somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুমিয়ে আছে সকল পিতা...

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাবার তখন মাইনে ছিল কম, আর ফুটবলটার দাম ছিল বেশি । ছেলের বায়না দেখে ‍তিনিই দুঃখই পেয়েছিলেন হবে । লুকাতে পারেন নি । ক্ষোভে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন । পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে গালে । সেই দাগ দেখে আম্মু কেঁদেছেন । বাবা রাতভর ছেলেকে বুকে আগলে ঘুমিয়েছেন ।

সেই বুকের গল্প অনেক । একদিন তো বাবার বুকে খেলতে খেলতে আস্ত একটা ডিম ভেঙে ফেললাম । পিচ্ছিল তরল মেখে বাবার বুকটা নোংরা হয়ে গেল । তবু তিনি গভীর ঘুমে । এমনকি বলতে কুণ্ঠা হয় যে, টয়লেটে পর্যন্ত ছেলেটাকে বাবা পাশে দাঁড় করিয়ে রাখতে বাধ্য হতেন ।

শাহিনের বাসায় টেলিভিশন দেখতে যেতাম রোজ । সেই যে বিথি আপা (যাকে আমরা ভূতি ডাকতাম । শ্রুতি আছে, তাকে একবার এক ভূত তাকে উড়িয়ে নিয়ে শেষে একটা রেইনট্রি গাছে ফেলে গিয়েছিল ।) সেদিন কত আদর করে মান-ভাঙাতে চেয়েছিলেন— শাহিন তোমার বন্ধু তো, ওর কথায় কিছু মনে করো না; তুমি আবার আসবে । কিন্তু আমার মন ছিল বড্ড জেদি । বাবা বাসায় ফিরলে সোজা বলে দিলাম— টেলিভিশন আমার চাই-ই...। বাবা রাতেই শয়তানের বাক্স নিয়ে ঘরে ফিরলেন । বহুকাল সেই সাদাকালো টিভিটা ছিল, দিল বদলে গিয়ে যতদিন না সেটা একজন হিন্দু যুবকের কাছে বেচে দিলেন । সে-গল্প অনেক বড় ।

বাবা ব্যাংকার । আমার মনে হয়, ব্যাংক-মিস্ত্রি বলা উচিত । রাজমিস্ত্রি যেমন আলিশান ভবন গড়ে ইটের পিঠে ইটের গাঁথুনি দেবার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে । বাবাও তেমনি । টাকা গোণেন, মানুষেকে দেন, অথচ যৎসামান্য পান—যার কিছুটা সেই ব্যাংকের ভল্টে রাখার মতোও সুখের নয় ।


ভল্টে একদিন ঢুকেছিলাম । বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসেছি ব্যাংকে । বাবা বললেন—একটু সবুর করো, হাতের কাজটা গুছিয়ে বেরুবো । কিন্তু কী এক দুর্বোধ্য কারণে নীল হয়ে যাচ্ছিল সমস্ত শরীর । পাশের সহকর্মী দেখার পর সবাই ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন । চিকিৎসা শেষে এনে শোয়ালেন ব্যাংকের ভল্টে । শীতকাল ছিল । দারোয়ান কাকা তাই রাতে সংলগ্ন টিনশেড রুমে না থেকে ভল্টে থাকতেন । চতুর্দিকে চৌকো চৌকো ট্রাংক । তাতে রাশি রাশি টাকা । এমনকি চৌকির নীচেও কতগুলি ট্রাংক সেধানো । অর্থবিত্তের লোভ যাদের থাকে, তাদের সম্ভবত রোমান্টিক একটি স্বপ্নের নাম—টাকার বিছানায় ঘুমানো । সেই কাণ্ডটাই ঘটে গেল জীবনে—অথচ টেরই পেলাম না ।

আর দারোয়ান ওরফে সিকিউরিটি গার্ডের উসিলায় আরও একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরেকবার । প্রায়ই তার বন্দুকের গায়ে হাতাহাতি করতাম । ট্রিগার চাপতাম । ব্যারেলের মধ্যিখানে পিঠের ওপর যে একটা কম্পাসের কাঁটার মতো থাকে, সেখানে চোখ রাখতাম । তিনিও নেড়েচেড়ে দেখাতেন । একদিন কী করে কিভাবে বন্দুকের সেফটি-পিন খুলে ফেলেছি, আর ট্রিগার ধরে নাড়াচ্ছি । ভাগ্যিস চাপটা জোর পায় নি । হয়তো এইটুকুন ছেলের কোমল হাত বলে । নইলে কী হত, আল্লাহ জানেন ।

তারপর একদিন বড় বোনের স্কুলে যাওয়া আর টিফিনের পয়সা পাওয়ার লাভজনক ঈর্ষা থেকে স্কুলের দপ্তরে গিয়ে হেডমাস্টারের বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে টানতে টানতে বাবার ব্যাংকে নিয়ে আসা—সেও এক অচিনপুরের গল্পের মতো ।


আজ সেই ছেলে—যে এখন বাবা হয়েছে—নিজের ছেলেকে রিক্সায় পাশে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তার বাবার ছেলেবেলার কথা ভাবছে । ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে । বারবার জিজ্ঞেস করছি— বাবা কোথাও যাও? ‘ঘুত্তে’ । ব্যস, এইটুকু মাত্র উত্তর দিচ্ছে । অথচ ছেলেবেলায় কোথাও গেলে বাবাকে প্রশ্ন করতে করতে অস্থির করে তুলতাম । ও-ও করতো, করেও বটে । এমনকি বাইরে বেরুবার আগে ভাতিজির খেলনা দেখে আমাকে একবার, ওর মাকে একবার আঙ্গুল ধরে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলছিল— বাবা, দেকো, মাম্মাম, দেকো, সুন্নুর ।

রঙিন আলো ছড়নো এমন একটা খেলনা শিশুদের ভালোলাগাই স্বাভাবিক । ভাবলাম, একটা কিনেই দিই । দোকান পর্যন্ত যেতে যেতে আরও তন্দ্রালু হয়ে পড়েছে ও । ঘরভর্তি নানান আকারের বল, তারপরও একটা বল দেখে বলল—বাবা, বোওল । একটা লাইটিং ট্রেইন আর একটা বল কিনে যখন বাসায় ফিরছি, ততক্ষণে ঘুমে ঢলে পড়েছে ।

কাঁধে নিয়ে ফিরছি একটি ঘুমন্ত শিশুকে, নাকি আগামী দিনের একটি নাছোড় সন্তানের বাবাকে—ভাবনার গতি খেই পায় না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×