অন্ধকারে কি যেন পড়ে গেল। ঝন ঝন একটা আওয়াজ হল।কি পরে গেল আজকে আর দেখতে ইচ্ছে হল না, আমার প্রিয় সোপিসটা ভেঙ্গে গেল কিনা বা গত বছর আমার জন্মদিনে অনু যে আমাকে ঘড়ি দিয়ে ছিল সেটা ভেঙ্গে গেল কিনা। আজ আমার সমস্ত ইচ্ছা শক্তি যেন মুহূতের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আজ আর মন খারাপ করা বা কারোর সাথে অভিমান করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি আজ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি ওখান থেকে ঝকমকে আলোতে আসার কোন ইচ্ছে নেই। আজ সব কিছুই আমার কাছে বৃথা। আমি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে হেরে গিয়েছি। আজকে আর কাউকে আসি অথবা ভালোথেক এই শব্দ গুলো বলার ইচ্ছা নেই। আমি নীরবে এই অর্থহীন জীবনটা শেষ করতে চাই।
অনু আমার ভালবাসা। আমরা একে অপরকে প্রচন্ড রকম ভালবেসেছি। আজ আমার ভালবাসার বিয়ে। আজ এই রাতে আমাদের ভালবাসা কেবল অতীত হতে চলেছে। অনু আর আমি কত জায়গায় ঘুরেছি,সিনেমা দেখেছি। আমার আর অনুর মধ্যে একটা মাএ অমিল ছিল সেটা হল আমি সব কিছুতে নীরব থাকতে পছন্দ করতাম আর অনু সব কিছুতে বেশী কথা বলত। আজ অত কিছু মনে পড়ছে। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে গতকাল বলা অনুর কথা গুলো। সে অনেক আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি তাকে ধরে রাখার দুঃসাহস করতে পারিনি। তার শেষ কথা গুলো আমার কানে বারবার কানে বাজছে।
"তোমার মত কাপুরুষ প্রেমিকের বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভাল।"
আসলেই ত আমার ত বেঁচে থাকার কোন অধিকার নাই। যে তার প্রেমিকার ভালবাসার মূল্য দিতে জানেনা তার বাচাঁর কি অধিকার।
বাবা-মায়ের কত আশা ছিল আমাকে নিয়ে আমি তাদের কোন আশা পূরন করতে পারিনি। আজ জীবনের এই প্রান্তে এসে অতীতের কত কথাই না মনে পড়তে লাগল। বাবা আমাকে নিয়ে বাজারে নিয়ে যখন বাজারে যেত তখন আমাকে গরম গরম জিলাপী কিনে দিত। আমি জিলাপী খেতে পছন্দ করতাম তাই। আমাদের পরিবার সবসময় অভাব অনটন লেগে থাকত। কিন্তু আমাকে কোন দিন বাবা অভাব বুঝতে দেয়নি। শত অভাব সত্তেও আমার সকল আবদার পূরন করত। একদিন এর ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। আমি তখন নয় কি দশ বছরের হব। বাবার সাথে ফুফুর বাড়ী থেকে ফিরার পথে একটা মিষ্টির দোকান দেখে বললাম-
"বাবা মিষ্টি খাব।"
বাবা মনে মনে কি যেন চিন্তা করলেন।
বললেন -"ঠিক আছে চল"
আমি আর বাবা দুটি করে মিষ্টি খেলাম। খাওয়া শেষে বাবা যখন দাম দিতে গেল দোকানদার বলল ১২০ টাকা হইছে। বাবাকে কিছুটা অসহায় লাগল। পরে বুঝতে পেরে ছিলাম যে বাবার পকেটে এত টাকা নেই। বাবা বলল
-"চারটা মিষ্টির দাম ১২০টাকা"
দোকানদার বলল এগুলার কেজি ৫০০টাকা। বাবা বলল
-আমার কাছে ত এত টাকা নাই। দোকানদার বলল
-মিয়া মিষ্টি খাবেন টাকা নাই পকেটে যত সব। বাবা বলল
-ভাই আমার কাছে ১১০টাকা আছে আমি আপনাকে ১০০টাকা দিয়া যাই পরে এসে ২০টাকা দিয়ে যাব।
দোকানদার বিরক্তিকর ভাবে বলল
-১১০টাকা আছে পুরাটাই দিয়া যান। পরে যে আর আইবেন না এইটা জানি।
বাবা কিছুই বলল না পুরো টাকাটা দিয়ে দিল।বাবা আমার হাত ধরে বাইরে এসে শুধু একটু করুন ভাবে হেসে বলল "চল বাড়ী যাই"। বাবার মুখ দেখে আমার খুব মায়া হল।আমার এই ছোট্ট হাত দিয়ে যদি আমি বাবাকে সাহায্য করতে পারতাম। আমি আজও চোখ বন্ধ করলে বাবার সেই করুন হাসি মুখ দেখতে পাই। বাবা সেদিন ৫মাইল রাস্তা আমাকে কোলে করে হেটে এসেছিল।
আর আমার মা। আমার মা পৃথীবির শ্রেষ্ট মা। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর কত কষ্ট করে যে আমাদের কে লেখাপড়ার খরচ জোগিয়েছেন তা একমাএ আল্লাপাকই বলতে পারবেন। আমি দেখেছি আমাদের কে না খাইয়ে মা কখনো খায়নি। মা সকল বিপদে আল্লার উপর ভরসা রাখেন। মা কোন কিছুতে হতাশ নন। মা সবসময় বলেন "আল্লার উপর ভরসা রাখ, আল্লাহ পাক যা করেন ভালর জন্যই করেন"। আমি মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলতাম "আল্লাহ আমাদের উপর কোন কাজটা ভাল করেছে"। মা আমার দিকে এমন একটা দৃষ্টিতে তাকাত যে ঐ দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি কেন এই পৃথীবির কারোর কিছু বলার ক্ষমতা নেই। মা শুধু বলত "আল্লার উপর ভরসা রাখ।" আজকে আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে।
আমার মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে। এখনি হয়ত ঘুমিয়ে যাব আর এই ঘুম থেকে উঠতে পারবনা। হয়ত মা আমাকে আর কোন দিন এই ঘুম থেকে ডেকে উঠাতে পারবে না। শেষ বারের মত মার সাথে এক বার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি মোবাইলটা বের করে মাকে কল দিলাম। মা প্রথম কলে ফোনটা রিসিভ করল।
-কিরে তুই এখনও ঘুমাসনি।
-মা তুমি কি এখনও জেগে আছ।
-মাহির ত কাল রেজাল্ট দিবে তাই তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য উঠছি। আর তোর গলাটা এমন ভারী শোনাচ্ছে কেন,এখনও ঘুমাসনি।
-না মা আমি ঘুমিয়ে গেলে ত আর উঠব না। আমি তোমাকে একটি কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।
- ঘুম থেকে উঠবি না মানে কি। আর সকাল বেলা ফোন দিয়ে কথা বলা যেত না।
- মা আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালবাসি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
ফোনটা কেটে গেল।আমি জানি আজকে মা সারা রাত নামায পড়বে আর কালকে রোজা রাখবে। আমার রেজাল্ট দেওয়ার সময় ও মা তাই করত। মা হয়ত এখন আমার ব্যাপারে চিন্তা করবে।
আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। আর কোন কিছু চিন্তা করতে পারছি না। মাথাটা একেবারে পাথরের মত হয়ে আছে। তবু ঘুম পাচ্ছে না। আর ঘুমিয়ে গেলে ত আর উঠব না এই হয়ত শেষ।
শেষ কিছু কথা মনে পড়ছে। আমার ছোট ভাই মাহি এবার এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। তার রেজাল্ট দিবে কালকে। জানি সে ভাল রেজাল্ট করবে। সে কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিল "ভাইয়া আমাকে একটা কম্পিউটার কিনে দিও।" আমি তাকে কথা দিয়ে ছিলাম
"তুই এ প্লাস পেলে তোকে কম্পিউটার কিনে দিব।"
আর কিছুক্ষনের মধ্যে অতল ঘুমে তলিয়ে যাব। আমি আমার বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি আমার ভালবাসা অনুর জন্য কিছু করতে পারিনি। তাই বলে কি আমি আমার মার জন্য কিছু করতে পারব না, আমার ভাই এর স্বপ্ন পূরন করতে তাকে সাহায্য করতে পারব না। না আমি এই ভাবে এই পৃথীবি ছেড়ে যেতে পারিনা। আমাকে বাচতে হবে। আমার ছোট ভাইকে কম্পিউটার কিনে দিতে হবে।তার স্বপ্ন পূরন করতে তাকে সাহায্য করতে হবে। আজ আমার মার মত আমারও আশা করতে ইচ্ছে করছে।
আসলে মানুষ এই ভাবেই বেঁচে থাকে।একটা কিছু হারিয়ে গেলে আরেকটা কিছু ধরে বাঁচতে চায়। এই ত জীবন , এটাই ত জীবনের রীতি।