বাবার তখন মাইনে ছিল কম, আর ফুটবলটার দাম ছিল বেশি । ছেলের বায়না দেখে তিনিই দুঃখই পেয়েছিলেন হবে । লুকাতে পারেন নি । ক্ষোভে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন । পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে গালে । সেই দাগ দেখে আম্মু কেঁদেছেন । বাবা রাতভর ছেলেকে বুকে আগলে ঘুমিয়েছেন ।
সেই বুকের গল্প অনেক । একদিন তো বাবার বুকে খেলতে খেলতে আস্ত একটা ডিম ভেঙে ফেললাম । পিচ্ছিল তরল মেখে বাবার বুকটা নোংরা হয়ে গেল । তবু তিনি গভীর ঘুমে । এমনকি বলতে কুণ্ঠা হয় যে, টয়লেটে পর্যন্ত ছেলেটাকে বাবা পাশে দাঁড় করিয়ে রাখতে বাধ্য হতেন ।
শাহিনের বাসায় টেলিভিশন দেখতে যেতাম রোজ । সেই যে বিথি আপা (যাকে আমরা ভূতি ডাকতাম । শ্রুতি আছে, তাকে একবার এক ভূত তাকে উড়িয়ে নিয়ে শেষে একটা রেইনট্রি গাছে ফেলে গিয়েছিল ।) সেদিন কত আদর করে মান-ভাঙাতে চেয়েছিলেন— শাহিন তোমার বন্ধু তো, ওর কথায় কিছু মনে করো না; তুমি আবার আসবে । কিন্তু আমার মন ছিল বড্ড জেদি । বাবা বাসায় ফিরলে সোজা বলে দিলাম— টেলিভিশন আমার চাই-ই...। বাবা রাতেই শয়তানের বাক্স নিয়ে ঘরে ফিরলেন । বহুকাল সেই সাদাকালো টিভিটা ছিল, দিল বদলে গিয়ে যতদিন না সেটা একজন হিন্দু যুবকের কাছে বেচে দিলেন । সে-গল্প অনেক বড় ।
বাবা ব্যাংকার । আমার মনে হয়, ব্যাংক-মিস্ত্রি বলা উচিত । রাজমিস্ত্রি যেমন আলিশান ভবন গড়ে ইটের পিঠে ইটের গাঁথুনি দেবার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে । বাবাও তেমনি । টাকা গোণেন, মানুষেকে দেন, অথচ যৎসামান্য পান—যার কিছুটা সেই ব্যাংকের ভল্টে রাখার মতোও সুখের নয় ।
ভল্টে একদিন ঢুকেছিলাম । বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসেছি ব্যাংকে । বাবা বললেন—একটু সবুর করো, হাতের কাজটা গুছিয়ে বেরুবো । কিন্তু কী এক দুর্বোধ্য কারণে নীল হয়ে যাচ্ছিল সমস্ত শরীর । পাশের সহকর্মী দেখার পর সবাই ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন । চিকিৎসা শেষে এনে শোয়ালেন ব্যাংকের ভল্টে । শীতকাল ছিল । দারোয়ান কাকা তাই রাতে সংলগ্ন টিনশেড রুমে না থেকে ভল্টে থাকতেন । চতুর্দিকে চৌকো চৌকো ট্রাংক । তাতে রাশি রাশি টাকা । এমনকি চৌকির নীচেও কতগুলি ট্রাংক সেধানো । অর্থবিত্তের লোভ যাদের থাকে, তাদের সম্ভবত রোমান্টিক একটি স্বপ্নের নাম—টাকার বিছানায় ঘুমানো । সেই কাণ্ডটাই ঘটে গেল জীবনে—অথচ টেরই পেলাম না ।
আর দারোয়ান ওরফে সিকিউরিটি গার্ডের উসিলায় আরও একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরেকবার । প্রায়ই তার বন্দুকের গায়ে হাতাহাতি করতাম । ট্রিগার চাপতাম । ব্যারেলের মধ্যিখানে পিঠের ওপর যে একটা কম্পাসের কাঁটার মতো থাকে, সেখানে চোখ রাখতাম । তিনিও নেড়েচেড়ে দেখাতেন । একদিন কী করে কিভাবে বন্দুকের সেফটি-পিন খুলে ফেলেছি, আর ট্রিগার ধরে নাড়াচ্ছি । ভাগ্যিস চাপটা জোর পায় নি । হয়তো এইটুকুন ছেলের কোমল হাত বলে । নইলে কী হত, আল্লাহ জানেন ।
তারপর একদিন বড় বোনের স্কুলে যাওয়া আর টিফিনের পয়সা পাওয়ার লাভজনক ঈর্ষা থেকে স্কুলের দপ্তরে গিয়ে হেডমাস্টারের বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে টানতে টানতে বাবার ব্যাংকে নিয়ে আসা—সেও এক অচিনপুরের গল্পের মতো ।
আজ সেই ছেলে—যে এখন বাবা হয়েছে—নিজের ছেলেকে রিক্সায় পাশে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তার বাবার ছেলেবেলার কথা ভাবছে । ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে । বারবার জিজ্ঞেস করছি— বাবা কোথাও যাও? ‘ঘুত্তে’ । ব্যস, এইটুকু মাত্র উত্তর দিচ্ছে । অথচ ছেলেবেলায় কোথাও গেলে বাবাকে প্রশ্ন করতে করতে অস্থির করে তুলতাম । ও-ও করতো, করেও বটে । এমনকি বাইরে বেরুবার আগে ভাতিজির খেলনা দেখে আমাকে একবার, ওর মাকে একবার আঙ্গুল ধরে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলছিল— বাবা, দেকো, মাম্মাম, দেকো, সুন্নুর ।
রঙিন আলো ছড়নো এমন একটা খেলনা শিশুদের ভালোলাগাই স্বাভাবিক । ভাবলাম, একটা কিনেই দিই । দোকান পর্যন্ত যেতে যেতে আরও তন্দ্রালু হয়ে পড়েছে ও । ঘরভর্তি নানান আকারের বল, তারপরও একটা বল দেখে বলল—বাবা, বোওল । একটা লাইটিং ট্রেইন আর একটা বল কিনে যখন বাসায় ফিরছি, ততক্ষণে ঘুমে ঢলে পড়েছে ।
কাঁধে নিয়ে ফিরছি একটি ঘুমন্ত শিশুকে, নাকি আগামী দিনের একটি নাছোড় সন্তানের বাবাকে—ভাবনার গতি খেই পায় না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪১