আরবি ভাষা ইসলামি ভাষা—এই যুক্তি দেখিয়ে যারা অন্য ভাষাকে হেয় করতে চান, তাদের জানা উচিত, পৃথিবীর ১৫০ কোটি মুসলমানের মধ্যে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের নিত্যদিনের ভাষা আরবি নয় । পৃথিবীর বহু ভাষা মুসলমানদের হাতে গড়ে উঠেছে, লালিত হয়েছে, ইসলাম-চর্চা বহু ক্ষেত্রে আরবিকেও ছাড়িয়ে গেছে ।
কোনো ভাষাতেই ভিন্ন ভাষার শব্দ থাকে না, বরং প্রবেশ করতে হলে ভাষার এটিকেট মেনে সেই ভাষার আপন হয়েই প্রবেশ করতে হয় । এটা চাইলেই কোটা দিয়ে পূরণ করা বিষয় নয় । নজরুল-ফরুরুখ-মুজতবা আলী-মঈনুস সুলতান প্রমুখের রচনায় হাজারো আরবি-ফার্সি শব্দের বাংলায়ন লক্ষ করুন—আপনার কি সেগুলো ভাষার বিকৃতি মনে হয়, নাকি মাতৃভাষার মতোই পাঠে আরাম হয় ?
ইসলামি ভাষা কী কী, কেউ কি বলতে পারবেন ?
একশ্রেণিকে দেখি, নামাজ না লিখে নামায লেখায় জোর দেন এই জন্যে যে, তাতে মূলভাষার মৌলিকতা রক্ষা পায় । কিভাবে রক্ষা পায় ? ফার্সির ওই অক্ষরটার বাংলা উচ্চারণ ‘য’-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এই কথা কে বলেছে ?
কাউকে দেখি সেজদা না লিখে সিজদা লেখেন আরবির কাছাকাছি থাকার জন্যে, অথচ মূল শব্দটা হলো ‘সাজদা’ । তা-ও কোনোমতে ‘সিন’ এর উচ্চারণ ‘স’ দিয়ে মেনে নিলে । কারণ এই ‘স’-টা বাংলা শব্দে ‘শ’-এর মতো এবং বিদেশি শব্দে ‘ছ’-এর মতো উচ্চারিত হয় । যেমন ‘সন্ধ্যা’ (শোন্ধা), সিস্টেম (ছিছটেম) ।
কাউকে কখনও ‘নাবী’ লিখতে দেখলাম না, আজীবন ‘নবী’ই লিখে এসেছেন । তাদেরও দেখি এখন দীর্ঘ ঈ না থাকলে ‘ইসলাম’ চলে যাওয়ার শঙ্কায় ত্রস্ত । অবাক কাণ্ড ! তাহলে এতদিন যে ‘ন’-তে আকার দিয়ে বাংলাটা পড়েন নি, তাতে ক্ষতি হয় নি ? এভাবে অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায় ।
বাংলায় দীর্ঘ-ঈ বা দীর্ঘ-ঊ কিন্তু স্বর নয়—এটা কেবলই একটা প্রতীক । আপনি বাংলা গানের সুর শুনলেই আশা করি বিষয়টা বুঝতে পারবেন । এটা আরবি বা উর্দু ভাষার মতো মদ রক্ষা করে না । বেশী লিখলে টান দিয়ে বলতে হবে আর বেশি লিখলে টান ছাড়া—এমন কোনো বিষয় নেই ।
যিনি আরবি মূলশব্দটা জানেন, তাকে দীর্ঘ-ঈ দিয়ে বোঝানোর তো কিছু নেই, আর যিনি জানেন না, তাকে দীর্ঘ ঈ দিয়ে কি আপনি বোঝাতে পারবেন যে, ওখানে একটা ইয়া মারুফ আছে ?
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভাষারীতি দেখলে আক্কেলগুড়ুম হবার যোগাড় হয় । যদিও সেটা ফাউন্ডেশনের কোনো বইতেই সার্থক প্রয়োগ হয়েছে বলে জানি না । এ-ছাড়া আরও বহু প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ভাষারীতি তৈরি করছেন । ইসলামঘেঁষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেসব রীতি বাংলার মূলরীতির সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্বই তৈরি করেছে—ইসলামের কোনো উপকার তাতে হয়েছে কি না, জানা নেই ।
গত বইমেলার পরে মাকতাবাতুল আযহারের (ইসলামি ঘরানার সবচে’ বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান) একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম । তারাও দেখলাম ‘শুদ্ধি’ নামে একটা ভিন্ন প্রকাশনী সামনে আনছেন বইমেলা জায়গা করে নেওয়ার জন্যে । তারাও সেখানে বলেছেন—বাংলা একাডেমির রীতি ফলো করবেন । অথচ এই কাজটা আরও ২০ বছর আগে করা দরকার ছিল । তখন উদ্যোগ নেওয়া হলে হয়তো এখন বইমেলায় বিরাট অংশের শুদ্ধ ইসলামরিলেটেড বইয়ের উপস্থিতি দেখা যেতে পারতো ।
বাংলা একাডেমি বাংলাভাষার একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান । এখানে ভাষারীতি নিয়ে যত দীর্ঘসময় গবেষণা হয়েছে এবং তার ফলে ভাষার প্রমিত যে-রূপ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমরা কি চাইলেই দুয়েকজন যদু-মধুর সুপারিশ মেনে একটা ভাষারীতি তৈরি করে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে পারি ? ভাষাকে ইসলাম-রিলেটেড করার জন্যে যেই গুচ্ছের রীতি আমাদের বিভিন্ন প্রকাশনীর আঙিনায় ঝুলছে—সেগুলোর কি আসলেই একাডেমিক কোনো মূল্য আছে ? আছে কোনো সর্বগ্রাহ্য সমাদর ?
এমনকি আরবি ভাষায়ও আজকাল ‘ফা’-তে তিন নুকতা দিয়ে ‘ভ’ লেখা হয়—ভায়েল, ভিয়েনা প্রভৃতি শব্দ লিখতে, আবার ‘জিম’-এ তিন নুকতা দিয়ে ‘চ’ লেখা হয় । ভাষার এই পরিবর্তন তো রুদ্ধ করার উপায় নেই । এটাকে ধর্মবিরোধী ভাবাও অমূলক ।
সুতরাং বলছি—হে জনাব, ‘ঈদ’ শব্দটাকে ‘ইদ’ লেখা দেখেই আপনি একজন ইসলামপ্রেমীকে বামপন্থী আখ্যা দিয়ে বসবেন না । এসব আপনাকে অগ্রসর করবে না, কেবল বাংলাভাষী মুসলিমকে কষ্ট দেওয়াই সার হবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:২৩