ইলম, ইবাদত ও হাদারত—এই তিনটির সমন্বয় নিয়ে মাঝেমধ্যে নানা ভাবনা উঁকি মারে। আলেম কি আসলেই নেই? ইলম আর জ্ঞান কি একই জিনিস? আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে ইলমের সম্পর্ক কতখানি? মুসলিম জাতির অধঃপতন মানে কি শুধু মুসলিম সভ্যতার পতন?—এরকম নানান প্রশ্ন জাগে। মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিবর্তন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই চিন্তাটা প্রথম আসে। আজ তার দ্বিতীয় পর্ব।
এক.
ইলম হলো নুর; অহির আলো। ‘জ্ঞান’ শব্দ দিয়ে ইলমকে সম্পূর্ণ অনুবাদ করা যায় না। আবার আলোর আরবি ‘নুর’ হলেও আলো বলে নুরের তাৎপর্য পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। যদিও জ্ঞানকেও আলো বলা হয়—যেমন বলা হয় ‘জ্ঞানই আলো’। আমার মতে, ‘জ্ঞান আলো’ এটা ঠিক থাকলে ‘ইলম নুর’ এটাও ঠিক আছে। এর মানে এ-নয় যে, জ্ঞান ও ইলম দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। তবে জ্ঞান যেহেতু ক্ষতিকারকও হতে পারে (অর্থাৎ, জ্ঞানের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান থাকতে পারে কিংবা ক্ষতিকর বিষয়ের জ্ঞানকেও জ্ঞানই বলা হয়) আর ইলম কেবল উপকারীই হয় (যদিও ইলম ব্যবহার করেও ক্ষতি করা হয়, তবে সত্তাগতভাবে ইলম ক্ষতিকর নয়) বরং উপকারী জ্ঞানকে হলো ইলমের একটি অংশ বলা যায়।
ইবাদতের সঙ্গে ইলমের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ইলমের প্রায়োগিক দিকটাই ইবাদত। ইবাদত যে ‘ইবাদত’ হলো, সেটাও ইলমের মাধ্যমেই জানা গেছে। মানে কোনটি ঠিক ইবাদত আর কোনটি নয়, সেটি কেন ইবাদত আর কেন নয়, কে সেই সেই ইবাদতের নির্ধারক আর কে নয়—এসবের ব্যাখ্যাই ইলম। খোদ ইলম অর্জনও একটা ইবাদত। বরং অপরিহার্য ইবাদত। শুদ্ধ ইবাদত এবং ইবাদতের শুদ্ধি ইলম ছাড়া কি সম্ভব? ইলম না-থাকা সত্ত্বেও ইবাদত বিষয়ে সমাধানদাতাদের প্রতি রসুল স. ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বলেছেন : আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুক। যিনি যত বেশি ইলমের অধিকারী ইবাদতে তার মর্যাদাও ততধিক।
ইবাদাত তাহলে কী? ইসলামের যখন যা চাহিদা তা পূরণ করা—এটাই সবচে’ সংক্ষিপ্ত উত্তর। ইলম বলবে কখন কী চাহিদা, মুসলমান তা বাস্তবায়ন করবে। এই অর্থেই বলা হয়, মুসলমানের সকল কাজ ইবাদত। ইসলাম ও ইবাদত গূঢ় অর্থে সমার্থক। ইসলাম অর্থ নিজেকে অপরের কাছে সমর্পণ করে দেওয়া। আবার ইবাদত অর্থ মনিবের দাসত্ব করা, মনিবের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া। ইসলাম পালনই ইবাদত। ইসলাম জানাই ইলম। ইসলাম কী? করণীয় অর্থে শাহাদাত, সালাত, সিয়াম, হজ্জ, জাকাত এবং নিষিদ্ধ বিষয়াবলি না-করা। আবার এগুলো ইবাদতেরই একেকটি অধ্যায়। ইসলাম বাস্তবায়নের চর্চিত পদ্ধতি হলো— তালিম, তাবলিগ, তাজকিয়া, খিলাফত, জিহাদ। এগুলোও ইবাদত। ইবাদতের প্রতিটি অংশই ইবাদত।
দুই.
উপরে যা বলা হলো, এগুলো সবই ‘নীতিনির্ধারণী’ পর্যায়ের বিষয়, স্কুলের সিলেবাসের মতো বিষয়, পড়াশুনার মতো মানবিক বিষয়—কাঠামো বা অবকাঠামোগত বিষয় নয়। একটা সহজ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে আলোচনাটা উত্থাপন করি। যদি বলি, স্কুলের শিক্ষক, তাহলে আপনি কী বুঝবেন? একজন ব্যক্তি, তাই না? যদি বলি সিলেবাস, তাহলে আপনি বুঝবেন নির্দিষ্ট সময়ে যে পাঠ তাকে সম্পন্ন করতে হবে। যদি বলি বই, তাহলে আপনি বুঝে নেবেন একগুচ্ছ কাগজ, যার মধ্যে কালো অক্ষরের পাঠ রয়েছে। যদি বলি বেঞ্চ, তাহলে আপনি দেখিয়ে দেবেন কাঠের তৈরি একটি কাঠামো, যাতে দুটি লম্বা-চওড়া কাঠ উপর-নীচ করে জোড়া লাগানো হয়েছে, যার একটিতে বসতে হয়, আর অন্যটিতে বই রাখতে হয়। কিন্তু যদি বলি, স্কুল? তাহলে আপনার চোখের তারায় কী ভাসবে? শুধু বই? শুধু বেঞ্চ? শুধু শিক্ষক? বরং আপনি দেখবেন একটি ঘর, একটি লম্বালম্বি ঘর, যেখানে অনেকগুলো কক্ষ। যেখানে বই, বেঞ্চ, শিক্ষক, ছাত্র সবকিছুর সমাহার আছে।
হাদারত কী? ওই যে স্কুলঘর, ওই যে অবকাঠামো—ওটাকেই বলছি হাদারত (حضارة)। মানে ওটা সভ্যতার নিদর্শন আর কি! (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই হাদারত দেখে কেউ আবার যেন ‘আল-ইসলামুল হাজির’ চিন্তাধারাকে চিহ্নিত না-করেন।) মানে ইলম যদি ইমামের কেরাত হয়, ইবাদত যদি হয় নামাজ, তাহলে সভ্যতা হলো মসজিদ। মসজিদ অবকাঠামো দিক থেকে মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন। যদিও সভ্যতা মানে একমাত্র অবকাঠামো নয়, জাগতিক উন্নয়নই সভ্যতার মূলকথা। উন্নয়নের আকাঙক্ষাও সভ্যতা। বিজ্ঞান সভ্যতার নিয়ামক। ক্ষমতা সভ্যতার নিয়ন্ত্রক। সভাষদ বা সভার সদস্যকে বলা হয় সভ্য। সে-কারণেই আচরণেও ‘সভ্যতা’ অংশ নিয়েছে। সরকার ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাকেও সভ্যতার বিষয়বস্তুতে ঢুকে পড়েছে। একেবারে সংক্ষেপে যদি আধুনিক সংজ্ঞামতেও বলি, তাহলেও সভ্যতা হলো, মানুষের সাংগঠনিক বসবাসের ক্রম-উন্নতির স্তর।
এবার একটা কথা বলি, ইলমের সঙ্গে ইবাদতের যেমন সরাসরি সম্পর্ক, সভ্যতার সঙ্গে কিন্তু তেমন নয়। অন্তত এখন সভ্যতার যেই ব্যাখ্যা আমরা দেখি, সে-অনুযায়ী ইলমের সঙ্গে সভ্যতার সরাসরি সম্পর্ক তুলনা করা কঠিন। এমনকি ইবনে সিনা বা মুসলিম সভ্যতাকে যারা গৌরবময় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন—তাদের ইমান-আকিদা নিয়ে আজকাল যেসকল তথ্য আমরা পাচ্ছি, তাতে এই ধারণা আরও মজবুত হয়। তবে এটা বলা যায় যে, ইলমের নির্যাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক একসময় গাঢ় ছিল। খলিফা ওমরের রা. উন্নয়নে চোখ রাখুন—পুলিশি ব্যবস্থা, সরাইখানা নির্মাণ, সেঁচপ্রকল্প, প্রশাসনিক সেক্টর বিভাজন ইত্যাদি দেখুন, বিষয়টা সহজে বুঝে আসবে। দেখুন, এসব করতে গিয়ে তার খোদাভীরুতায়ও ভাঁটা পড়ে নি, বরং খোদাভীরু সুদক্ষ লোকদের তিনি প্রশাসনে নিয়োগ দিতেন। সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী আদর্শ খলিফাদের আমলেও ইলম, ইবাদত ও হাদারত একসঙ্গে সমন্বিত হয়ে চলেছে। কিন্তু মুসলিম সমাজে জাতীয়তাবাদের উত্থান হওয়ার পরে কালক্রমে সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে এসেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে ‘জ্ঞান’। এখনকার সভ্যতার সঙ্গে তাই জ্ঞানের সম্পর্ক যত গভীর, ইলমের সম্পর্ক তত দূরে। যদিও মুসলিম শাসনের সবচে’ খারাপ সময়টাতেও ইবাদতগুজার লোকজন রাষ্ট্রের নিয়ন্তা ছিলেন।
তিন.
এইসব কথার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো, বর্তমান সময়—যাকে মানবসভ্যতার চূড়ান্ত উৎকর্ষের যুগ বলা হয়—যখন মুসলিম জাতির অধ:পতন চলছে, তখন দেখা যাচ্ছে যে, একদল বিদেশ-পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত লোক ইসলামের দিকে ঝুঁকছেন এবং মুসলিমদের সেই অধ:গতি থেকে উন্নতির দিকে উত্তরণের চেষ্টা করছেন। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারা সকলেই ‘মুসলিম-সভ্যতার পতন’কেই ‘মুসলিমদের পতন’ বলে চিহ্নিত করছেন এবং অর্থ, ক্ষমতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সভ্যতা ফিরিয়ে আনাটাই ‘উত্তরণ’ বলে ভাবছেন। আশা করছেন, এভাবেই মুসলিমজাতি হৃত গৌরব ফিরে পাবে। খেয়াল করে দেখবেন, এই লোকগুলো হালাল জীবন-যাপন করেন, করতে চান। ইবাদতেও মনোযোগী। তারা আধুনিক জ্ঞানের চর্চা করেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একাজে তারা ইলমের ধারকদেরও ডাকছেন এবং মুখে বলছেন, তারা চান আলেমগণ তাদের নেতৃত্ব দিক। কিন্তু তাদের ভাবগতিকে এটা স্পষ্ট যে, তারা নিশ্চিত জানেন, আলেমগণ নেতৃত্বদানের অবস্থায় নেই—প্রকারন্তরে আলেমদের থেকে তারাই বেশি যোগ্য।
এটাও অমূলক নয় যে, আলেমগণের ইলম রয়েছে বটে—জ্ঞান ততটা নয়। ফলে অঙ্ক মিলছে না। তুরাসে ইসলামের খবর যাদের নেই, তারা তাতে শকড হচ্ছেন। ভাবছেন, যে কুরআন-হাদিস জানে, সে-কেন ‘সভ্য’ হয় না, তাহলে তারা কি আসলে ইলম পান নি? তারা বুঝতে পারছেন না যে, ইলম ও জ্ঞানের পথ এখন দুস্তর মরুর মতো বিস্তর ব্যবধান পেয়েছে। ফলে কেউ কেউ উন্নাসিক হয়ে বলছেন, এ-যুগে আসলে আলেম নেই। মুসলিম-সভ্যতার পতন হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু তারা যেটা বুঝতে পারছেন না, আসলে কেউই বুঝতে চাইছেন না যে— সভ্যতা যেমন ক্ষয়ে গেছে, তেমনি ইলমেও দুর্ভিক্ষ এসেছে, ইবাদতেও এসেছে মহামারি।
প্রশ্ন হলো, আধুনিক জ্ঞানের অভাবকে আলেমের ইলমের অভাব বলে বিচার করা উচিত কি না।
ধরুন, পুরাতন জরাজীর্ণ মসজিদটি নতুন করে নির্মাণ করার ইচ্ছা মসজিদ কমিটির। সভাপতি মহোদয় ইমাম সাহেবকে বললেন অর্থ তুলতে। ইমাম সাহেব জুমার আগে দানের মহিমা বয়ান করলেন। লক্ষ লক্ষ টাকা উঠছে। সভাপতি তা আদায় করছেন, কমিটি মসজিদ নির্মাণের ব্যবস্থাপনাও করছেন, দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছেন, সরকারি দপ্তরে লোক পাঠিয়ে নকশা পাস করিয়ে আনছেন, ইট-বালি-সিমেন্ট-টাইল বাছতে বাছতে কিনতে কিনতে কমিটির লোকজন জেরবার। তর তর করে একটি সুন্দর মসজিদ মাথা তুলছে। নির্মাণকাজ সমাপ্তির পর দেখা গেলো, কমিটির লোকজন ইমাম সাহেবের প্রতি অসন্তুষ্ট। কারণ, ইমাম সাহেব যদিও টাকা তোলায় যারপরনাই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নিজে তো কোনও কন্ট্রিবিউশন করেন নি। একজন ইমাম হিসেবে, মসিজদের নেতা হিসেবে তার কি উচিত ছিল না যে, সবচে বেশি অর্থ তিনি নিজেই দান করবেন? মানে তিনি ভালো আলেম নন। তাকে পাল্টে একজন ইলমওয়ালা (মানে বিত্তবান) আলেম নিয়োগ দিতে হবে।
এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত মনে করেন?
আবার এটাও ঠিক যে, কোনও কোনও আলেম ইলমের সঙ্গে জ্ঞানকে যোগ করে কম্পারেটিভ ওয়েতে চেষ্টা করছেন, আবার শিক্ষিত লোকজনও কিছুটা ইবাদতের ইলম শেখার দিকে আগাচ্ছেন। কিন্তু শত শত বছরের ধুলোর আস্তর সরানো সহজ নয়। গণ্ডগোলটাও তাই ওইখানে বাঁধে। আলেমগণ এসব শিখতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন।
প্রথমতঃ এসবের সঙ্গে দুনিয়ার সম্পর্ক বড় বেশি, যা তারা বরাবরই এড়িয়ে চলেন। অন্যান্য আলেমগণও এতে করে তাকে দুনিয়াদার ভেবে বসতে পারেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি যে ইলম ধারণ করেন, তা টিকিয়ে রাখার জন্যই তাকে নিয়মিত সেটা চর্চা করতে হয়। সেই চর্চা নিয়মমাফিক সেরে আধুনিক জ্ঞান শেখার সময় তিনি খুব একটা পান না। তৃতীয়তঃ এই আধুনিক জ্ঞান শেখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি ইলম চর্চা—সেটার সমাধান তিনি কখনোই করতে পারেন না এবং এখন অবধি তা বিরাট বিতর্কের বিষয়। চতুর্থতঃ ইলমের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ের সূত্রগুলো নিয়ে যে খুব বেশি চর্চা হয়েছে, তা-ও নয়। এইসব কারণ, একটা পর্যায় তার শেখার গতিকে ভাঁটায় নামিয়ে আনে। সব থেকে বড় বিষয় হলো, বর্তমান পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ যেহেতু আধুনিক শিক্ষিতদের হাতেই, ফলে তাদের আত্মবিশ্বাসের সামনে আলেমগণ সবসময়ই একটু পিছনে পড়ে যান।
কিন্তু যারা আধুনিক জ্ঞানে শিক্ষিত, তাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা তত মারাত্মক নয়। মানে তারা ইলম শিক্ষা বলতে কেবল এমন কিছু সুরা-কেরাত-হাদিস-মাসআলা রপ্ত করে নেওয়াতেই তৃপ্ত হতে পারেন, শিখতে যেগুলো দিয়ে তিনি তার দৈনন্দিন জীবন বিশুদ্ধভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। এর বেশি যতটুকু তিনি জানতে চান, সেটুকুই তার কাছে অতিরিক্ত জ্ঞান, যা নিয়ে তিনি গর্ব করতে পারেন।
আরও অনেক কথা আছে, পর্যায়ক্রমে লেখার এরাদা রাখি। আর ওই নিবন্ধটা এখানে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:৩৭