somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে

০৩ রা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বইঃ ছবির দেশে কবিতার দেশে
লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কে যেন একবার বলেছিলেন, প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি। একটি, যেখানে যে জন্মেছে; অন্যটি হল, ফ্রান্স । শিল্পী বলতে এখানে শুধুই.চিত্রকরদের কথা বলা হয়নি, কবিরাও নিশ্চিত এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এই ফরাসিদেশেই যেমন ছিলেন দেগা, মোনে, মানে, রেনোয়া, গগ্যাঁ, মাতিস, রুয়ো কি পিকাসোর মতন মহান শিল্পীরা।

তেমনি এই দেশ র‍্যাঁবো ভেলেন, বদলেয়ার, মালার্মে, ভালেরি, অ্যাপোলিনিয়ার আর আঁরি মিসোর মতন কবিদেরও । ফরাসীদেশই তাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যার আত্মার বর্ণনায় এসে যেতে বাধ্য, ছবির দেশ ও কবিতার দেশ।

কবি ও শিল্পীদের এই অমরাবতীতে একবার নয়, বারবার গিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর পাঁচবারের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এই বই। সাধারণ ভ্রমণকাহিনীর থেকে এ-রচনার স্বাদ একেবারে আলাদা । নিছক ঘোরাফেরা আর দেখাশোনার মামুলী বৃত্তান্ত নয় এই বই। পুরো ফরাসীদেশটাকেই যেন খুঁড়ে-খুঁড়ে দেখা । তার শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ।

শুধু এই শতকেই নয়, গত শতকেও। বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন চিত্রশিল্পী ও কবিরা পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন নানান সৃষ্টিশীল আন্দোলনে। স্বাভাবিকভাবেই এ-ভ্রমণকাহিনীতে এসে পড়েছে মাগারিট নামে সেই ফরাসী বান্ধবীটির কথাও, প্রথমবার আমেরিকা প্রবাসকালে যার সাহচর্য ফরাসীদেশকে গভীরভাবে জানতে সাহায্য করেছিল।

মাগারিটকে নিয়ে বহু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্তু এই প্রথম মাগারিটের সঙ্গে তাঁর গভীর অন্তরঙ্গতার আনুপূর্ব কাহিনী অকপটে বর্ণনা করলেন তিনি। এই ভ্রমণকাহিনীতে তাই টুকরো আত্মজীবনীরও স্বাদ । আর মার্গারেটের সূত্রেই এই ভ্রমণকাহিনীতে এসেছে আমেরিকার বিটবংশ ও গ্রিনিচ গ্রামের কবিদের সঙ্গে তুমুল আড্ডার স্মৃতি ।


কাহিনি সংক্ষেপঃ
ষাটের দশকে প্রচন্ড অভাবে দিন কাটছে ভবঘুরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। হঠাৎ তিনি পল এঙ্গেলের মাধ্যমে আয়ওয়া নামক এক আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের অফার পান সাথে থাকা খাওয়া এবং টিকেটের টাকা। অভাবে থাকলেও বন্ধুদের সাহায্যে আমেরিকা যান লেখক। সেখান মার্গারিট নামে ফরাসী এক অনিন্দ্য সুন্দরী সাহিত্য প্রিয় তরুনীর সাথে পরিচয় হয়, তার কাছ থেকেই ফ্রান্স, ফ্রান্সের সাহিত্য, ইতিহাস, কবিতা, কবি, চিত্রকর, সমালোচক এবং মহান মহান সৃষ্টি  সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। মার্গারিট সুনীলকে ফরাসি কবিতা শব্দ ভেঙ্গে ভেঙ্গে শিখিয়েছেন আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন গীয়ম অ্যাপেলিয়নের মতো অসংখ্য কবির কবিতা।

এর মধ্যে মার্গারিটের মা অসুস্থ হয়ে পড়লে মার্গারিট ফ্রান্সে চলে যান। লেখকের আমেরিকায় স্থায়ী থাকার সুযোগ থাকলেও বাংলা ভাষা ভালোবেসে বাংলায় কিছু করতে চেয়ে দেশে ফিরে আসেন। আসার পথে ফ্রান্সে ঘুরতে যান সেখানে আবার মার্গারিটের সাথে দেখা হয়। দুজনে ফ্যান্সের অলিগলি, স্যাতো, মিউজিয়াম, ক্যাফে, নদী, পার্ক চষে বেড়ান। তাদের সম্পর্ক আরো গাড় হতে থাকে একপর্যায়ে প্রণয়ে পরিনত হয়।

কিন্তু কতোদিন এ ভবঘুরে জীবন? সুনীলের দেশে ফেরা,  বাংলায় কিছু করার তারনা আর মার্গারিটের আমেরিকার রিচার্স দুজনকে আলাদা করে দেয়। এয়ারপোর্টে দুজন আলাদা হয়ে যায়, চলে যায় দুজন দুইদিকে। কথা ছিল দুজন যোগাযোগ রাখবে, সম্পর্ক রাখবে কিন্তু শেষ পর্যোন্ত কি দুজন যোগাযোগ রেখেছিল? সুনীল এরপরে বহুবার ইউরোপ ভ্রমন করেছেন। যাওয়া বা আসার পথে প্রতিবার শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী প্যারিসে ঘুরে এসেছেন সে ভ্রমনের বর্ননাও বইটিতে আছে।

প্যারিসের একটি কাফে গেরবোয়া এখানে বিকেল হলেই আড্ডা হতো কবি, শিল্পী, সমালোচকদের। এখানে যেমন আসতেন কবিতার প্রবাদপুরুষ বোদলেয়ার তেমনি আসতেন পল সেজান, এমিল জোলা, পিসারো, রেনোয়া, ক্লদ মোনে আরো অনেকে। বইটির প্রতিটা অধ্যায়ের প্রথমে বিখ্যাত কবিদের একটা করে অসাধারণ কবিতা আছে কবিতাগুলো যে অসাধারণ তা বলাই বাহুল্য।

মতামতঃ
প্রথমে বলে রাখি সুনীলের পূর্বপুরুষের বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই অর্থ্যাৎ মাদারীপুরের মাইচপাড়া গ্রামে যেটা সুনীল তার এই বইতে নিজেই বলেছেন(অনেকে জানে ফরিদপুর)। নিজের এলাকার লেখক হওয়াতে সুনীলের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা আছে।

এখন বইয়ের প্রসঙ্গে আসি, এই বইয়ের কথা উঠলে আমি বলবো আমার পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে একটা, এই বইটা সম্পর্কে যতো বলবো ততো কম হয়ে যাবে। কিছু বই আছে যার রেশ সারাজীবন কাটেনা অন্তরে গেথে থাকে এই বইটাও তেমনি একটা বই।

সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম আর সুনীলের মার্গারিটকে আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। সুনীলের লেখনশৈলী অসাধারণ। এটা যেমন একটা ভ্রমন কাহিনি তেমনি একটা প্রেমের উপন্যাস আবার সাথে ফরাসি শিল্প সাহিত্য নিয়ে চমৎকার তথ্যনির্ভর বই। 

বইটি পড়ার সময় মনে হয়েছে আমি সুনীলের সাথে আছি তার চোখ দিয়ে আমি দেখছি প্যারিসের বিখ্যাত লুভ্যর মিউজিয়াম, স্যাতো, পার্ক,নদী, প্যারিসের রাস্তার অলিগলি। সুনীল এবং মার্গারিটের সাথে ঘুরেছি পুরো প্যারিস। তাদের সুখ দুঃখ যেন আমার নিজের। টাকার অভাবে সস্তা রাস্তার খাবার খাওয়া আবার রাতে ধার করে টাকা এনে স্যাম্পেইন খেয়ে কবিতা পড়া কিংবা মহান স্রষ্টা বা সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করা সবকিছুতেই মনে হয়েছে আমি তাদের সাথে আছি তাদের সাথে কষ্ট করছি এবং এনজয় করছি। রাতের পরে রাত দিনের পরে দিন সস্তা খাবার খেয়ে অস্থায়ী ঠিকানায় থেকে প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। মার্গারিটের থেকে শুনেছি র‍্যাবোর সাহিত্য প্রতিভা ১৮ বছর বয়সে তার সৃষ্টি, গীয়ম আপোলিনেয়ারের কবিতা, ইম্প্রেশিনিজন সম্পর্কে।

সুনীলের বর্ননাভঙ্গি অসাধারণ এটা আগেই বলেছি তার সহজ স্বাভাবিক বর্ননা মুগ্ধ করেছে। বইটি পড়ার পরে ভালো লাগা এবং খারাপ লাগা দুটো অনুভূতিই কাজ করেছিল কোথায় যেন কিছু নেই নেই মনে হয়েছিল। এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম কয়েকদিন।

আমার স্বপ্নের শহর ছিল নিউ ইয়র্ক কিন্তু বইটি পড়ার পরে এখন আমার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু প্যারিসকে ঘিরে, স্বপ্ন দেখি প্যারিসকে নিয়ে। জীবনে যদি কখনো কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় তবে আমি প্যারিসে যেতে চাই ফিল করতে চাই শিল্প সংস্কৃতি কাব্য আর প্রেমের শহরকে।

আমার প্রিয় ব্যাক্তিদের মধ্যে ভিনসেণ্ট ভ্যান গগ একজন, তার শেষ জীবন কেটেছে প্যারিসে। গগের কবরও প্যারিসে, কখনো প্যারিসে যেতে পারলে গগের কবরের সামনে দুইমিনিট দাড়িয়ে থেকে তার কষ্ট উপলব্ধি করতে চাই।  হাজার হাজার কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকরদের মহান মহান সৃষ্টি দেখতে চাই। অগনিত শিল্পীর প্রিয় শহর ছিল প্যারিস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নির্দেশ ছিল প্যারিসে বোমা ফেলা যাবেনা।

ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি সুনীলের আত্মজীবনীও।
যারা কবিতা, সাহিত্য, ভ্রমন পছন্দ করেন তাদের জন্য মাস্টরিট, হ্যাপি রিডিং।

‌‌‌ মার্গারিট ম্যাতিউ

১ম ছবি- আমার তোলা
২য় ছবি- বই থেকে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১:৩২
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×