অর্থাৎ, সে কেনো এখনো পড়ে, টাকা-পয়সা কামায় না কেনো, সংসারেও কিছু দেয় না কোনো— তাই তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে । পরে ছেলেটা মাজারে মাজারে ঘুমিয়েছে । তারপর নানান জায়গার হ্যাপা সইতে সইতে ‘রকস্টারের মতো’ এখন সে সাকসেস ।
—কেমন সাকসেস ?
—এখন সে ধরেন, গত মাসে তার দ্বিতীয় নম্বর ফ্লাটটা কিনেছে ।
—বাহ, চমৎকার। এখন সে বাবা-মাকে সেই ফ্লাটে রাখবে । জীবনের সব সফলতা সে পেয়ে গেছে, তাই না ।
—বাবা-মাকে ফ্লাটে রাখবে মানে ? সেটা তো বলি নাই ।
—না বলছো, তাতে কি, ধরে নিলাম ।”
ইদানিং এই রকম ওয়াজ আর কাহন-কাহিনীর যেনো কোনো শেষ নেই । এটা করো, সেটা করো, তাইলেই সাকসেস । ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করো, তারপর অনেক টাকা কামাও, বড় ব্র্যান্ড, বড় জাহাজ-বাড়ির মালিক হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, স্বনির্ভর হও, হওয়া সম্ভব তোমার পক্ষে, তাইলে তুমি সাকসেস !
সাকসেসনেসটা নিয়ে বেজায় ধন্দে পড়ে গেছি আজকাল । গ্রামের একজন সৎ স্কুল টিচার হয়ে থেকেছেন যিনি সারাজীবন কিংবা কেবল ব্যাংকের পিয়ন পদে চাকরি করে নিজের ছয় মেয়েকে সৎপাত্রে প্রদান করেছেন— তারা কি সাকসেস নন?
ওই যে, রংপুরের পীরগাছায় দেখেছি, পুরাতন রাজবাড়ির পাশে একটা ছোট্ট মসজিদে নিভৃতে বিশুদ্ধ কোরআন শেখাচ্ছেন যিনি সযত্নে, তিনি কি সাকসেস নন ?
কিংবা সেই যে বিদেশি ছেলেটা বাংলাদেশে এসে একটা ছোট্ট হাসপাতাল গড়েছে, তারপর বিদেশের আয়েশি জীবন ছেড়ে মানুষের সেবাতেই কাটিয়ে দিচ্ছে সময় । ‘ইত্যাদি’তে না দেখালে আমরা তাকে চিনতামও না । সে কি সাকসেস নয় ?
এমন অসংখ্য অগণন উদাহরণ আছে, যারা প্রচারবিহীন, অর্থবিত্তবৈভববিহীন নির্মোহ নির্লোভ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন হয়তো শিখিয়ে শিখিয়ে, নয়তো লিখে লিখে, অথবা জনসাধারণের সেবা করে করে । ‘আল-গিরাস’ নামে একটা বইতে পড়েছিলাম, ‘মু’তামার আল-ইসলামি’ টাইপ একটা বিশ্বজনীন সেবা সংস্থার জন্ম দিয়েছেন যিনি, তিনি সংস্থাটির ‘রইস’-এর পদটাও নেন নি । বরং রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অজস্র খেজুর গাছের খেজুর যে প্রতিবছর নষ্ট হয়, তা বিক্রি করে গরিবের সেবায় অর্থটা বিলিয়ে দেবার চিন্তাটা তিনি জাগিয়ে একটা বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন । অথচ তাকে মানুষ চেনেও না । তিনি এখনও একটি মসজিদের ইমামমাত্র। তো ? সাকসেসটা আসলে কোথায় ?
সাকসেস কোথায়, আপনি যদি কোরআনের বর্ণনাটা শোনেন, তাহলে আপনি মনে হয় আমাকে সেকেলেই ভেবে বসবেন ।
তবু বলি— فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ
“যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে— সে-ই সাকসেস ।” (৩ : ১৮৫)
অবাক ব্যাপার ! এ আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে— “তোমাদের পূর্ণ বদলা দেয়া হবে সেদিন ।” আর শেষাংশে এসেছে— “পার্থিব জীবন কেবলই ধোঁকার উপকরণ ।”
কোনো চরমপন্থার কথা বলছি না । হয়তো এরও কোনো গূঢ় ও দুনিয়াবি টেকনিক্যাল অর্থ থাকতেও পারে । কিন্তু যাদের কাছে, এ জীবনই একমাত্র জীবন, যার নিজের জীবনটাই একমাত্র আরাধ্য, এ জীবনের সাকসেসের মোহে যাদের ও-জীবন ভুল হয়ে যায় হরহামেশাই । এই সাকসেসের তোড়ে যাদের ওই সাকসেস হয়ে যায় “হুমম, তা তো ঠিক” এমনতরো বিষয়— তাদের সাকসেসের পথ দেখাবে কোন নাবিক ?
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নাইকো আর
সাতসমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ-ফেন ভার
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩১