কল্পনা সরোজ, জন্ম ভারতের নিম্নবর্ণের দলিত পরিবারে। ছোটবেলায় সবাই যখন তাকে অস্পৃশ্য হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, তখন মনে প্রশ্ন জাগত তিনি আদৌও মানুষ তো?
সমাজের বৈষম্য, দারিদ্র, বাল্যবিয়ে, শারীরিক নিপীড়ন—সব কিছুতে হতাশ কল্পনা একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানোর পণ করেন তিনি। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি এখন ভারতের বড় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
শূন্য থেকে যার শুরু, তিনি কীভাবে এতোটা পথ পাড়ি দিলেন—সেই গল্প অনেকটা বলিউডি ছবির কাহিনীর মতো। এই কাহিনীতে নায়ক বা নায়িকা যেমন জীবনে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিজয়ের শেষ হাসিটা হাসেন, কল্পনা সরোজের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।
ছোটবেলার বৈষ্যমের কথা বলতে গিয়ে ৫২ বছর বয়সী কল্পনা সরোজ বিবিসি অনলাইনকে বলছিলেন, ‘আমরা অনেক বন্ধুর বাবা-মা আমাকে তাদের বাড়িতে ঢুকতে দিত না। এমন কি স্কুলের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অনুমতিও আমি পেতাম না। কারণ আমি দলিত। আমার তখন ভীষণ রাগ হতো। আমি অসহায় বোধ করতাম। মনে হতো আমি মানুষ তো!’
স্কুল জীবনের ইতি টেনে মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হন কল্পনা। তার চেয়ে ১০ বছরের বড় স্বামীর সঙ্গে চলে যান মুম্বাইতে। সেখানকার এক বস্তিতে শুরু করেন নতুন জীবন। তবে সে জীবন সুখের হয়নি। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তাঁর স্বামীর বড় ভাই ও তাঁর স্ত্রী কল্পনাকে বেদম মারধর ও অকথ্য গালিগালাজ করতেন। বাবার সহযোগিতায় তিনি স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসেন।
এই নিয়ে মানুষের বাঁকা কথা চলছিলই। তবে সেগুলো গ্রাহ্য না করে সেলাইয়ের কাজ শিখতে শুরু করেন তিনি। তবে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করতে না পেরে হতাশ কল্পনা একদিন আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। কিন্তু লোকজনের বাধার মুখে তাঁর কীটনাশক পানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। পরে সিদ্ধান্ত নেন ভালোভাবে বাঁচার, ভালো কিছু করার।
১৬ বছর বয়সে কল্পনা মুম্বাই গিয়ে কাপড় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। তখন তাঁর আয় মাসে মার্কিন মুদ্রায় এক ডলারেও কম। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি পোশাক কারখানার সেলাই মেশিন চালানো শেখেন তিনি। এর আয় কিছুটা বাড়ে। তবে সেই আয় দিয়ে কোনোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা যায়, এর বেশি কিছু করা যায় না। তাই নিজের বোন যখন অসুস্থ হলেন এই স্বল্প আয় দিয়ে তাঁর চিকিত্সা করাতে পারেনি কল্পনা। প্রায় বিনা চিকিত্সায় বোন মারা যাওয়ার পর কল্পনার মনে হয়, অর্থ জীবনের একটি বড় বিষয়। তখনই আরও অর্থ উপার্জনের জেদটা ভেতরে ঢুকে।
এরপর সরকারি ঋণ নিয়ে কল্পনা আসবাবপত্রের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি চলছিল কাপড় সেলাইয়ের কাজ, সেটাকেও বাড়াতে থাকেন। তখন দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতেন বলে জানালেন তিনি। আসবাবপত্রের এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন কল্পনা। তাঁদের দুটি সন্তান আছে।
পরিশ্রমী কল্পনার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশেও। ডাক পড়ে ঋণে জর্জরিত কামানি টিউব নামের একটি ধাতব কৌশল কোম্পানির হাল ধরার। দায়িত্ব নিয়ে কারখানাটি ঢেলে সাজান কল্পনা। সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এখানে যারা কাজ করেন, তাঁদের ন্যায্যটা দিতে চেয়েছি। পরিবারের মুখে খাবার দেওয়ার জন্য যারা উন্মুখ, সেসব মানুষদের এই কারখানার সঙ্গে যুক্ত করেছি। এতেই কাজ হয়েছে। কর্মীরা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করেছে। এখন কামানি টিউবের সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি ডলারেও বেশি। ব্যবসা আরও বিকশিত হচ্ছে।
এই প্রতিষ্ঠানে এখন সব শ্রেণী-বর্ণের শত শত কর্মী কাজ করেন। তিনি দেখা করেছেন ভারতের শীর্ষস্থনীয় ব্যবসায়ী রতন টাটা ও মুকেশ আম্বানির সঙ্গে। ব্যবসায়িক উদ্যোগের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৬ সালে পুরস্কারও পেয়েছেন।
এতে দূর এসে কল্পনা তাঁর অতীত ভুলে যাননি। তাই নিয়মিত গ্রামে যান। চেষ্টা করেন নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কিছু করতে। কল্পনা বিশ্বাস করেন, কেউ যদি তার সবটুকু দিয়ে কাজ করেন এবং তা চালিয়ে যান, একসময় তিনি সফল হবেই। এটাই তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র।
সূএ: প্রথম আলো

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




