা যায় কি না। যদিও জানে এত তাড়াতাড়ি এগুলো বোঝা যায় না। তবু...। আর একটু একটু রাগ হয় জামানের ওপর। ওর মধ্যে যে কোন বাবা ভাব দেখা যাচ্ছে না তাই। প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রাম করার সময় দুজনের চিন্তার শেষ নেই। যদি ঠিক মত হার্টবিট না পাওয়া যায় তখন। ডাক্তার দুজনকে অপক্ষা করতে বলে কিছুক্ষনের মধ্যেই রিপোর্ট দিয়ে দিল। কী আশ্চর্য!! ছোট্ট পুতির মালার মত এই তো দেখা যাচ্ছে । হার্টবিট ও তো গুনে দিয়েছে ডাক্তার। দু’জনে বারবার দেখতে লাগলো সাদা-কালো ছবিটা। এই প্রথম জামানের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেল রাত্রি। এখন যে জামান তার বাবুটাকে দেখতে পেয়েছে, হোক সে যতই ছোট্ট।
দেয়ালে বড় একটা বাবুর ছবি লাগিয়েছে রাত্রি। বাবুর নানুভাই গিফট করেছে। ও প্রতিদিন ছবিটা দেখে আর ভাবে ওর বাবুটা নিশ্চই এর চেয়েও কিউট হবে। সবকিছু ভালোই চলছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন অফিসে গিয়ে রাত্রি অসুস্থ হয়ে গেল। সাথে সাথে জামান ওকে অফিস থেকে বাসায় নিয়ে আসলো। সেদিনই দুজন গেলো ডাক্তারের কাছে। সব শুনে ডাক্তার ওকে দশ দিন পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিল। রাত্রি ওর বাবার বাসায় থাকা শুরু করল। সারাদিন বাসায় শুয়ে-শুয়ে ও বাবুটার সাথে কথা বলে আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাতে ওর বাবুটা ভালো থাকে। ৩/৪ দিন হলো রাত্রি বিশ্রামে কিন্তু হঠাৎ করেই অবস্থার অবনতি। প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য যাত্রা। জামানও আজ বাসায় নেই। খবর পেয়ে ও সরাসরি আসছে হসপিটালে।
হসপিটালে পৌছাতেই গেটের সামনে জামানের উদ্বিগ্ন মুখ। রাত্রির শুধু একটাই চিন্তা যা হয় হোক ওদের বাবুটা যাতে ভালো থাকে। কেবিনে পৌছতে পৌছতেই প্রচন্ড ব্যাথায় রাত্রির সব অন্ধকার হয়ে গেল। ও যেন কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছে না। অনেক অনেক রক্ত আর ভেতর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসার চেষ্টা। একটা কাশির দমকে কী যেন বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে।চেতন-অবচেতনের ঘোরের মধ্যে শুধু শুনতে পেল ওর মায়ের চিৎকার করে উঠা ‘সব শেষ’। রাত্রি তখন কিছুই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে আশেপাশে। শুধু ভেতরে একটা শুন্যতার অনুভূতি। সবাই আসছে-যাচ্ছে। এর মধ্যে কে যেন বলে উঠল ছেলে বাবু ছিল।কে ছিল তাতে কি এখন আর কিছু যায় আসে। সব তো শেষ।
বেশ রাতে হসপিটালের রুমে জামান আর রাত্রি কিছু সময়ের জন্য একা। জামান রাত্রিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। রাত্রি শুধু বলতে পারল -সরি আমি আমদের বাবুটাকে রাখতে পারলাম না।এত সময় পর জামানের ভেতরে বাঁধটাও ভেঙ্গে গেল।ও বারবার রাত্রিকে এই বলে স্বান্তনা দিতে লাগলো তুমি সুস্থ আছ তাতেই হবে। কিন্তু মা’র মন এই কথা মানতে চায় না। সে এটাই ভাবে সব কিছুর বিনিময়ে বাবুটা থাকত। সবাই মিলে ঠিক করল বাবুটাকে কবর দেওয়া হবে কিন্তু কোন জানাযা হবে না। কারণ ও তো কাদেঁনি। সারারাত রাত্রি জেগে থাকলো।শুধু এইভেবে যে শেষবারের মত একটা রাততো ও ওর সন্তানের সাথে কাটাতে পারবে। সবাই বাবুটাকে দেখছে শুধু রাত্রি ছাড়া। ওর মনে প্রথম সন্তানের যে ছবিটা আছে সেটা ও নষ্ট হতে দিতে চায়নি। জামান দেখেছে। একজন বাবা তার প্রথম সন্তানের হাসি মুখ দেখতে পায়নি। এই কষ্ট সে কাউকে বোঝাতে পারবে না।নিজের কষ্টটা রাত্রি ছাড়া কাউকে সে বুঝতেও দেয়নি। আর একটা মানুষ যে হাউমাউ করে কেদেঁছে সে রাত্রি বাবা। পরদিন সকালে বাবুটাকে তিনিই নিয়ে যান মিরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্তানে।
একটা রাতের কয়েক ঘন্টার মধ্যে দু’টো মানুষের দেখা এতদিনের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরে শেষ হয়ে গেল।রাত্রি আটকে গেল ২৭ মার্চের রাতে। রাতগুলো ওর যেন কাটতেই চাইছিল না। তবু জীবন থেমে থাকে না। ফিরতে হয় স্বাভাবিক জীবনে। তবু যখনই মনে পড়ে, তখনই বুকের ভেতর প্রচন্দ হাহাকারে রাত্রির দুচোখে প্লাবন নামে। বের করে দেখে সেই আলট্রাসনোগ্রামের ছবিটা।কোন কোন রাতে জামানও কেমন যেন হয়ে যায়। ঠুকরে কেঁদে উঠে।
এই সীমাহীন ভালোবাসার জন্যই আসলে বাবা-মা সন্তানের জন্য সব করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা যখন একটা শিশুকে কোন মায়ের গর্ভে পাঠায় তখন থেকেই একটা মেয়ে যেন মা হয়ে যায়। যে সন্তান পূর্নাঙ্গ হয়ে মায়ের কোলেও আসল না, তবু তার জন্য এত মায়া,এত ভালোবাসা কোথা থেকে আসে। এখনও রাত্রি ওর ছেলেটার সাথে কথা বলে। মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করে ওর ব্যর্থতার জন্য।