প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। নৈতিকতা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। কেউ যখন আপনাকে আঘাত করবে, আর আপনি জ্বলে উঠবেন, তখন আপনার ইচ্ছা হবে তাকে এমনভাবে প্রত্যাঘাত করতে, যেন সে পরাজিত হয়। ‘পরাজিত’র মানে হলো, সে-ও আপনাকে আবার আঘাত করার ইচ্ছা রাখে, অথচ সে ক্ষমতা তার নেই।
কিন্তু যদি আপনার আঘাত সে সাদরে গ্রহণ করে, তখন জ্বলুনি শেষ হওয়ামাত্রই অনুশোচনা আসে। যেমন—জোয়ান ছেলেকে বাবা বেদম পেটাচ্ছেন, আর ছেলে মার খেয়েই যাচ্ছে, পাল্টা দিচ্ছে না। ফলে একটু পরেই বাবার খারাপ লাগতে শুরু করে। বাবা কেঁদে ফেলেন।
প্রবল প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ অনুশোচনা পছন্দ করে না। সে চায়, প্রতিপক্ষ জ্বলে উঠুক কিন্তু ব্যর্থ হোক। সে যখন নিজেই ব্যর্থ হয়—দুর্বিনীত হয়ে পড়ে। মন্দের আশ্রয় নেয়। প্রতিপক্ষকে খোঁচা দিয়ে, দুয়ো দিয়ে অপমান করতে চায়। অপমান সবসময় নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে এবং ঘৃণার জন্ম দেয়। এই ঘৃণা থেকেই দ্রোহ ও প্রতিশোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। শয়তান তাই অপমানজনক উস্কানি পছন্দ করে, যেন মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।
রসুলের স. যুগে একজন মদ্যপকে ধরে আনা হলে রসুল স. তাকে শাস্তি দিতে বললেন। সাহাবিরা শাস্তি দিচ্ছিলেন। কেউ বললেন— আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করুন। নবীজি বললেন— এভাবে বলে শয়তানের সহযোগী হয়ো না, বরং বলো, হে খোদা, তাকে মাফ করুন। (বুখারি, কিতাবুল হুদুদ, হা: ৭৬৮)
দুর্বিনীতেরা ঝাল মেটায় মিথ্যা-সমালোচনা করে। এটা মিথ্যা-জানার কারণেও হয়, আবার ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ছড়িয়ে দিতে গিয়েও হয়। ধর্মীয় আবেগ দেখিয়ে মিথ্যা সমালোচনার ধুম্রজাল ছড়ানো এক্ষেত্রে সবচে বেশি কার্যকর। মানুষের মধ্যে ধর্মভীতি বাড়ানোর অজুহাতে একটা যুগে বেশ কিছু জাল হাদিসও রচিত হয়েছে।
এবং এই ধর্মাবেগী সমালোচনার ছুড়ি থেকে ইমাম বুখারি থেকে নিয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং ইমাম গাজালি থেকে ইবনে সিনা—কেউই রক্ষা পান নি। আবেগিরা তাদের গায়ে বেদীন, দালাল, কাফির, জিন্দিক, ইহুদি, নাসারা, শিয়া—এমন কোনও অসুস্থ লকব নেই যা লাগায় নি। অথচ অন্ধ ধর্মীয় আবেগ ছিল মক্কার মুশরিকদের প্রধান দলিল। তাই তারা মিথ্যা সমালোচনা করত, গুজব ছড়াতো। স্বীয় ধর্ম আর ধর্মীয় কর্তৃত্ব রক্ষায় হেন জঘন্য কাজ নেই, তারা করে নি। আজ সেটা কী করে যে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করল, কে জানে।
কিন্তু তারপরও আমাদের প্রিয়নবী ও পূর্বসূরি কোনও আলেম প্রতিশোধপরায়ণ হন নি, প্রতিপক্ষকে অপদস্থ করেন নি। নিজেরা অপমান সয়েছেন, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। খোলামেলা আহ্বান জানিয়েছেন, আর সত্যের দাওয়াত অব্যাহত রেখেছেন। ফলে মিথ্যা-সমালোচনা উল্টো তাদের শুহরত এনে দিয়েছে, কাজকে বেগবান করেছে এবং করেছে কৌশলী ও শক্তিশালী।
অতএব, মিথ্যা-সমালোচকদের স্বাগতম।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৫:৩৩